জীবনের গল্প রঙের জীবন

বাদামওয়ালা-৯

স্বপ্ন দেখি স্বপ্ন দেখাতে পারিনা বড্ড ভয় হয় আজকাল। স্বপ্ন দেখতে ভালই লাগে তবে বেশীক্ষণ দেখা হয়ে উঠেনা অবাধ্য চোখের ঘুমটা হঠাৎ করে ভেঙে যায় তার সাথে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন গুলোও ও পরিসমাপ্তি ঘটে।স্বপ্ন দেখতে তো দোষের কিছু নেই ছন্নছাড়া…

পেটে ঘা ওয়ালা মানুষ বলে কি আমাদের স্বপ্ন দেখা বারণ হতেও পারে কেননা এই রাজ্যে স্বপ্ন দেখা অমূলকই বটে। নিজের স্বপ্ন গুলো নিজের মনের পুষে, রাখি কাউকেই বলিনা তাতে নিজেকে হাসির পাত্র বানানো থেকে অন্ততপক্ষে রক্ষা করা যায়। বাঙালি কে আমি ভাল করেই চিনি এরা এমন গ্রহের প্রাণী যারা খুব কমই মানুষের মঙল কামনা করে অন্যকে উৎসাহ দেয়া তো দুরের কথা পারলে এমন ভাবে চেপে ধরে সমালোচনা করে যাতে করে মনে সত্যিই আমি মানুষ কিনা?

মাঝেমধ্যে নিজেই নিজেকে চিমটি কাটি, হঠাৎ কেটে গেলে রক্ত গুলোর নিরহংকার বিসর্জন দেখি ওটাকে বন্ধ করার চেষ্টা করিনা ওখানেই খুঁজে পেতে চাই সত্যিই আমি মানুষ নামক প্রজাতির মাঝে পড়ি কিনা? অনেক ভেবেছি জানেন বহুবার মানুষই মনে হয়েছে তবে সেটা সংকীর্ণ জাতের মানুষ।
::
দোচালা টিনের ঘর, আগুন ঝরা ফাগুন মাসের তপ্ত রোদের ঝাঁজ। সেই শীত কাল থেকেই ফ্যানটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, এই টাকার অভাবেই ঠিক করা, যাচ্ছেনা। বেশ ঘামছি দর দর করে ঘাম পড়ছে, এই ঘাম গুলো একবার খেয়ে দেখেছিলাম বেশ লবণাক্ত প্যাকেট বলি আর খোলা লবণই বলি এই তিন ধরণের লবণের স্বাদ একই রকম লেগেছে। তবু দেখুন কতটা পার্থক্য আমাদের এই সমাজে।

প্যাকেট লবণ আর খোলা লবণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় একটা উচ্চবংশীয় আর একটা নিম্নবংশীয়। এদের ও জাত আছে মাঝেমধ্যে খুব হাসি পায়… লবণের উৎস তো একই তাহলে কেউ ল্যাংটা আর কেউ সাজসজ্জায় থাকলেই কি করে এটা দুই রকমের সমাদার পেয়ে থাকে।

অনেক ভেবেছিলাম যদি এমন কিছু বিক্রিয়া আবিষ্কার করতে পারতাম তাহলে এই মানুষ দের ঘাম গুলোকে সংগ্রহ করে পুনরায় লবণে রূপান্তর করতাম। স্বপ্ন তো স্বপ্নই জানি কখনো আমার মত বাদামওয়ালাকে দিয়ে সম্ভব নয়।

তবে অদুর ভবিষ্যৎ এ হয়তবা লবণের ঘাটতি মেটাতে এই সিস্টেমটাকেই বিজ্ঞানীরা বেছে নেয় কিনা ভাবছি।নিলে কিন্তু আশ্চর্য হবেননা বুঝে নিবেন এটা এই বাদামওয়ালার আইডিয়া চুরি করেছে নেহায়েত তাই ওদের আজ সফলতা।
::
বেশ আধাঘণ্টা হয়েছে ঘুম ভেঙে গেছে, একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার একটা ইট পাথরের বাড়ী আছে কি সুন্দর, তার, ডিজাইন। যেদিন থেকে আমি বাড়ীটার ডিজাইন করেছিলাম সেদিন থেকেই প্রায় প্রতিটি রাতেই আমি আমার স্বপ্নের বাড়ীতে অবস্থান করি। খাই ঘুমাই বৃষ্টির দিনে আর বৃষ্টির পানি পড়ে ঘুম ভেঙে যায়না, কাঁথা গুলোও, আর ভিজেনা শুকনা থাকে।

