পরিস্থিতি উন্নতির দিকে নয়, অবনতির দিকে চলছে। ডাক্তার যখন রোগীকে অভয় দিয়ে বললেন ভাবনার কিছু নেই, ওষুধগুলো নিয়মিত সেবন করলেই অবস্থার উন্নতি নিশ্চিত, আর রোগীর প্রতিনিধিদের আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন অবস্থা বেশি সুবিধার ঠেকছে না, তখন সকলেরই বুঝার বাকি রইলো না কান্ডটা কী ঘটতে যাচ্ছে।
এক বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে হার্ড—অ্যাটাক। তারপর প্রায় পঁচিশ দিন ছিলেন হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে ভর্তি হবার দুদিন পর। সেই থেকে আমতা আমতা করে কথা বলতেন এরফান সাহেব। ডাক্তারেরা চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না। শেষে ডাক্তারের পরামর্শেই তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হলো। প্রেসক্রিপশনে বেশ কয়েকটা দুষ্প্রাপ্য ঔষধের নাম লিখে দিলেন, আর বলে দিলেন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমের ব্যবস্থা করে দিতে হবে রোগীকে। দিনভর ইরফান সাহেবের ঘরের জানালাগুলো মোটা পর্দায় ঢাকা থাকতো আর রাতে ডিম লাইট ছাড়া কোন লাইট জালানো হতো না।
রোগীর জীবনের শেষ রাতের কথা উদ্ধৃতি করছি…
“মাহিয়াত, মাহিয়াত”
ডিমলাইটের আবছা আলোয় কাকার পাশেই ছিল মাহিয়াত। জি কাকা… আপনি এখনও ঘুমাননি! রাত যে অনেক হলো, সাড়ে বারোটা বাজে।
ঘুম যে আসছে না কিছুতেই। চোখ বন্ধ করতেই তোর বাবার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। ওহ কী বীভৎস সে মৃত্যু! কেন যে ডাকাতদের সাথে লড়তে গিয়েছিল! আমি আর তোর বাবা ছিলাম পাশাপাশি বয়সরে, মাত্র দেড় বছরের ডিফারেন্স। আমি করলাম লেখাপড়া, তোর বাবা করলো না। আমি এলাম শহরে, ভাইজান গ্রামে থেকে গেরস্থালির দায়িত্ব নিলেন। আমার লেখাপড়ার সকল খরচ তাকেই যোগাতে হতো। আমি কি পেরেছি আমার কর্তব্য পালন করতে…
কন্ঠটা মোলায়েম করে বললো মাহিয়াত— ওসব হিসাব—নিকাশ পরে হবে, ঘুমিয়ে পড়ুন কাকা। আপনার পা দুটা কি টিপে দেবো?
না, প্রয়োজন নেই বাবা। তুই বরং আমার মাথার পাশে এসে বস। ওরা সব গেল কই?
মাহিয়াত কাকার শিয়রের পাশে বসে— কাকি আর এমরান পাশের রুমেই আছে। ওরা খুব ক্লান্ত, বিশ্রাম নিচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেব? ঘুমিয়ে পড়ুন কাকা, নয়তো শরীর খারাপ করবে।
কাকা বিছানায় শুয়ে মাথাটাকে একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে— এসবের প্রয়োজন নেই। শরীর আর কত খারাপ করবে! তুইও তো কম পরিশ্রম করিসনি। ক্লান্তি লাগলে শুয়ে পড় গে…
না, ক্লান্তি লাগছে না। কাকার হাতের আঙ্গুলগুলোতে মেসেজ করতে করতে বলল মাহিয়াত।
মাহিয়াত, তুইতো এখন বড় হয়েছিস। আচ্ছা বলতো, মানুষ কেন টাকার পেছনে ছুটে? মানুষ কেন অর্থ—সম্পত্তির পেছনে ছুটে? এই অর্থ—সম্পদ তার কি কোন কাজে আসে মরনের পর। সাড়ে তিন হাত কবরটা ছাড়া কেউ কি বেশি কিছু নিতে পারে নিজের করে! তবে কেন এই দুনিয়াদারি নিয়ে ব্যস্ত থাকা!
