কাজল রশীদ
কালো বোর্ডের ওপর সাদা চক দিয়ে সাজদার মাষ্টার লিখলেন, নির্নেয় উত্তর : লাবু = লতা = সাপ। এরপর ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিলেন; পর্তুগীজ জলদস্যু কলম্বাস উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছেও এমন হাসি হেসেছিলেন কীনা সন্দেহ!
অদ্ভুত এক মানুষ সাজদার মাস্টার, যার কোনটাই ঠিক অংকের স্যারদের সঙ্গে যায় না। নিয়মিত পাঠদানের বাইরে হঠাৎ হঠাৎ ভূতুড়ে সব কান্ড করেন। যা হয়তো বাংলার স্যার হলে অতটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়তনা, যতটা সাজদার মাস্টারের ক্ষেত্রে পড়ে। একে তো তিনি অংকের শিক্ষক তারপর এমন সব কান্ড করেন,যা প্রসাদগুণে বেশ আলোচিত ও উপভোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটা স্কুলে একজন ছিটগ্রস্ত শিক্ষক থাকেন, প্রত্যেকটা গ্রামে একটা ভূতের গল্প থাকার মতোই বিষয়টা নাকি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। অস্বাভাবিক হলো কাচারিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছিটগ্রস্ত শিক্ষকের কোটাটা পূরণ করেছেন অংকের শিক্ষক সাজদার হোসেন বিএসসিবিএড ওরফে পাগলা সাজদার।
সাজদার বিএসসিকে অনেকেই পাগলা সাজদার বলেন, অবশ্য সেটা আড়ালে আবডালে। বলার একটা কারণ কিন্তু রয়েছে। কারণ, দুজন শিক্ষকের একই নাম। সাজদার হোসেন বিএসসিবিএড ওরফে পাগলা সাজদারের মতো মেধাবি ও জনপ্রিয় শিক্ষক দ্বিতীয়জন না থাকলেও, শুধু একই স্কুলে একই নামে দুজন বিএসসি শিক্ষক থাকায় উনি পরিচিত হলেন ওই নামে। দিব্যদৃষ্টে যারা ভবিষ্যত দেখতে পান তাদের কেউ কেউ বলেন, অংকে যদি নোবেল পুরস্কার দেয়ার নিয়ম থাকতো তাহলে সাজদার মাষ্টার নাকি নির্ঘাত নোবেল পেতেন! এইট, নাইন আর টেনের অংকের ক্লাশ নেন। নীচের ক্লাশগুলো নেন না, নাকি হেডস্যার দেন না, তার নির্নেয় উত্তর আজোবধি অজ্ঞাত রয়েছে।
সাজদার মাস্টারের আজকের অংকটা একটা সিক্যুয়েল সমাধান অংকের মধ্যভাগ। প্রথম অংশটা করান এইটে, দ্বিতীয়টা নাইনে এবং তৃতীয়টা টেনে, তবে সেটা টেস্ট পরীক্ষার ডেট হওয়ার পর সবশেষ ক্লাশের দিনে। সেদিন জিজ্ঞাসা বোধক চিহ্নটা লোপ পায়। প্রথম ও দ্বিতীয়টায় থাকা জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্নের চূড়ান্ত মৃত্যু হবে ওইদিন, জানা যাবে একটা মহাজাগতিক অংকের সমাধান। মহাজাগতিক নামকরন অবশ্য সাজদার মাস্টারের স্বউদ্ভাবিত।
ক্লাশ নাইনের শিক্ষার্থী হওয়ায়, প্রথম দিনের অংকটা তাদের জানা। অংকটা ছিল, সমাধান করতে হবে নির্ণেয় উত্তর : লাবু = লতা =? আজকের সমাধান হলো, নির্ণেয় উত্তর : লাবু = লতা = সাপ।
সাজদার মাষ্টারের সমাধান অংকের প্রথম ধাক্কাটা শুরু হয় বিস্ময়করভাবে। প্রথম দিনের ক্লাশে উদ্ভট একটা অংক দিয়ে শিক্ষার্থীদের তাঁর সঙ্গে নবীণবরণ পর্ব উদ্যাপিত হয়। অংকটা হল, সমাধান করে বের করতে হবে; নির্নেয় উত্তর : ১ + ১ = ১