শীতের রাতে কুয়াশা ঢুকেনা থরথর করে আর আমি কাঁপিনা। কাঁথার বদলি পাঁচ হাজার টাকা দামের বিদেশী কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমাই। মা বাবাকে আর কষ্ট করতে হয়না, ঘরের ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে মা বাবাদের রুমে গিয়ে দেখে আসি তারা কি প্রশান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।

মাঝেমধ্যে ওনাদের মশারীটা ঠিক করে দেই যদিও এখন আর রুমে মশারা আসেনা গুড নাইট সারারাত ধরে বৈদ্যুতিক লাইনে কানেক্ট করাই থাকে। এখন আর টিমটিম করে জ্বলা কুপিতে মাকে রান্না করতে হয়না, বাড়ীতে বিদ্যুৎ এসেছে, বিদ্যুৎ চলে গেলে আইপিএস চলে আসে।

ধোঁয়ায় চোখ কচলাতে কচলাতে চোখের পানি ফেলে রান্না করতে হয়না, রান্নাঘরে রাইস কুকার, ইন্ডেকশন এসেছে। ভাঙা নলকূপটা নষ্ট থাকায় নোংরা পুকুরে আর আমাদের গোসল করতে হয়না। বাবা এখন চাইলেই রুমে বসেই ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে অজু সারতে পারেন।

খালি মাটির উপর বস্তা বিছিয়ে নামাজ পড়ার কষ্টটা আজ দূর হয়েছে বেশ দামী জায়নামাজে আরাম করে উনি নামাজ আদায় করেন। বিকেল বেলা বাবা এখন আর ভাঙা সাইকেল নিয়ে বাজারে যাননা, আমি রীতিমতো ওনার বাইকের পিছনে উঠি আর উনি ড্রাইভ করে আমাকে বাজারে নিয়ে যান আমি হাসি আর বলি বাবা একটু দেখে চালাও।উনি আমায় অভয় দিয়ে বলতো তোর বাবার প্রতি ভরসা রাখ বেটা। আমি থাকতে তোর কিচ্ছু হবেনা।

বাবার রাত আটটার বিটিভির সংবাদ দেখার নেশা এখন আর অন্যের দোকানে গিয়ে দেখতে হয়না নিজের বাড়ীতে বসেই রঙিন টিভিতে বেশ আনন্দের সহিত উপভোগ করেন। পুরো বাড়ীর মানুষ দের হাসি আর খুশি গুলো দেখলে আমার বড্ড প্রশান্তি লাগত।মনে মনে ভাবতাম আমি সাকসেস, আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ।

কিন্তু এমন স্বপ্ন গুলো হঠাৎ ভেঙে গেলে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারিনা। নিজে নিজেই কাঁদি স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বেদনায় মুষড়ে পড়ি এটা যে নিছকই স্বপ্ন কোন দিন যে পূরণ হবার নয়। এমন অলীক স্বপ্ন যে আমাদের মতো দুপয়সার বাদামওয়ালার দেখা অনুচিত।
::
ছেঁড়া ফাইল খুলে আমার স্বপ্নের বাড়ীর ডিজাইনটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। আজ এটাকে মুক্তি দিব। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট গুলো আজকাল আর নিতে পারছিনা। এই কাগজ থাকলে আরও বেশী মন খারাপ হয়ে যায়। তাই এটা নিঃশেষ করাই আমার কাছে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ছিঁড়তে গিয়েও ছিড়তে পারলাম না।

মানুষ নাকি স্বপ্নের সমান বড় হয়।বাবা বলেছিল মানুষ স্বপ্নে বাঁচে নিজের স্বপ্নটাকে টিকিয়ে রাখ অল্প করে হলেও নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করতে পারবে। বাবার মুখটা বার বার চোখে ভাসছে, না আমি আর ছিঁড়তে পারলাম না।তবু স্বপ্নটাকে বুকে আগলিয়ে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মনস্থির করলাম।
#নিচু তলার উকিল