সদ্যপ্রয়াত টনি মরিসনের এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জনের পরপরই বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে। তার প্রয়াণে শ্রদ্ধার্ঘ স্বরূপ বিডি আর্টসের পাঠকদের জন্য পুনর্মুদ্রণ করা হলো। বি. স.
সাক্ষাৎকার গ্রহীতা:রোজমারি কে. লেস্টার
বাংলা অনুবাদ: রাজু আলাউদ্দিন
টনি মরিসন জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকায় ওহাইও অঙ্গরাজ্যের লোরেইন-এ ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ সালে। আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার দিনগুলোয় মরিসন ওহাইওতে ১৯৪৯ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে মিরসন বিএ ডিগ্রি গ্রহণ করার পর কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। এখানেই ভার্জিনিয়া উলফ ও উইলিয়াম ফকনার-এর লেখায় আত্মহত্যা বিষয়ে গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করে তিনি এমএ ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর টেক্সাসের সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছর শিক্ষকতা করে যোগ দেন হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেন এবং এই সময়েই তিনি জ্যামাইকান এক স্থপতিকে বিয়ে করেন। যদিও মরিসনের বিয়ে খুব বেশিদিন টেকেনি। ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস The Bluest Eye, Sula এবং Song of Solomon. অনুদিত এই সাক্ষাৎকারটি প্রথম গৃহীত হযেছিল পশ্চিম জার্মানির ফ্রাংকফুট-এ ‘হেসিয়ান রেডিও নেটওযার্ক’-এর পক্ষ থেকে রোজমারি কে. লেস্টার কর্তৃক ১৯৮৩ সালের বসন্তে।
লেস্টার: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সম্পাদক, সন্তানের মা এবং কেবল গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মেরই নয়, এমনকি সমকালীন জটিল সব বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধের রচয়িতা টনি মরিসন– এগুলোর কোনটিতে আপনার পক্ষপাত এবং কেন?
মরিসন: কারোর জীবনকে বিভিন্ন খোপে ভাগ করা আর এগুলোকে পরস্পর-বিরোধী হিসেবে বিবেচনা করাটা আমার কাছে ভুল মনে হয়। আমরা এমনভাবে ভাবতে শিখেছি যে, সব সময়ই হয় এটা নয়তো ওটা আমাদের বেছে নিতে হবে। কোনো কাজ আলাদাভাবে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত– এ রকম ভাবাও আমর কাছে ক্ষতিকর মনে হয়। কারোর যদি কোনো পেশা নাও থাকে, তবু সংসারে তার অনেক কিছুই করার আছে। সবকিছু এক সাথে হচ্ছে ভাবাই তো গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃত্ব বা পেশার মাঝামাঝি আমার পছন্দ করার কিছু নেই– এটাই আমি ভাবতে চাই। আমি এর সবগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশ সুন্দর হিসেবে বিবেচনা করি।
লেস্টার: দুটো ছেলেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন নারীর বিশেষ কোনো সমস্যা আছে কি?
মরিসন: হ্যাঁ, নারী এবং পুরুষ কিংবা ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তানের মধ্যে যে পার্থক্য, যা এই মুহূর্তে স্পষ্ট হযে উঠেছে– এ ব্যাপারে আমি সজাগ ছিলাম না। আমার ছোট দুই ভাই ছিল, তখন ভাবতাম যে, আমি বেশ দক্ষ কিন্তু বাচ্চাদের কী শেখানো দরকার, বিশেষ করে একজন মা হিসেবে সে ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ ধারণা ছিল। আমি ভাবতাম বাবা এবং মা দুটোই আমার হওয়া উচিত, কিন্তু তা মোটেই হওয়ার নয়। আমি দক্ষ বাবা ছিলাম না বটে; তবে উপার্জনের সামর্থ্যরে কথা ভাবলে একজন ভালো পরিবার-প্রধান ছিলাম। পরে আমি লক্ষ করলাম (ওদের জন্য হয়ত একটু দেরিই হয়ে গেছে), যে আপনি যা শুধু তাই হতে পারেন, আপনার যা আছে তাই কেবল দিন, এছাড়া তো আপনি আর কিছু দিতে পারেন না। বাইরে থেকেও তাদের শিখতে হবে। ছেলে হিসেবে আমার সন্তানরা এমনভাবে বিপদ ও ঝুঁকির প্রতি আকৃষ্ট ছিল যা আমার বেলায় ঘটেনি। আমার কিংবা বাচ্চা মেয়েদের তুলনায় ওদের চাহিদা ছিল ভিন্ন ধরনের। এই বাচ্চাগুলো গোটা বাড়িটাই গিলে ফেলতে চাইত। মায়ের কাছে ওদের চাওয়াগুলো ছিল অবুঝ ধরনের। আমি কি ধরনের মানুষ, এ নিয়ে ওদের কোনো মাথা ব্যথাই ছিল না। ওদের ভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই ওরা চাইত আমি যাতে ওদের প্রতি মনোযোগ দেই, কথা বলি এবং ওদের কাজগুলো করে দিই। ওরা একেবারেই ভিন্ন ধরনের অন্তরঙ্গতা দাবি করত যার সবটাই ছিল খুব অদ্ভুত। আমার