বোর্ডে লেখার পর তিনি মেঘগম্ভীর স্বরে নিজের পরিচয় দেন। সঙ্গে এও বলেন যে, প্রতিদিন তিনি সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে এলেও তাঁর পায়জামা-পাঞ্জাবী একটা নয়, তিনটা। আমার পাষাক নিয়ে সকলের বাজে রকমের কৌতুহল থাকায় আমিই তোমাদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার করে দিলাম, যাতে আগ্রহটা তৈরি হয় পড়াশুনা নিয়ে, আমার পোষাক নিয়ে নয়। ছেলে-মেয়েরা অবশ্য একবার একটা পরীক্ষা নিয়েছিল, তাতে সাজদার মাষ্টার গোল্লা পেয়েছেন, প্রমাণ হয়েছে তার পায়জামা-পাঞ্জাবীর সংখ্যা এক। পরীক্ষাটা প্রকাশ্যে এবং উভয়পক্ষের জ্ঞাতসারে না হওয়ায় নিশ্চিত হওয়া যায়নি, গোল্লাটা শিক্ষক না শিক্ষার্থীরা পেয়েছিল। কেননা, এমনও তো হতে পারে তিনি পোষাক নিয়ে পরীক্ষার বিষয়টা জেনে গিয়েছিলেন এবং সেটা বুঝতে না দেয়ার জন্য অন্য পায়জামা-পাঞ্জাবীও ফুটো করেছিলেন।
সাজদার মাস্টারের প্রথম দিনের ক্লাশে সমাধান অংকটা কালো বোর্ডের ওপর সাদা চক দিয়ে লেখা অবস্থায় দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা এতটাই ভিমড়ি খেয়েছিলো যে, এলিয়েন দেখলেও তারা এতটা বিস্মিত হতো কি না তা নিয়ে সন্দেহ উদ্রেক হওয়া সংগত। সাজদার হোসেন বিএসসিবিএডের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রথম সাক্ষাৎ বিস্ময় জাগানিয়া হলেও পরবর্তি ক্লাশে তারা ততটা ধাক্কা খায়না, যতোটা প্রথম দিন খেয়েছিল। যদিও সাজদার মাষ্টার মনে করেন, তিনি প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিস্ময় জাগ্রত করেন। একারণে প্রথমদিন থেকেই তিনি এ ব্যাপারে ক্লান্তিহীন থাকেন। ভাব-ভঙ্গি, কথা-বার্তা, পানচিবানো থেকে শুরু করে নায়কোচিত হাসি সমস্ত কিছুই অভিন্ন রয়ে গেছে।
আজ এই ভূতুড়ে সমাধান অংকটা যে হবে, শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই আচ করতে পেরেছিল। কারণ, প্রতি বছর বইয়ের সমস্ত অংক যেদিন শেষ হয়, ঠিক সেদিনই তিনি স্বউদ্ভাবিত এই সমাধান অংক নিয়ে হাজির হন। ক্লাশ এইটে এমনটাই হয়েছে, বড়দের কাছে থেকেও তারা বিষয়টা জেনেছে। নাইনের অংক শেষ হওয়ায় আজই যে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সেটা বুঝতে যেহেতু, আইনস্টাইন হওয়া লাগে না, তাই শিক্ষার্থীদের সবাই সেটা জেনে-বুঝেই অপেক্ষার ক্ষণ গুণছিল।
লাবু = লতা। এটা কার কার মনে আছে সাজদার মাষ্টার মেঘগম্ভীর স্বরে ভীষণ পুলকিত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই চুপচাপ। শুধু বিস্ময় নিয়ে তারা চোখ বড় বড় করে কান খাড়া করে রয়েছে। কারণ, তারা ভাল করেই জানে, এই সমাধান অংকের দিন সাজদার মাষ্টার একাই প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। গত বছরের সমাধান করার পর, পরের বছরের প্রশ্ন দেয়া হয়েছিল লাবু = লতা = ? আজ সেখানে বসেছে লাবু = লতা = সাপ। তার মানে পরের বছরের প্রশ্নটা হবে, সমাধান কর নির্নেয় উত্তর : লাবু = লতা = সাপ = ?
