রঙের জীবন

শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ||  সুশান্ত কুমার রায়

পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায়­ সম্ভবামি যুগে যুগে।।(গীতা-৪/৮)

সাধুবৃত্তি সংরক্ষণের জন্য, দুষ্কর্ম্মনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই।

সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ ( গীতা-১৮/৬৬ )

তাই তুমি সমুদয় ধর্মাধর্ম্ম অনুষ্ঠানের বিচার পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বাত্মা পরমেশ্বরূপী আমারই শরণাগত হও। আমি তোমাকে সকল মায়ামোহ হইতে বিমুক্ত করিব; অতএব শোক করিও না। গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, আমি অজ ( জন্ম রহিত ) হওয়া সত্বেও জন্ম গ্রহন করি কিন্তু আমাতে জন্ম রহিত স্বভাব যেমন তেমনি থাকে। আমি অব্যয় (স্বরূপ সত্য) আত্মা হয়েও অন্তর্ধান হই। অর্থাৎ আমার তাতে নিত্য প্রকাশিত স্বভাবের কিছুমাত্র হানি হয় না। আমি সকল প্রাণী কূলের , সমস্ত জগৎ সংসারের ঈশ্বর বা প্রভু হওয়া সত্বেও অবতার রূপে যুগে যুগে আবির্ভূত হই। এই জগতে কোন কিছুই বেশি দিন স্থায়ী হয় না। রাম রাজ্যও কিছুদিন পরে স্বপ্ন রাজ্যে পরিণত হইল। রাজাগণ স্বেচ্ছাচারী হইয়া পড়িলেন। তাহারা পরস্পর কলহ করিয়া প্রজাগণের সর্বনাশ করিলেন । শাস্ত্রের নিয়ম উঠিয়া গেল, তাহার স্থানে নানা কুৎসিত লোকাচার প্রচলিত হইল। লোকজন অন্ধের ন্যায় সেই সব পালন করিয়া অধঃপাতে যাইতে লাগিল। বড় বড় পন্ডিত ও ধার্মিক লোক পর্যন্ত সেইসব নিয়মের হাত হইতে রক্ষা পাইলেন না। সমাজে, পরিবারে, ধর্মে মানুষের কোন স্বাধীনতা রহিল না। যুধিষ্ঠিরের মতো ধার্মিক লোক জুয়া খেলায় নিজের ভাই ও স্ত্রীকে টাকা কড়ির ন্যায় পণ রাখিয়া ছিলেন। সভামধ্যে রাণী দৌপদীকে উলঙ্গ করিবার চেষ্টা করা হইল। ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীম, অর্জুন একটু প্রতিবাদ করিবার সাহস করিলেন না। অথচ তারা ভারত বিখ্যাত বীর পুরুষ। যদু বংশীয়গণ মাতাল অবস্থায় এক অন্যকে বধ করিলেন। এইসব ঘটনার দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় সমাজে কি রকম দুরাচার বা অন্যায় অত্যাচার প্রচলিত ছিল। এসব সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা ও অত্যাচারীদেরকে দমন করিবার নিমিত্তে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের ত্রাণকর্তা হিসেবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে এ ধরাধামে আর্বিভূত হইলেন। ভোজ বংশে অভিজিৎ রাজা পুত্র আহুক খুব প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাহার দুই পুত্র ছিল- দেবক ও উগ্রসেন। রামকৃষ্ণের মাতা দেবকী দেবকের কন্যা। যদু বংশীয় বসুদেবের সাথে দেবকির বিবাহ হয়। উগ্রসেনের পুত্র কংস পিতাকে বন্দী করিয়া নিজে রাজ্যের রাজা হইলেন। তাহার কদাচার ও অত্যাচারে সকলেই অতিষ্ট হইল। দেবকীর বিবাহের সময় দৈববাণী হইল যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসকে বধ করিবে। কংস ইহা শুনিবা মাত্র দেবকীকে বধ করিতে গেলেন। বসুদেব অতিকষ্টে তাহাকে নারী হত্যা হইতে নিবৃত করিলেন এবং তাহার নিকট প্রতিজ্ঞা করিলেন দেবকীর সকল গর্ভজাত সন্তানকে তাহার হাতে অর্পণ করিবেন। তথাপিও কংস ভগিনী দেবকী ও ভগিনীপতি বসুদেবকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিলেন। বসুদেবের রোহিনী নামের আর এক পত্নী ছিলেন। বসুদেব ও দেবকী কারাগারে তাই রোহিনী অসহায় অবস্থায় স্বামীর পরম বন্ধু নন্দগোপের আশ্রয়ে ব্রজে ( গোকূলে ) বাস করিতে লাগিলেন। দেবকীর গর্ভে একে একে ছয় ছয়টি সন্তান জন্ম গ্রহন করিল। কংস জন্মিবামাত্রই তাদেরকে হত্যা করিলেন। সপ্তম গর্ভের সন্তান দৈব উপায়ে দেবকীর নিকট প্রেরিত হইল। সকলে জানিল যে, সপ্তম মাসে দেবকীর গর্ভ নষ্ট হইয়াছে। আর সেই সপ্তম সন্তানই রাম যা পরবর্তীতে গদাযুদ্ধে ভারকের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বলরাম হিসেবে পরিচিত হইয়াছিলেন। দেবকীর অষ্টম গর্ভে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহন করেন। বসুদেব অতিকৌশলে নন্দগোপের স্ত্রী যশোদার গর্ভজাত এক কন্যার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকে পরিবর্তিত করিয়া ফেলেন। শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহনের সময় একদিকে যখন প্রচন্ড ঝড়-বাদল তেমনি অন্যদিকে কারারক্ষী গভীর নিদ্রায় অচেতন, ঠিক সেই মুহুর্তে বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে কোলে করে গোকূলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণকে রেখে যশোদার গর্ভজাত কন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন। কংস যখন জানিতে পারিলেন দেবকীর অষ্টম সন্তান হয়েছে তখন তিনি আবারও হত্যা করিতে উদ্যত হইলেন। আর তখনই কন্যা সন্তানটি হাত থেকে খুলে শূন্যে গিয়ে দৈববাণী করিতে করিতে অদৃশ্য হইলেন।

ওরে নিবোর্ধ অত্যাচারী কংস
তোমারে বধিবে যে
গোকূলে বাড়িছে সে ॥

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শুধু কংসকেই বধ করিলেন না সেই সকল অত্যাচারীদের যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করিলেন এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ধর্ম সংস্থাপনের কাজ করিলেন। মানুষকে অত্যাচার ও গ্লানি থেকে শান্তির পথে এবং অধর্ম পরিহার করে ধর্মের পথে পরিচালিত করেছিলেন। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বরের অবতার নিত্য। এই জগৎ সংসার ভগবানেরই রূপ। তাই ভক্তের কাছে সাধ্য ও সাধন রূপেই ভগবানের অবতার।

 


আরো পড়ুনঃ তর্ণা চলে গেলে || শামীম আহসান


রঙ্গের জীবন/ অন্তরকথন ডটকম