মাইয়াতের মাথা নিচু। কাকার হাত দুটা টিপে দিতে দিতে বলল— কাকা, একটু শরবত করে দেই, খাবেন?
না, কিছুই মন চাইছে না। অনেক কিছুই তো করলাম জীবনে। গাড়ি—বাড়ি, টাকা—করি। মৃত্যুর পর বউ—সন্তান আত্মীয়—স্বজন পাড়া—প্রতিবেশী তা লুটেপুটে খাবে। কিন্তু নিজের জন্য কি করলাম! কবরের সাড়ে তিন হাত মাটি, সেও কি আমার! জানিস, মাঝে মাঝে কী মনেহয়?
মাহিয়াতের জানার কোন আগ্রহ নেই। তবে ইরফান সাহেবের ভাবটা এমন যেন বিষয়গুলো ভাতিজাকে জানাতেই হবে— মানুষ আসলে কী? রক্ত মাংস হাড়ের বহর। আচ্ছা মানুষের কোন জিনিসটা তার নিজের? রক্ত—মাংশের শরীরটা, নাকি প্রাণটা! নাকি কোনটাই না! হালকা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন ইরফান সাহেব— মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, জীবিত থাকতে পঁচে না কেন! তার মাঝে কী বিদ্যমান থাকে এমন শক্তিধর, যা দেহকে পঁচতে দেয় না! প্রাণ দেহকে সচল রাখে। আচ্ছা প্রাণটা আসলে কী? এটা কেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে! একে কেন ইচ্ছামত ধরা যায় না, ইচ্ছামতো ছাড়া যায় না! তাহলে মানুষের প্রাণটা কি তার নিজের নয়। সে কি দেহটাকেই ধরে রাখতে পারে? যেদিন দেহ থেকে প্রাণ চলে যায় সেদিনই কি দেহের পচন শুরু হয়ে যায় না? রক্ত পঁচে, মাংস—চামরা পঁচে, হাড় পঁচে। তাহলে মানুষের কঙ্কালটাও কি তার নিজের নয়! কঙ্কালটা নিজের না হলে যে কবরে কঙ্কালটা রাখা হয় সে কবরটাকে মানুষ কি করে নিজের বলে দাবী করে! আসলে মানুষের নিজের বলতে কিছু নেই।
মাহিয়াতের হাত চলা থেমে গেল। এক মিনিট নিরবতার পর কাকা আবার শুরু করলেন— জীবন তো একটাই। এই জীবনকে সুখকর করতে মানুষের কত প্রস্তুতি। কত মারামারি, কাটাকাটি, সংগ্রাম। অথচ একটা তুড়ি মারতে যতক্ষণ লাগে জীবনের ইতি ঘটে ততক্ষণও লাগে না। প্রাণ পাখির বিচরণ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, হাড়—কঙ্কালের শাখায় শাখায়। পাখি যখন উড়ে যায় দেহ ত্যাগ করে, তখন এর মূল্য কই! আমরা যে বাড়িটাতে বাস করি তার লাগি কত মায়া, কত মমতা। পাখিরে, তোর কি একটুও মায়া লাগে না দেহনীড় ছেড়ে যেতে? আত্মা কি কোনদিন তার ফেলে যাওয়া দেহটাকে ফেরত পেতে চায়? সে কি বুঝে কবরখানার গহ্বরে
যে কঙ্কাল পড়ে আছে, এটাতেই ছিল তার বিচরণ! এটাই ছিল তাঁর ফেলে যাওয়া নীড়। হয়তো নিজের বাড়ির ভোগ দখলের অধিকার হারিয়ে প্রাণ তখন প্রেতাত্মা হয়ে ঘুরে, আর দেওয়ালে দেওয়ালে মাথা ঠুকে। মানুষের যে দেহটা নিজের নয়, যে দেহটাকে নিজের করে রাখতেই পারে না, সেই দেহটার আরাম—আয়েশের জন্য কেন এত দুশ্চিন্তা! কেন এত ঝগড়া ফ্যাসাদ! মাহিয়াত, মাহিয়াত… ঘুমিয়ে পড়লি বুঝি?