কেমন লাগছে অংকটা। সাজদার মাষ্টার জানতে চাইলেন। যথারীতি কেউ কোন উত্তর দিলনা, পেছনে থেকে একজন আস্তে করে বললো, মনে হচ্ছে ভূতের দেশে চলে গেছি, কথাটা শুনতে পেলেন না, বা শোনার চেষ্টাও করলেন না।
গাধার দল, জানি পারবি না। খামোখা জিজ্ঞেস করছি, তোদের পূর্ব পুরুষতো আর শূন্য আবিষ্কার করেনি, যে এই সমাধান তোরা করতে পারবি? গাধার দল।
গাধার দলই যদি হয়, তাহলে খামোখা কষ্ট করে এসব আমাদের বুঝিয়ে লাভ কী? পেছন থেকে একজন আস্তে করে বলল।
স্যার আপনার কততম পূর্বপুরুষ শুন্য আবিস্কার করেছিলেন? একেবারে পেছন বেঞ্চ থেকে একজন প্রশ্ন করল।
সাজদার মাষ্টারের এসবে যেহেতু বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই, তাই কিছুই তিনি শুনতে পেলেন না। অবশ্য এমনও হতে পারে তিনি সবই শুনতে পান বলেই না শোনার ভান করে থাকেন।
লাবু = লতা, এটা বুঝিয়েছি, নিশ্চয় মনে আছে? গাধার দল, মনে আছে ঘোড়ার ডিম। আমিই বলে দিচ্ছি। স্বগোতোক্তির মত বলা শুরু করলেন সাজদার মাস্টার।
ওর নাম ছিল লাবু। কিন্তু কেউ তাকে লাবু বলে ডাকতনা। তাহলে কী বলে ডাকত, কারও জানা আছে? জানি তোরা বলবি, লাবু না হলে নিশ্চয় লেম্বু বলে ডাকত। হা-হা-হা। না লেম্বু বলেও ডাকতনা। তাহলে কী বলে ডাকত? জানি তোরা বলবি লেমন বলে ডাকত। হা-হা-হা। তোদের যা ইচ্ছা বল। গাধার দল, তোদের সাথে তাল মেলালে হবে না। আমি সমাধানটা করার চেষ্টা করি। লাবুর অংকে আমরা দেখেছি লাবু হয়ে গিয়েছিল লতা। কারণ তার শরীর ছিল লতার মত। কেউ দেখলে, ভুল করে এমনটাও ভাবতে পারে, লাবুর বুঝি স্বপ্নই ছিল লতা হওয়ার। ঠিক অমলকান্তির মতো। লাবুর ভাগ্যটাও বোধহয় সেরকমই ছিল। যখন যা কিছু জড়িয়ে ধরে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চেয়েছে তখুনি একটা না একটা বিপদ এসে জুটেছে তার কপালে। তার ভবিতব্যই বুঝি অবলম্বনহীন হয়ে পড়ার। লতার মতো কিছু একটা ধরতে না ধরতেই পড়ে যায়। আবার লতিয়ে লতিয়ে চলে। নতুন করে ধরতে চায় কিছু একটা, ঠিক যেন সাপ-লুডু খেলার মত। মা-বাবা হারা এতিম লাবুকে সমাজও এতিম করে রাখে। দাদা-দাদীর বিয়োগ শৈশবে হওয়ায়, নানার বাড়ীতে জুটেছে আশ্রয়। কিন্তু আর দশটা ছেলের মতো যেন সে নয়। তার বুঝি মেরুদন্ডই নেই। কেমন যেন! স্কুলে পড়ার সময় স্যারেরা কোন কারণে তাকে বেত মারতে গেলে সে এমনভাবে স্যারের পা চেপে ধরতো যে, স্যার বেত মারার কোনরূপ সুযোগই পেতনা। আবার চড়-থাপ্পড় দিতে গেলেও সে শরীর বাঁকিয়ে এমনভাবে নিজেকে রক্ষা করতো যে, স্যার নির্ঘাত হেসে ফেলতেন। অথবা মায়াবোধ করতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলে এমনভাবে সালাম দিত কিংবা কুশল বিনিময় করতো, দেখে মনে হতো বাতাসে একটা লতা বুঝি দোল খাচ্ছে। মানুষ হয়েও কীভাবে যেন লতার জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল লাবু। মানুষের মাঝে বসত করে একসময় লতার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। অবশ্য এটা হল লাবুর জীবনের এপিঠ যেখানে আলো পড়েছে। অন্ধকার পিঠটার খবর নেই বলে জানা হয় না, লাবুই লতা