শুক্রবারের অলস দুপুর। বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছি। হাতে সিগারেট। জানালার ওপাশে নীল আকাশ। দুরের একটা বাসার ছাদে একসঙ্গে দুই দেশের পতাকা উড়ছে। ওপরে ব্রাজিল ও নিচে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার পতাকা দেখেই মনে পড়ে গেলো আনন্দমুখর সেই স্মৃতি। যার পুুরোটা জুড়েই ছিল ভ্যালেন্তিনা সিলভিয়ানে। আর্জেন্টাইন এক সুহাহাসীনি।
হঠাৎ স্মৃতির মনিকোঠা থেকে জ্বলজ্বল করে উঠলো সেই দুই দিনের সমস্ত ঘটনা। যেন জলজ্যান্ত সবকিছু ভাসছে চোখের সামনে।
এরকমটা হয় আমার। যখন আশেপাশে কেউ না থাকে আমার। একা ভাবলেসহীন সময় কাটে। তখন পুরানো অম্ল-মধুর স্মৃতি মনে করে জাবর কাটি। সুখের স্মৃতি মনে করে আনন্দ পাই, বেদনাহত হই কখনো-সখনো। আহা… সেইসব দিন। মনে হয় আগের দিনে ফিরে যেতে পারলেই ভালো হতো।
অবশ্য যাপিত জীবনের রূঢ় বাস্তবতা পুরানো স্মৃতি মনে করতেই দেয় না। পেটের ধান্দায় প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি ছুটে চলতে হয়। সাংবাদিকতার মতো স্ট্রেসফুল কর্মে জড়িয়ে অলস চিন্তা বা স্মৃতির জাবর কাটার সময়টা কোথায়? তবু মাঝে-মধ্যে, কিংবা শুক্রবারের ছুটির দিনে একটু-আধটু ফুসরত কিছুটা মেলে বৈকি।
যাইহোক, ফিরে আসি ভ্যালেন্তিনা সিলভিয়ানের কাছে। নামটা কঠিন, কিন্তু তার মনটা খুব সরল। আমি তাকে ডাকি সিলভানা বলে। কখনো কখনো সিলভি বলেও ডাকতাম। আমার সঙ্গে সিলভানার যখন পরিচয় তখন তার বয়স সবে ২৩ পেরিয়েছে। আমি ত্রিশের কোঠায় পা’ দিয়েছি। ২০১০ সালের কথা। হঠাৎ তিন মাসের একটি ফেলোশিপে গিয়েছিলাম সুদুর আটলান্টায়। সিলভানা এসেছিল বুয়েনস আয়ার্স থেকে, আর্জেন্টিনার রাজধানী। আমরা ডর্মে পাশাপাশি দুটি কক্ষে থাকতাম। একই বারান্দায় বসে কফি খেতাম। সিলভানা তখন সবে মার্স্টার্স কমপ্লিট করেছে। আমি ঢাকার পেশাদার সাংবাদিক।
সিলভানা ছিপছিপে গড়নের মেয়ে। উচ্চতায় প্রায় আমার সমান। মানে পাঁচফুট ছয় ইঞ্চি। তলপেটে হালকা মেদ আছে। ভারী নিতম্ব। উন্নত বক্ষদেশও। দেখতে কিছুটা দক্ষিণ ভারতীয় নায়িকাদের মতো। নাকটা খাঁড়া। এত সুন্দরী তবু কোনও অহঙ্কার নেই তার মনে। প্রথম দিনেই তার সঙ্গে পরিচয় থেকে ঢলাঢলির মতো অবস্থা।
আমি বাঙালী ছেলে। আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। অভ্যাসবশত: প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু সতর্ক থাকি, পাছে আবার আমাকে মন্দ মানুষ হিসেবে ট্রিট করে কি না। ফেলোশিপের কাস শেষে ডর্মে ফিরে কফি নিয়ে তুমুল আড্ডা আর হইচই করি। সিলভানা কোনও রাখঢাক না রেখেই হুটহাট আমার রুমে চলে আসে। এমনকি মধ্যরাতেও। আমি সঙ্কোচ করি, তার কক্ষে অত যাই না। পাছে আবার কি না কি ভেবে বসে। এভাবেই দিন পার হচ্ছিল। উইকেন্ডেতে আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করি। বারে যাই। দুই-এক পেগ হুইস্কি খেয়ে হালকা তালে একটু-আধটু নাচি। তারপর ডিনার শেষে একসঙ্গে ফিরে আসি ডর্মে।
