শারদ অর্ঘ্য : চিন্ময়ী
-সুশান্ত কুমার রায়
শারদীয় দুর্গাপূজা হিন্দু অর্থাৎ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রেষ্ঠ উৎসব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ মিষ্টি সুবাস, প্রকৃতির কোল জুড়ে কাশবনে সাদা কাশফুলের মনোরম শোভা, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, দুর্বাঘাসের ডগায় মুক্তোর মতো জমে থাকা শিশির বিন্দু নিয়ে শরতের প্রকৃতি সাজে অপরূপ। শরতের আগমনে শুভমহালয়ায় মহামন্ত্র শ্রীশ্রী চন্ডিপাঠে দেবীঘট স্থাপন ও ষষ্টীকল্পে বোধন অর্থাৎ মা দুর্গার আগমনের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়। মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশ্বমাতা দেবীদুর্গার দেবীপক্ষে বিজয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে পিতৃগৃহে আগমনে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের মহামিলনে মহাআনন্দের সাড়া পড়ে যায় সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালির ঘরে ঘরে । শারদীয় দুর্গোৎসব-১৪২৫ বঙ্গাব্দ উপলক্ষে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ লালমনিরহাট জেলা শাখার আয়োজনে সম্পাদক নিশিকান্ত রায় এর সম্পাদনায় শারদীয় সাহিত্য নিবেদন চিন্ময়ী। দেশে ও দেশের বাইরে অনেক খ্যাতিমান ও বরেণ্য লেখকের পাশাপাশি উদীয়মান তরুণ লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে চিন্ময়ী। নন্দিত চিত্রশিল্পী প্রমদ কুমার মহন্ত ও শ্রীগোপী সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে মা চিন্ময়ীকে মনের মাধুরি মিশিয়ে অলঙ্করণ-আভরণে ও আল্পনায় চিন্ময়ীকে যেভাবে রাঙিয়ে তুলেছেন তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য । সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার চিন্তা বা আরাধনাকে সহজভাবে উপলব্ধি বা চিন্তন থেকে সাকার উপাসনার সৃষ্টি। আর সেটিই হচ্ছে মুর্তিপূজা। তাই স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়- পুতুল পূজা করে না হিন্দু / কাঠ মাটি দিয়ে গড়া / মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে / হয়ে যাই আত্মহারা..। পত্রিকাটির শুরুতেই রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। ভক্তগণ ভক্তিসহকারে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের আশায় নিজেকে সমর্পন ও নিবেদন করে এক অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর / আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাইতো এতো মধুর..।।সম্পাদক নিশিকান্ত রায় সম্পাদকীয়তে লিখেছেন- ইতিহাসের পথচলায় দুর্গাপূজা আজ গণশিল্পের প্রতিমায় হয়ে উঠেছে সবার কল্যাণের উপাদান। পরিবার পরিজনের সম্মিলনে উৎসবের আলোয় অর্জিত প্রাণ শক্তিকে জাগিয়ে অশুভ সংকেত ও আসুরিকতা নির্মূলের প্রতিকী মঞ্চ শারদীয় দুর্গোৎসব। সম্পাদক সকলকে শারদ মেঘের কোমলতা ভরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ত্রিনয়না মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গাকে নিয়ে মাতৃশক্তির আবাহন শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন লে. কর্ণেল নিরঞ্জন ভট্টাচার্য (অব.)