হয়ে উঠেছিল, নাকি এই সমাজ ব্যবস্থা আর তার নিয়ন্ত্রকেরাই লাবুকে মানুষ নয়, লতা বানিয়েছিল। সমাজের এই বনসাই মনোবৃত্তির খবর না রাখলেও আমাদের এটা জানতে বেগ পেতে হয় না যে, একসময় সবাই তাকে লতা নামেই ডাকা শুরু করে। এমনকি লাবুও ভুলে যেতে বসে তার নিজের নাম। আর এভাবেই তার লতা নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়, বাবা-মার দেয়া অতি আদরের লাবু নামটি। আদর-সোহাগ-ভালবাসা বঞ্চিত লাবুর মেরুদন্ড থাকার পরও কেন মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়লো কেউ তা একটিবারের জন্যও ভাবল না। কেউ তাকে একটি বারের জন্যও কাছে ডেকে বললো না, লাবু কী হয়েছে? এরকমটা কেন হচ্ছে? তুই এরকম কেন হয়ে যাচ্ছিস। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর কেউই লাবুর লতা হয়ে ওঠার কারণ খুঁজে দেখল না, জানতেও চাইল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল, পঙ্গু মানুষ যেমন ধীরে ধীরে আরও পঙ্গু হয়ে যায়, লাবুও তেমনি লতা হতে হতে বাস্তবিক লতা সদৃশ হয়ে উঠল।
সাজদার মাষ্টার এইপর্যায়ে এসে একটা পজ দিলেন তারপর এমন একটা হাসি দিলেন, যা ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও হাসতে বাধ্য করল। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, গাধার দল লাবু তো তাও লতা হয়েছিল। তোরা কী হবি? লতা হওয়ার যোগ্যতাও তোদের নাই।
গাধার দলের সদস্যরা গাধা ছাড়া আর কী হবে? একজন বললো।
গাধার মাষ্টার তো, তাই যাই-ই বলা যাক শুনতে পান না। একজন বললো, গাধার মাষ্টার কিছু না বুঝেই হাসিতে যোগ দিলেন। তিনি মনে করলেন, লাবুর লতা হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা হর্ষোৎফুল্ল হয়েছে।
অংকের এই পর্যায়ে এসে, সাজদার মাষ্টার স্পষ্ট করে লিখলেন, লাবু = লতা, এটা সবার কাছে পরিষ্কার। ছাত্র-ছাত্রীরা কিছুই বললো না। অবশ্যই পরিষ্কার। পরিষ্কার না হওয়ার কী আছে? এখন জানতে হবে, লতা = সাপ, এই পর্বের সমাধান। লাবুরূপী লতাকে লাউডগা সাপের সাথে তুলনা করলে বেমানান হয় কী? নিশ্চয় না। এর মধ্যে আবার মানান-বেমানান? বরং সে লাউডগা সাপ হতে পারলে, ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে ডুগডুগি’ গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিত।
এরই মাঝে লাবু ভিন্নধর্মী এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। বৈশাখ মাসের এক দুপুরে নানার বাড়ীর পাশের বাঁশ ঝাঁড়ে সে উঠে আপন মনে গান গাইছে। হঠাৎ খেয়াল করে একটা সাপ পুবপাশের খাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। সাপের চলাটা ওর কাছে বড়ই অদ্ভুত মনে হয়। যেন একটা লতা, মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা পাখি এসে জড়ো হয়, এবং সাপটাকে বিরক্ত করতে থাকে। সাপটা যেদিকে যায়, পাখি গুলোও ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে কিচিরমিচির করতে থাকে। সাপটা পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু পাখিদের কারণে পালাতে পারছে না। কোথা