এক উইকেন্ডেতে সিলভানা প্রস্তাব দিল চলো জর্জিয়া দিয়ে তাইবি আইল্যান্ডে ঘুরে আসি। সিলভানার ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। গাড়ি ভাড়া করে যাবো। একরাত থেকে পরদিন সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসবো। খরচ ভাগাভাগি হবে। আমি এক কথাতেই তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম। আমি তো মনে মনে ভাবি, আহা সিলভানা তুমি তো জানো না। তুমি রাজী হলে তো আমি পুরো খরচই দিতে প্রস্তুত। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করি না। সঙ্কোচ হয় আমার।
পরিকল্পনা মতো গাড়ি ভাড়া করলো সেই। পরের উইকেন্ডেতে আমরা রওয়ানা দিলাম সাত-সকালে। পাঁচ ঘণ্টার জার্নি। পথে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে হাইওয়ে ধরে আমরা ছুটছি। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের তাইবি আইল্যান্ডে সাগর তীরের একটি কটেজের রুম বুকিং দিয়েছে সিলভানা। গানের সঙ্গে উচ্চস্বরে গলা মিলিয়ে ড্রাইভ করছে সিলভানা। আমি কখনো কখনো তাতে তাল দেই। কিন্তু এইসব গানে আমি অভ্যস্থ না। আমি তাল মেলাতে পারি না। রণেভঙ্গ দেই। সিলভানা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বলে- ‘ওহ, ডিয়ার, ইউ আর সো কুউউউল’। এনজয় ম্যান।’
আমি ভাবি, বিশ্ব মানচিত্রে দেখা যায় না এমন একটা দেশের রাজধানী শহর থেকে সাড়ে চার শ’ কিলোমিটার উত্তরের অজপাঁড়াগায়ের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। যাপিত জীবনের নানা প্রতিকূলতা ঠেলে রাজধানীতে সেটলড হওয়ার চেষ্টা করছি নিজের প্রচেষ্টায়। চাইলেই তো ধুম করে আমি সবকিছু ভুলে যেতে পারি না। আমার আড়ষ্ঠতা ভাংতে সসয় লাগবে।
‘উই আর হেডিং তাইবি আইল্যান্ড উইদিন মিনিটস।’ সিলভানার কথায় যেন সৎবিৎ ফিরে এলো। আমরা দুপুর বারোটা নাগাদ কটেজে গিয়ে পৌঁছালাম। কটেজের নাম দ্য আটলান্টিক ওয়ান। কটেজে এসে একটু টাসকি খেলাম। একটা বেড রুমের কটেজ। খরচ কমাতে সিলভানা এক রুম বুকিং দিয়েছে। সিলভানা বললো- ‘উই উইল স্টে ইন ওয়ান রুম, ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম?’ আমি তাৎক্ষণিক জবাব দিলাম- ‘নো, নো।’ আমি তো মনে মনে মহা এক্সাইটেড। আবার শঙ্কাও কাজ করছে। নানা কিছু ভাবছি, কল্পনা করছি। আবার সেসব দুরে ঠেলে সরানোরও চেষ্টা করছি। সিদ্ধান্ত নিলাম, সিচুয়েশন বুঝে প্রতিটি পা’ ফেলতে হবে। যা-তা করে সম্মান হানী করা যাবে না।
সিলভানা আমাকে প্রথম বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। আমি তাকে ঠেলে পাঠালাম। আমি একটু সোফায় বসে স্থির হই। অস্থির হওয়া যাবে না। সিলভানা প্রায় ২০ মিনিট পর বাথরুম থেকে বের হলো। শাওয়ার নিয়েছে। একটা শর্টস পড়েছে। সিলভানার ফর্সা ও মাংসাল উরুর অর্ধেক অনাবৃত। সোনালী আলোয় তা চকচক করছে। সাথে স্লিভলেস গেঞ্জির মতো কোনও একটা পোশাক পড়েছে। লাল রঙের ব্রা’র ফিতা দেখা যাচ্ছে কাঁধে। ভেজা চুলে তাকে অপূর্ব লাগছে। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাচ্ছে। আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
