অন্তর কথন

সাদামাটা

গা লি ব  স র্দা র

ই সৌমিক এই!
একটা বিড়ি দিবি মামা?
তোর আব্বু-আম্মু ভালো আছেন তো?
এই তুই কার ছেলে যেন?’
এই হলো রাকিব মামার ডায়ালগ। যেখানে যতবার আমার সাথে দেখা হয় ততবার সেই একই কথা। আমি বললাম, ‘মামা বিড়ি খাবেন কেন? বিড়িতো ভালো জিনিস না। সিগারেট কিনে দিই?’ মামা বললেন, ‘না। বিড়ি-ই ভালো। সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়।’ ‘কিন্তু মামা, বিড়ি খেলে ক্যান্সার হবেনা কে বললো আপনাকে?’ রাকিব মামা উদাস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘গরীবের ক্যান্সার হয়না।’ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমিও বিড়ি কিনে দিতাম আর চোদ্দবার করে বাপ-মা’র নাম সহ জীবন বৃত্তান্ত পেশ করতাম। এই হলো আমাদের রাকিব মামা। অনেকটা পাগলা কিসিমের। কখন কিভাবে তাঁর মাথা খারাপ হয়েছিলো সে ইতিহাস জানা নাই। তবে শুনেছি একসময় তাঁর মাথা ঠিকই কাজ করেছে। বহুকাল আগে নাকি বিএ পাশও করেছিলেন। আমাদের পাড়ায় যারা একটু বড়-সড় গড়নের (সবে গোঁফ-দাড়ি গজিয়েছে) তারা রাকিব মামাকে সময়ে অসময়ে যা ইচ্ছে তাই টাইপের জ্বালাতন করতো। রাকিব মামাকে অবশ্য খুব কমই রেগে যেতে দেখেছি। তবে দেখতাম কখনো কখনো প্রচন্ড রেগে গেলে একা একা বিড়বিড় করে হাত পা নেড়ে কি যেন সব বলতেন ইংরেজিতে। আড়ালে অনেকেই তাঁকে বলতো রাকিব ছিট। অথচ সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান সে। কিন্তু এখন দেখে তা বোঝার উপায় নেই মোটেও। পরনে সেই ময়লা জামা দিনের পর দিন। বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিল কিন্তু তাঁর কাপড় ধুয়ে দেয়ার লোকের অভাব ছিল বড়। তাকে ‘জাতীয় মামা’ বলা যেতে পারে। পাড়ার ছোট বড় সবারই সে মামা। আমার আব্বু-আম্মুকেও দেখেছি মামা ডাকতে। তবে এই ডাকটা নিয়ে রাকিব মামার মনে কোন ভাবান্তর হতো বলে মনে হয়না। এনজয় করতেন নিশ্চয় মামা ডাকটা।
আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা পুকুর ছিল আর পুকুরের ওই দিকটায় ছিলো রাকিব মামাদের বাড়ি। পুকুরটাও রাকিব মামাদেরই। অনেক মাছ ছিলো পুকুরটাতে। আমার তো আবার ছিপ দিয়ে মাছ ধরার নেশা কিন্তু মাছ ধরতে দেখলেই তো রাকিব মামার আব্বা অথবা ভাই তেড়ে আসবেন। কী আর করা! ছিপটা পুকুরের পাশের ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে মনমরা হয়ে ঘুরঘুর করতাম আর অপেক্ষা করতাম সুযোগের। রাকিব মামা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন আমার উদ্দেশ্য। উনি একদিন আমাকে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, সৌমিক তুই খুব ভালো ছেলে। মাছ ধর। কোন অসুবিধা নাই কিন্তু আব্বা বা ভাইয়া যদি চলে আসে তবে আমি তোকে ধমক দেবো বা দু’ একটা চড়-থাপ্পড়ও দিতে পারি। তখন তুই রাগ করিসনা আবার! তুই আর আমি অভিনয় করবো। ঠিক আছে? তার উপস্থিত বুদ্ধিতে তো আমি রীতিমত মুগ্ধ। মাছ ধরতে পারবো এই আনন্দেই আটখানা তখন আমি। চড়-থাপ্পড় খাওয়ার রিস্ক নিয়েই ছিপ নিয়ে বসতাম রোজ পুকুর পাড়ে। কিন্তু রাকিব মামার আব্বা বা ভাই আমাকে ঐ অবস্থায় দেখলেও কেন জানি কিছুই বলতেন না । অথচ অন্য অনেকেরই পিঠে ছিপ ভেঙ্গেছেন অবলীলায়। হয়তো রাকিব মামার জন্যই আমাকে কিছু বলতেন না তাঁরা।