থেকে একটা কুকুর এসে জড়ো হয়। সাপটা তখন অসহায়ের মতো দৌড় লাগায়। কিন্তু পাখি আর কুকুরের জ্বালায় পারে না। পরিস্থিতি যখন একেবারেই বেগতিক সাপটা তখন অদ্ভুত এক কাজ করে। ফনা ওঠায় এবং যুদ্ধংদেহী আচরণ করতে থাকে। লতার মতো একটা সাপ এরকম সাহসী ভঙ্গিতে ফনা ওঠাতে পারে লাবুর বিশ্বাসই হয় না। সাপের ফনা তোলায় এবং তা দেখে কুকুরের ভড়কে যাওয়া দেখে, বাঁশঝাড়ের মাথা থেকে লাবু যতটা বিস্মিত হয় ঠিক ততোটা ভয় পায়না। কারণ এরকম অভিজ্ঞতা এর আগে কখনই হয়নি। সাপ দেখেছে কিন্তু সাপের এই রূপের সাথে পরিচয় নেই। ওদিকে লাবুর চেয়েও বিস্ময় আর ভয়ে থমকে দাঁড়ায় কুকুর আর পাখিরা, তবে তা ক্ষণিকমাত্র। কিন্তু ওই বিস্ময়ের ফাঁকে সাপটা এক নিমিষেই গর্তে ঢুকে যায়। কুকুরটা কিছুক্ষণ গর্তের মুখে আঁচড় পাঁচড় করে, পাখিরা গর্তের ওপর ওড়াউড়ি করে তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
লাবু মুহুর্তের মধ্যে ঘরে ফেরে। কাউকে কিছু বলেনা। সেই রাতে তার ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ছোটখালা লাবুকে পানি পট্টি করে দেয়। লাবু জ্বরের মধ্যে আবোল-তাবোল বকে। সাপ দেখার ঘটনাটাও বলে। ছোট খালা ততোটা গুরুত্ব দেয় না, আর দশটা গল্পের মতোই মনে করে। লাবুর জ্বর প্রায় দশ-বারোদিন থাকে। জ্বর থাকা অবস্থাতেই তার মেট্রিকের রেজাল্ট বেরোয়। পাশ করেছে এই যা। সবাই বলে কোন একটা কাজের মধ্যে ঢুকতে। কারণ লাবুর যা বয়স, এতদিনে তার ডিগ্রী পড়ার কথা ছিল। একারণে লাবুর ইচ্ছা একটা চাকরিতে ঢোকা, তারপর যদি সম্ভব হয়, পাশাপাশি পড়াশোনা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু নিয়তি লাবুকে নিয়ে যায় অন্যপথে।
কাচারীপাড়া গ্রামে এক সাহেব গোছের একজন মানুষ আসে। বেশ ভাল ভাল কথা বলেন তিনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, সবার সাথে মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহার করেন, গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে আদর করেন। গল্প করেন-গল্প শোনেন। লোকটা কার কে ঠিক পরিষ্কার করে জানাও হয় না। তিনি বলেন, এই গ্রামের জয়নাল তার আত্মীয়। অথচ জয়নালের এই আত্মীয়ের কথা এর আগে কেউ কখনো জানতেও পারেনি। লোকটার সাথে একদিন নদীর পাড়ে অনেকক্ষণ কথা হয় লাবুর। সে সাপ দেখার ঘটনাটাও লোকটিকে জানায়। লোকটি অবাক করে দিয়ে লাবুকে বলে জানো ব্যাটা, তোমারও ফনা আছে। চাইলে তুমিও ফনা তুলে অন্যকে ভয় দেখাতে পারো। এমনকি ছোবল দেয়ার ক্ষমতাও তোমার আছে। কিন্তু সেটা আবিস্কার করতে হবে। সাপ কখন ফনা তুলেছে দেখেছো তো।
লাবু এ কথার আগামাথা কিছুই বুঝে না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
তুমি যাবে আমার সাথে? লোকটি লাবুকে প্রস্তাব দেয়।
লাবু হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারে না। শুধু বলে, নানা-নানী।
তাদের রাজী করানোর দায়িত্ব আমার। আমি গিয়ে কি করবো?
পড়াশুনা করবে?
তাহলে আমাকে রেখে আপনার কী লাভ?
পড়াশুনার পাশাপাশি, আমি যা বলবো তাই করবো।
সেসব কী?