। সমাজে সকল অশুভ শক্তির বিনাসে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব। কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক বীরেন মুখার্জী শারদীয় দুর্গাপূজার তাৎপর্য নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক ও গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন। প্রচলিত শারদীয় দুর্গাপূজার উৎপত্তি প্রাচীন হিন্দুপুরাণে; বিশ্বমাতা ও বাঙালির আত্মজা শিরোনামে স্মরণিকা চিন্ময়ীতে দেবীদুর্গাকে নিয়ে রয়েছে দেশবরেণ্য কবি সরোজ দেব এর নিবেদন।
দূর শৈশব টেনে বের করে আনে ধুলো পড়া দিন। তখন একদিকে যেমন মরমী মায়ায় ধরা দেয় সেই দিনগুলি, তেমনি আর একদিকে সামনে এসে যায় একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে সময়ের চেহারাটা। সেই প্রকৃতি, সেই সকালবেলা শিউলির ঘ্রাণ কুড়িয়ে নেয়া, পায়ের নিচে শিশিরভেজা ঘাস,এগুলো হয়তো প্রাকৃতিক কারণেই অনেকটা একই রকম থেকে যায়। কিন্তু বাঙালির রুচি ও চিন্তাধারার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় বাইরের অনুষঙ্গগুলি। পাল্টে যাওয়া শিল্পবোধ আর আবহের সঙ্গে উৎসবের তাৎপর্য হয়ে যায় অন্যরকম। কিন্তু দুর্গাপূজা দিয়ছিল সাম্যের শিক্ষা। এ নিয়ে চিন্ময়ীতে লিখেছেন ওপার বাংলার খ্যাতিমান লেখক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিকাশের সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি ওতপ্রতোভাবে জড়িত। আমাদের মাটির মাঝেই প্রোথিত রয়েছে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতির বীজ। বাঙালি সংস্কৃতি: ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতির নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য। মা দুর্গার চালচিত্র যেন দুর্গাপূজার অন্যতম অনুষঙ্গ। রকমারি চালচিত্রের বৈচিত্রতার মাঝে তাঁর মধ্যে বহু দেবতার সমাবেশ কিন্তু আজও অমলিন। শিল্পীর রঙ তুলির টানে এই চালচিত্রের সুষমা যেন মায়ের মুর্তিকে আরো সম্পূর্ণ ও উজ্জ্বল করে তোলে। অথ চালচিত্র কথায় সুদূর কলকাতা থেকে এ বিষয়ে লিখেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। শারদীয় দুর্গোৎসব ও ঐতিহ্য চেতনা নিয়ে বিশ্লেষণমূলক বিমলেন্দু রায়ের লেখাটি তাৎপর্যপূর্ণ। শৈলেন্দ্র কুমার রায়ের প্রবন্ধ দুর্গাপূজা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা এবং আরও লিখেছেন নীল কমল রায় ও হেলাল হোসেন। মা দুর্গা জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেই তিনি দুর্গা। দুর্গা পৌরাণিক দেবী। আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভূজা, সিংহবাহনা, শক্তিদায়িনী, সৌভাগ্যদায়িনী, বিশ্বমাতা, জগৎজননী, মহিষাসুর মর্দিনী প্রভৃতি নামে এই জগৎ সংসারে ভক্তগণের নিকট পুজিতা। ত্রিনয়না বলে মা দুর্গাকে ত্রম্বকে বলা হয়। মা দুর্গার আবির্ভাব সম্পর্কে লিখেছেন প্রতিমা রায়। হিন্দুশাস্ত্রে রয়েছে বার মাসে তের পার্বণ। সময়ের পরিবর্তনে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই।বাঙালির দুর্গাপূজা: সেকাল-একাল নিয়ে লিখেছেন আশ্বিনী কুমার রায়। চিন্ময়ীতে আগমনী শিরোনামে লিখেছেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা বাংলা ক্যানভাস এর সম্পাদিকা ছবি মাইতি। মেডিটেশন ও ডোম সিরিজ কাব্য প্রনেতা গিরিশ গৈরিক এর দর্শন ও ফুল শিরোনামে কবিতা দুটি আলাদা রস আস্বাদন করবে নিঃসন্দেহে। ভারতের সুদূর ঝাড়খন্ড প্রদেশের ধানবাদ থেকে সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা সুতপার সম্পাদক দুর্গাপূজা নিয়ে কবিতা লিখেছেন রাজকুমার সরকার। দুর্গতিনাশিনীকে নিবেদন করে দূর হ অপছায়া প্রেতাত্মা শিরোনামে কবিতা লিখেছেন সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্প ভাবনার কাগজ এবং মানুষ সম্পাদক ও কবি আনোয়ার কামাল। গবেষক ও কবি গৌরাঙ্গ মোহান্ত ঢিবি কবিতায় চিন্ময়ীকে নিবেদন করে লিখেছেন- মার পাশে বিক্ষত শিউলি দাড়িয়ে থাকতো এক বিষন্ন প্রহরী; কলাপাতা সুর্যোকরোজ্জ্বল দিনে নাড়ু বানাতে বানাতে জাগিয়ে তুলতো শিউলি শ্বাসের প্রতিধ্বনি…..এভাবে মা মাটি, ফুল ও বৃক্ষ আমাদের চেতনার সুগুপ্ত দ্বীপে রচনা করে শুভ্র সৌধ…। ওপার বাংলা থেকে আরো লিখেছেন মন্দিরা ঘোষ, পাপিয়া চক্রবর্তী, রাহুল ঘোষ, বিদ্যুৎ রাজগুরু ও জয়ন্ত সরকার কুমার সুমন। কবিতা বিভাগে চিন্ময়ীতে বরেন্য ও খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ এর স্বপ্ন নব ভৌগলিক শিখা শিরোনামে ও অসীম সাহার কালের তুলিতে এক নতুন মাত্রা। এক অন্যরকম অনুভুতি জাগিয়ে তোলে।
কবিতা বিভাগে আরো লিখেছেন সাহিত্যিক মুকুল রায়, নরেন বাউল, ছন্দা দাশ, ফেরদৌসী বেগম বিউটি, সুশান্ত কুমার রায়, কবির বসুনিয়া, আল-মাসুদ হক মিঠুল, শশধর চন্দ্র রায়, পি.কে. বিক্রম, ধীরেন্দ্র নাথ বর্মন, বিভূ রায়, সুমন নারায়ণ, কুমার সুমন, সুস্মিতা সাহা, হেমালিনী রায় প্রতিক্ষা, মঞ্জুরুল হক এবং ছড়া বিভাগে লিখেছেন প্রিয়তমেষু তম, গোপাল রায় চৌধুরী ও মন্দিরা দত্ত । ওপার বাংলার কবি, সম্পাদক ও চিত্রশিল্পী চিন্ময়ীকে নিয়ে অন্তরাত্মায় শ্রীগোপীর কবিতাটিতে আম্রকুঞ্জন, শালবীথি, মাঙ্গলিক সন্ধ্যাধ্বনি এবং শরতে টুপটাপ শিশিরের শব্দে, মায়ের পূজায় ধূপ আর ফুলের সুবাসে অনাবিল আনন্দে উঠে এসেছে নাগরিক কোলাহল। সম্পাদক নিশিকান্ত রায় গল্প বিভাগে পিশি মা শিরোনামে এবং কবি ও ছড়াকার কঙ্কন রায় পূজোয় অতনুদের দল নিয়ে একটি চমৎকার গল্প উপহার দিয়েছেন। আপন আলোয় শুভ্র শোভন রায় অর্ক এর ছোট গল্পটি আমাদেরকে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যের শিক্ষা দেয়। দুর্গাপূজা নিয়ে আরো লিখেছেন কলকাতা থেকে বন্ধুত্বের কোলাজ শিরোনামে ড. অশোকা রায়। কিশোর ভাবনায় লিখেছেন অশেষ সাহা ও বিধুভূষণ চক্রবর্তী। দেশ, স্থান, কাল, পাত্রভেদে ধনী-গরিব, ছোট-বড় নির্বিশেষে দেশের সীমানা পেরিয়ে দুর্গাপুজা আজ সার্বজনীন আনন্দ-উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিক সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে এই শারদীয় দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে।
আপনার মন্তব্য লিখুন