কাকার ডাকে ঘুম ভাঙলো মাহিয়াতের— না, ঘুমাইনি। একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো আরকি। কাকা, অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ুন— বলতে বলতে হাই ছাড়লো সে।
ঘুম যে আসছে না চোখে। যন্ত্রণাটা বাড়ল বলে মনে হয়। আমি বুঝি আর বেশি দিন বাঁচবো না রে। আচ্ছা, যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় আমার। এমরান এখনও মাসুম বাচ্চা, ওকে নিয়ে তোর কাকি কেমন করে যে বাকি জীবনটা পাড়ি দেবে।
কি সব আবোল তাবোল ভাবছেন, আপনার কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি না, এমরানকে নিয়ে এত ভাবনা কিসের! — কাকার কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল মাহিয়াত।
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া কন্ঠে কথা বলছেন ইরফান সাহেব— তবু ভয় লাগে, যদি একটা কিছু হয়ে যায়। বাবা যখন মারা গেলেন, আমরা তখন ছোট। ভাগ্যিস তোর বাপ ভাঙন ধরা সংসারটার হাল ধরতে পেরেছিল। ভাইজান না থাকলে যে আমাদের কী অবস্থা হতো!
রাত তখন প্রায় তিনটা। ইরফান সাহেবের শারীরিক অবস্থা আরোও মন্দের দিকে। কে… কে ওখানে? ও, ভাইজান? আসুন আসুন, আপনাকে যে কোথায় বসতে দেই!— জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিলেন তিনি।
কাকা ও কাকা? কী সব উল্টাপাল্টা বলছেন?— কাকার গায়ে ঠ্যালা দিয়ে দিয়ে শুধালো মাহিয়াত। তার ধারনা কাকা হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
ভাইজান, আপনাকে কতদিন ধরে দেখি না! আসুন, আসুন। এতদিন কোথায় ছিলেন? আমাকেও নিয়ে যাবেন বুঝি, ভাইজান ও ভাইজান— বলতে বলতে ইরফান সাহেব হাত দুটিকে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে অন্ধের মত কী যেন খুঁজতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ লাইট নিভে গেল। বিদ্যুৎ চলে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা পরল সমস্ত বাড়িটা। ইরফান সাহেব প্রলাপ বকতে বকতে শান্ত হলেন। মাহিয়াত ভাবল কাকা হয়তো ঘুমিয়ে গেছেন।
রোগীর ঘর রাতে বাতি—বিহীন রাখতে নেই, তাতে অমঙ্গল হয়। লোডশেডিং—এর আধারে হাতরে হাতরে টেবিলের উপর থেকে ম্যাচ খুঁজে নিয়ে মোমবাতিটা প্রজ্জ্বলিত করল মাহিয়াত। ঘরের অন্ধকার কাটতেই দেখল কাকার নিদ্রা বরাবরের মতো স্বাভাবিক নয়, বালিশের পাশে ঘাড়টা কেমন ঝুলে পড়ে আছে।
কাকা, ও কাকা। ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে মাহিয়াত কাকার বিছানায় হুমড়ি খেয়ে কেঁদে উঠলো। পাশের ঘর থেকে কাকি আর এমরান ছুটে এসে কান্নায় শরীক হলেন। ততক্ষণে কাকার বুক পর্যন্ত ঢাকা চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
# হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।
আপনার মন্তব্য লিখুন