সেসব গেলেই দেখতে পাবে। এখন বলো যাবে কী-না?
লাবু রাজি হয়ে যায়। লোকটি পরদিন অনেক কিছু কিনে নিয়ে নানা-নানীর সামনে হাজির হয়। ছোটখালার জন্যও একটা শাড়ি নিয়ে আসে। ওগুলো তাদের হাতে তুলে দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে। আর ওই ফাঁকে লাবু রেডি হয়। তারপর অন্য এক অজানা পথে পাড়ি জমায় লাবুরূপী লতা।
সাজদার মাষ্টার দেঝে ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। ছাত্রদের মনোভাব পরীক্ষা করার জন্য তিনি শুধু বললেন, আজ এই পর্যন্ত থাক।
সবাই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল না না না। তারপর কী হলো বলেন স্যার, প্লিজ।
গাধার দল মুখ খুলেছে।
নতুন ঠিকানায় গিয়ে লাবু দেখল, সে যেখানে আছে, তার মতো বয়েসী আরও কয়েকজন সেখানে থাকে। জেলা সদর থেকে একটু ভেতরে জায়গাটা। একটা এতিমখানার নামে প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত হলেও এখানে নানাধরনের কাজ হয়। আর ওই ভদ্রলোক সবার কাছে ‘মিয়াভাই’ হিসেবে পরিচিত। লাবুও তাকে মিয়াভাই বলে ডাকতে শুরু করে। তিনি লাবুকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি করে দেন। সেখানে মিয়া ভাইয়ের পরিচিত আরও কয়েকজন পড়ে, এমনকি লাবু যেখানে থাকে, সেখান থেকেও দশ-বারোটা ছেলে ওই কলেজে পড়ে। লাবু নানা-নানীর কথা প্রায় ভুলে যেতে বসে। প্রথম প্রথম মন খারাপ হলেও এখন আর হয় না, তবে ছোটখালার কথা খুব মনে পড়ে। মিয়াভাই নাকি মাঝে মাঝে গিয়ে নানা-নানীর খোঁজ নেয়, এটা-ওটা কিনে দেয়। ছোটখালা প্রথম প্রথম চিঠি লিখতো তখন এসব জানালেও এখন আর কিছুই জানায় না। সম্ভবত লাবু নিয়মিত চিঠি লেখেনা বলে, রাগ করে ছোটখালাও লেখেনা।
লাবুদের কলেজে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পুরো কলেজ জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে মিয়া ভাই লাবুকে জানায়, যে কোন মূল্যে অনুষ্ঠান পন্ড করতে হবে। প্রিন্সিপাল যদি সোজা পথে রাজি না হয়, তাহলে আঙুল বাঁকা করতে হবে। লাবু কারণ জানতে চায়। মিয়া ভাই চোখ বড় বড় করে তাকান।
কারণ জানাটা কি খুব জরুরি। আমি বলছি মনে করো এটাই কারণ। মিয়া ভাই বলেন।
লাবু চুপ করে থাকে।
পরদিন কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়াকক্ষে লাবু যা করে তা সিনেমার গল্পের মতো মনে হয়। পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে তিন রাউন্ড ফাকা গুলীবর্ষণ করে। সবাই যে যার মতো দৌড় লাগায়। লাবু সোজা প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে চলে যায়। পিস্তল হাতে তার নাতির বয়সী ছেলেকে আসতে দেখে তিনি শুধু ভীত সন্তস্ত্রই হোন না, বিস্মিত হন। লাবু পিস্তলটা স্যারের টেবিলে ওপর রাখে।
মিয়া ভাইকে অনুষ্ঠানের অতিথি করতে হবে, তা না হলে অনুষ্ঠান বন্ধ। প্রিন্সিপাল স্যারের চোখে চোখ রেখে লাবু বলে।
প্রিন্সিপাল স্যার কিছুই বলেন না।