দুপুরে লাঞ্চ করলাম কটেজের ক্যান্টিনে। তারপর কটেজের সামনের খোলা বারান্দায় পাশাপাশি আধশোয়া অবস্থায় হাতে কফির মগ নিয়ে গল্প করছি। আমার হাতে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বেনসন সিগ্রেট। সিলভানা একটা একটা লম্বা চুরুট ধরালো। আমরা চুরুট আর সিগারেট একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করে টানছি। সিলভানা তার জীবনের গল্প শোনাচ্ছে।
বুয়েনস আয়ার্সের উপশহর পুয়ের্তো মাদেরোতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা কর্পোরেশনের চাকরী করেন। পড়াশুনা করেছে ইউনিভার্সিটি অব বুয়েনস আয়ার্স থেকে, সোসিওলজি। দুই বোন। ছোট বোন বুয়েনস আয়ার্সের একটি স্কুলে পড়ে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হয়ে বিভিন্ন দেশে গরীব মানুষের জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছে তার। সেজন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলছে। তার পরিবারটা অনেক হাসি-খুশির। সিলভানা তার দাদির মজার মজার গল্প শোনানোর চেষ্টা করছে আমাকে। আমি আরেকটা বেনসন ধরিয়েছি। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি দক্ষিণ আটলাান্টিকের গভীর সমুদ্রের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমার মনে শুধু ঘুরে-ফিরে আসছে রাতের কথা। আমি একই সঙ্গে পুলকিত এবং ভয়, দুটোই অনুভব করছি।
সিলভানা হঠাৎ বললো, ‘হেই অ্যানেল, লেটস ওয়াক টু দ্য বিচ’। আমাকে সিলভানা অ্যানেল বলে ডাকে। আমিই তাকে নামের দুই শব্দের প্রথম অক্ষর এন ও এল ধরে ডাকতে বলেছি। আমরা বিচে হাঁটলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। রাতের ডিনার শেষে আবারো আগের জায়গায়। কটেজের খোলা বারান্দায়, আধশোয়া। হাতের কফির মগ, সিগারেট আর চুরুট। নানা গল্পে মাতোয়ারা। সিলভানা প্রচুর গল্প করতে পারে। প্রচুর হাসতে পারে। খিলখিলিয়ে হাসে। বিপরীতে আমি কিছুটা চুপাচাপ ধরণের।
এভাবেই রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো। সিলভানা হঠাৎ বলে উঠলো ‘লেটস গো টু দ্য বেড’। আমি চমকে উঠলাম। আড়মোরা ভেঙ্গে যেন লাফিয়ে উঠলাম। যেন কটেজের রুমের দিকে দৌড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে যেন কেউ চিৎকার করে উঠলো। ‘এই নীল, কয়টা বাজে? দুপুরের খাবার খাবা না?’
ওহ শিট। শুক্রবারের অলস দুপুর গড়িয়ে কখন বিকেল হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি এখনো। আমার স্ত্রী মেঘ ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠেই খাবারের জন্য তাড়া দিল। আমি এখন ডাইনিং টেবিলে বসে লক্ষ্মী ছেলের মতো খাবার বিকেলে দুপুরের খাবার খাচ্ছি। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে, তাইবি আইল্যান্ডের দ্য আটলান্টিক ওয়ানের খোলা বারান্দায়। আমি দৌড়ে যাচ্ছি কটেজের রুমের দিকে, সঙ্গে ভ্যালেন্তিনা সিলভিয়ানে, যাদুবাস্তবাতয় মিশ্রিত এক লাতিন উর্বসী।
পরের পর্ব আসছে….
আদাবর, ঢাকা
২ ডিসেম্বর, ২০২২
আপনার মন্তব্য লিখুন