একদিন আমি ছিপ ফেলে পুকুর পাড়ে বসে আছি। এমন সময় আমাদের পাশের পাড়ার এক পিচ্চিকে দেখছি যে, রাকিব মামাদের বাড়ির প্রাচীরের উপর উঠে পেয়ারা চুরি করছে আর রাকিব মামা নিচে দাঁড়িয়ে ওই পিচ্চিটাকে বকছেন। ওই পিচ্চি তখন রাকিব মামাকে বলছে, ‘চুপ করেন! চিল্লায়েন না। আপনাকেও দিবোহনি পিয়ারা।’ ঐ অবস্থায় রাকিব মামার মুখটা ছিল দেখার মত। সোজা বাংলায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ততক্ষণে পিচ্চিটা দুটো পেয়ারা রাকিব মামার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পগারপার। পেয়ারা দুটো নিয়ে রাকিব মামা আমার পাশে এসে বসলেন এবং খুব দুঃখ করে বললেন, ‘দেখলি সৌমিক, শালার বাচ্চা শালা কী বলে! আমারই গাছ আর আমাকেই বলে কি না চুপ থাকেন। আপনাকেও দিবো পেয়ারা।’ রাকিব মামার কথা শুনে আমি আর কী বলবো। আমারও মুখে তখন পেয়ারা যে। মনে মনে হাসি শুধু। আসলে পিচ্চিটা রাকিব মামাকে চিনতোনা।
সে যাই হোক, আর একদিন হয়েছে কি-সামিত, রাফী, সা’দ, দারদা, তালহা সহ আমরা অনেকেই পুকুর পাড়ে বসে আছি গোসল করার জন্য। প্রচন্ড শীত সে সময়। ঠান্ডার ভয়ে কেউই পানিতে নামার সাহস পাচ্ছিনা। শীতের মিষ্টি রোদে সবাই গা গরমে ব্যস্ত। নানান রকম গল্প গান গুলতানি- সবই চলছে বেশ চুটিয়ে। এমন সময় দেখলাম রাকিব মামাকে। ঘাড়ে তাঁর লুঙ্গি গামছা। তিনি বেশ ধীর লয়ে পুকুর পাড়ে বসে পানিতে এক পা নামিয়ে দিলেন এবং তার চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে ‘উহ্’ জাতীয় শব্দ করে পা উঠিয়ে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। আমরা ভাবলাম অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য বোধহয় রাকিব মামা আর গোসলই করবেন না। এমন সময় রাফী আর দারদা গিয়ে ডেবরীর দোকান থেকে মুড়ি-চানাচুর মাখিয়ে নিয়ে আসলো। চলতে থাকলো সবার মুখ। বেশ মজাই লাগছে। হঠাৎ কিছুক্ষণ পর দেখি রাকিব মামা আবারো হাজির। এবার হাতে তাঁর পানি ভর্তি বালতি। তিনি করলেন কি, বালতির সব পানি পুকুরে ঢেলে দিলেন। তারপর নিজে পুকুরে নেমে ডুব দেয়া শুরু করলেন। আমরা তো অবাক! হা করে তাঁর কীর্তি দেখছি। যিনি একটু আগেই ঠান্ডার ভয়ে গোসল বাদ দিয়ে চলে গেলেন আবার তিনি এখন দিব্যি ডুব মারছেন! কাহিনীটা কী? তখন আমাদের মধ্যে থেকে সামিত জিজ্ঞেস করল, ‘রাকিব মামা ঠান্ডা লাগছেনা?’ উনি বললেন,’একটু আগেও ঠান্ডা ছিলো। এখন আর নাই। বাড়ি থেকে এক বালতি পানি গরম করে এনে, দিলাম ঢেলে। ব্যস্! সব ঠিক। এখন হেবি্ব গরম। দারুণ লাগছে। তোরাও জলদি নেমে পড়।’ তাঁর এ কথা শুনে পুকুর পাড়ের প্রত্যেকের সে কী হাসি! আর আমাদের তো রীতিমত গড়াগড়ি খাওয়ার দশা। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমরাও দিলাম পুকুরে ঝাঁপ। সত্যি বলতে কী, একটুও ঠান্ডা লাগেনি আমাদের। জানিনা কেন! এরপর অনেকদিনই তাঁকে দেখেছি পদ্মার পানিতে কাপড় ধুতে। সে পদ্ধতিটাও বেশ অভিনব। ছোট এক কৌটা নীল নদীর পানিতে ফেলে দিয়ে কাপড় ধুয়ে ফেলতেন। অবাক হতাম দেখে। কত সরল জীবন যাপন ছিলো মানুষটার।
একদিন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। খেয়েদেয়ে রাতে শুয়ে পড়েছিলেন বিছানায় কিন্তু পরদিন তাঁর আর ঘুম ভাঙ্গেনি। সাদামাটা মানুষটার সাদামাটা প্রস্থান। আজ আর রাকিব মামা নেই, নেই সেই পুকুরও। সেখানে এখন ইটের উঁচু দালান। শেষ কবে পুকুরে গোসল করেছি অনেক চেষ্টা করেও তা আজ মনে করতে পারছিনা। আর পদ্মা নদী? আমাদের ছেলেবেলার মতো সেও বুঝি চলে গেছে রাকিব মামার হাত ধরে। নীরবে…

আপনার মন্তব্য লিখুন

Click here to post a comment