এই ঘটনার পর কলেজের সবার মুখে মুখে লাবুর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া লাবু যেন একদিনেই ফাইনাল ইয়ারের বড় ভাইয়ে পরিণত হন। সবাই লাবুকে সমীহ করে চলতে শুরু করে। দু’এক সপ্তাহ পর পরই প্রিন্সিপাল স্যার লাবুর খোঁজ-খবর নেন, রুমে নিয়ে চা-নাস্তা খাওয়ান। এই শহরে মিয়া ভাইয়ের সঙ্গে লাবু যেদিন প্রথম ঢুকেছিল সেদিন ছিল একটা লতার মতো। আর আজ সে লতা নয়, এখন লাবুরূপী সেই লতা হয়েছে ফনা তোলা এক সাপ, যার সামনে কেউ দাঁড়ানোর সাহস পায় না। শুধু ব্যতিক্রম মিয়া ভাই। তিনি যা চান লাবু সদা তাই করতে প্রস্তুত। মিয়া ভাইয়ের চোখের ইশারায় লাবু গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করে মারা যেতে পারে, বাঘের দুধ এনে সকাল-বিকার মিয়া ভাইকে গোসল করাতে পারে। শুধু লাবু না, মিয়া ভাইয়ের সঙ্গে যারা রয়েছে তারা সবাই তাঁর ইচ্ছা পূরণে ব্যাকুল। তবে এদের মধ্যে লাবু রয়েছে এক নম্বরে। কারণ মিয়া ভাই তাঁকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন।
এরই মধ্যে অবিশ্বাস্য এক কান্ড ঘটে। লাবুরা যে এতিমখানায় থাকে সেখানে এবং তার আশেপাশের এলাকায় পুলিশ তল্লশী চালায়। মিয়া ভাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র সহ গ্রেফতার হয়। লাবু পুরো ঘটনায় মুষড়ে পড়ে। কি করবে ভেবে পায় না। এতদিন যা কিছু হয়েছে, সবটাই হয়েছে মিয়া ভাইয়ের নির্দেশনা মতো। এখন কে তাকে নির্দেশনা দেবে? এসব ভাবতে ভাবতেই, লাবুকে অবাক করে দিয়ে পরদিনই জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন মিয়া ভাই। লাবু অথৈ সমুদ্রে আশার আলো দেখতে পায়। মিয়া ভাই লাবুকে নিয়ে বসে। আগামীর পরিকল্পনা করেন।
যে মরতে জানে, বাঁচার অধিকার কেবল তারই আছে। মিয়া ভাই বলেন।
কী করতে হবে বলেন। লাবু ড্যামকেয়ার ভঙ্গিতে জানতে চায়।
আগে শুনতে হবে, তারপর তো করা।
কেন শুনবো? আপনার কোন কাজেই তো না নেই তাহলে খালি খালি শুনে সময় নষ্ট করবো কেন?
আমি জানি। মিয়া ভাই বলেন।
এতিম খানায় অন্যায়ভাবে পুলিশী তল্লাশীর প্রতিবাদে পরশু শহরে হরতাল দিতে হবে। এবং যেকোন মূল্যে হরতাল সফল করতে হবে। আর এজন্য যদি লাশ ফেলতে হয়, তাহলে তাই করতে হবে। মিয়া ভাই এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলেন, যা কথা নয়, কমান্ডের মতো শোনায়। সবশেষে লাবুর কানে কানে কী বলেন সেটা জানা যায় না।
পরদিন পুরো শহর পোস্টারে ছেয়ে যায়। ‘অন্যায় পুলিশি হয়রানী বন্ধ কর, করতে হবে।’ হরতাল শুধু সফল হয় না। কয়েকটি জায়গায় হরতাল বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং মিয়া ভাইয়ের প্রত্যাশামতো হরতালে লাশও পড়েছে। জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে হরতাল সফল হওয়ায় মাইকিং করে শহরবাসীকে ধন্যবাদ জানানো হয়। কেউ না জানলেও লাবু নিজে জানে হরতালের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটিয়েছে কে। নিজে বোমা ছুঁড়ে মেরেছে নিজেদের গ্রুপের একটা ছেলের ওপর, যে ক’দিন ধরে মিয়া ভাইয়ের মুখের ওপর কথা বলছিল। মিয়া ভাইয়ের যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছিল। মিয়াভাইয়ের সেদিনের পরিকল্পনায় কানে কানে বলা বক্তব্য ছিল এটাই। লাবু দেখল একঢিলে দুই পাখি মারার কৌশলটা মিয়া ভাই কত সহজেই তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। হরতাল হলো, পুলিশকে একটা সতর্ক বার্তা দেয়া গেল এবং নিজের গ্রুপের মাথাচাড়া করা একজনকে শায়েস্তা করা হল, যা গ্রুপের সবার জন্য একটা সবক হিসেবেও আগামীতে কাজে দেবে। সুতরাং, একজন পান্নার মৃত্যু অনেকগুলো বার্তার সুযোগ তৈরি করল। যার মধ্যে একটা বার্তা কেবলই লাবুর নিজের জন্য। যাতে তার মনে হল, লতারূপী লাবু এখন সাপে পরিণত হয়েছে। সাপের মতো দংশন করার ক্ষমতা তারও রয়েছে। তার দংশনেই হরতালের চাদরে নীলকণ্ঠ পাখি হয়েছে পান্না। তারপরই তার মনে হলো সে লাবু নয়, লতা নয় সে একটা সাপে পরিণত হয়েছে? সেই সাপটা, যার ফনা তোলা দেখে ভয় পেয়ে কুকুর পর্যন্ত পিছু হটেছিল।
সাজদার মাষ্টার অংক করতে এতটাই মশগুল যে, কখন ঘন্টা পড়েছে তার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদেরও আজ ক্লাশ থেকে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। সবাইকেই যেন সাজদার মাষ্টাররূপী হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালায় পেয়েছে আজ।
গাধার দল তাহলে কী দাঁড়াল?সাজদার মাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন।
ছাত্র-ছাত্রীরা কোন উত্তর দিল না।
অতএব, নির্নেয় উত্তর : লাবু = লতা = সাপ। সাজদার মাষ্টার বললেন।
ছাত্র-ছাত্রীরা জানে আজকের অংকের মধ্য দিয়ে শেষ হল মহাজাগতিক সমাধানের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব। আর নতুন করে শুরু হল তৃতীয় অর্থাৎ শেষ পর্বের জন্য অপেক্ষা, যেখানে প্রমাণ করতে হবে, নির্নেয় উত্তর লাবু = লতা = সাপ = ?
সাজদার মাষ্টার এবার মুখ নয় দ্রুত চক চালাতে শুরু করেন।
মনে করি, লাবু = X লতা = Y এবং সাপ = Z.
আমাদের প্রমাণ করতে হবে, X = Y = Z
দপ্তরি এসে তাড়া দেয় স্যার, সবাই চলে গেছেন, স্কুল বন্ধ করতে হবে।
সাজদার মাষ্টার লজ্জিত ভাবটা আড়াল করে বলেন, ওকে, সবাইতো বুঝেছ। তাহলে এটাই তোমাদের হোমওয়ার্ক।
হোমওয়ার্ক?দেখবেন কবে স্যার? ছাত্র-ছাত্রীরা একযোগে জানতে চাইল।
টেস্ট পরীক্ষার আগে, তোমাদের সাথে যেদিন আমার শেষ ক্লাস হবে। তারপর তোমরা চলে যাবে কলেজে, আর আমি সাজদার হোসেন বিএসসিবিএড পড়ে থাকব কাচারিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
স্যার, সেদিন কি জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্নের সমাপ্তি ঘটাবেন, নাকি আবার হোমওয়ার্ক দিবেন? একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করেন।
হ্যা হোমওয়ার্ক দেব, তবে সেই হোমওয়ার্ক কখনো আর নেয়া হবে না। সাজদার মাস্টারের কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে।
স্যার স্কুল বন্ধ করতে হবে, দপ্তরি আবারও তাগাদা দেয়।
সাজদার মাষ্টার হাতের ঘড়িতে চোখ রাখে। তারপর কোন কারণ ছাড়াই হেসে ওঠে। যে হাসির অর্থ শুধু তিনিই জানেন, ছাত্র-ছাত্রী কিংবা দপ্তরি কেউই সেই হাসির অর্থ অনুবাদ করার যোগ্য নয়। যেমন যোগ্য নয় তারা নির্নেয় উত্তর, লাবু = লতা = সাপ = ? এই সমাধান অংক প্রমাণ করার।
আপনার মন্তব্য লিখুন