মেয়ে নেই, থাকলে সম্ভবত ওদের সম্পর্কেও আমি একই রকম বিস্ময়কর কিছু বলতে পারতাম। মজার ব্যাপার হলো এই যে, আমি যখন সলোমানের গান লিখছি, তখন দেখলাম, ছেলে দুটো আমার কাজে লাগছে। কারণ ওদের বেড়ে ওঠা লক্ষ করার ফলে, মনে হলো পৃথিবী সম্পর্কে, পুরুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ দেশ এবং মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা- আমি এর গভীরে ঢুকে যেতে পারছি। আমি বেড়ে উঠেছিলাম কঠোর নিয়মের মধ্যে। আমরা ছিলাম খুবই শান্ত স্বভাবের, সব ধরনের নির্দেশই মেনে নিতাম, সহজেই কোনো আদেশ করতে পারতাম না যা আমার বাচ্চারা পারে। এ সবই প্রচলিত এবং সাধারণ ব্যাপার। নারী আর পুরুষের মধ্যে একাধিক পার্থক্যও আছে, তবে পুরুষত্ব বনাম নারীত্বের ধ্রুপদী সংজ্ঞার কথা যদি ভাবেন তাহলে সেখানে কর্তৃত্বের প্রশ্নটি থাকবেই।
ছবি: দুই ছেলের সঙ্গে টনি মরিসন
ওদের খেলাধুলার সময় আমি ওদের লক্ষ করছিলাম আর তখন লিখছিলাম সলোমনের গান যেটির প্রধান ভূমিকায় রয়েছে কযেকটি পুরুষ চরিত্র। এই বইয়ের ভাষাকে আমার অনেকটা বদলে নিতে হয়েছিল, বদলে দিয়েছিলাম রূপক। সুতরাং ছেলেপেলে থাকাতে আমার উপকারই হয়েছিল।
লেস্টার: সমালোচক ফিলিপ রযেস্টার এই উপন্যাসটিকে ‘উন্নয়নের উপন্যাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এটি এমন এক উপন্যাস যা ব্যক্তির, এক পুরুষ ব্যক্তির বিকাশের অনুসন্ধান করছে। এই পুরুষালি মনোভাব, এই পুরুষালি ধরন, আপনি কি মনে করেন এগুলো বাস্তবিকই পুরুষের জন্মগত এবং আপনি কি ঐ ধারার মতবাদের সাথে একমত নন যারা মনে করেন এগুলো শেখা আচরণেরই কিছু নমুনা?
মরিসন: আমার প্রকৃত উপলদ্ধি হচ্ছে এগুলো জন্মগত। যদিও আমি যথার্থই বিশ্বাস করতে চাইব যে এগুলো তা নয়। আমি এমন ধরনের বেশ কিছু সাহিত্য পড়েছি যেগুলো বোঝাতে চায় যে, এই ব্যাপারগুলো শেখা জিনিস। আমি এটা বেশ পরিস্কার দেখতে পাই যখন লক্ষ্য করি যে নিষ্ক্রিয় বা গৌণ জীবন হওয়ার চেয়ে নারীরা ভিন্ন কিছু হওয়া শিখতে পারে এবং পুরুষের চেয়ে কীভাবে কম শক্তিশালী হতে হয়-এটাও যে নিশ্চিতভাবেই শেখার বিষয় তাও আমি দেখতে পাই। কিন্তু আমার মনে হয় পুরুষ-পুরুষত্ব ব্যাপারটি সহজাত হতে চায় এবং আমি জানি এই বিষয়ে আশি ভাগ সাহিত্যই আমার সাথে একমত নয়। কিন্তু পুরুষালির ধারণাটা অবশ্যই অপসৃত হতে পারে।
লেস্টার: আপনি তাহলে জানেন আমার পরের প্রশ্নটি কী হতে পারে-নারীবাদী ইস্যুগুলো আপনি কীভাবে দেখেন? কিংবা, সম্ভবত এটাকে আমার সুনির্দিষ্ট করে বলা উচিত: একজন কৃষ্ণাঙ্গ, নারীবাদী হওয়া কি সম্ভব কিংবা শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের মধ্যে কি কোনো চূড়ান্ত পার্থক্য আছে? জাতি গোষ্ঠীর কথা বাদ দিলে নারীদের বিষয়গুলো কোন জায়গাটিতে এসে মিলে যায়–যদি তা আদৌ ঘটে?
মরিসন: কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের কথা বিবেচনা করলে আমার মনে হয় তারা বেশ ভালো অবস্থানেই আছে, একটা সুবিধাজনক অবস্থানে। একই সাথে কালো এবং নারী হওয়ার কারণে শ্বেতাঙ্গ নারীরা কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ভূমিকাকে অবদমিত হিসেবে ব্যাখা করেন। কিন্তু এক দিক থেকে মজার ব্যাপার এই যে, কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা আগ্রাসনের সাথে এত বেশি খাপ খেয়ে গেছে যে, নারীবাদীরা তা অনুমোদন করছেন। কারণ তারা তো একই সাথে মা এবং শ্রমজীবী, মা এবং কর্মজীবী, আর আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ইতিহাস খুবই বেদনার এবং অনাকর্ষণীয়, কিন্তু ইতিহাসের এমন কিছু পর্যায় ছিল যা অন্তত সেই দাসত্বের যুগে আরো কিছু করার পক্ষে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছিল। আমরা দাসীদের ঘরের নারীর মতোই মনে করি; কিন্তু তারা তা ছিল না। তাদের বেশিরভাগই পুরুষদের সাথে মাঠে কাজ করত, পুরুষদের সাথে শারীরিক শ্রমের প্রতিযোগিতায় নামতে হতো, এই কারণে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটা পুরুষের কর্তৃত্ব বা নারীর কর্তৃত্বহীনতার চেয়ে বরং সহমর্মিতার হয়ে ওঠে। তারা যখন মাঠে চাষ করত বা তুলা সংগ্রহ করত কিংবা যাই-ই করুক না কেন, তখন তারা পুরুষ না নারী- এ নিয়ে দাস-মালিকরা ভাবত না। শাস্তির ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়ত ছিল: তাদের পরস্পরকেই মারধর করত, কাউকে করত ধর্ষণ। এক্ষেত্রে নারীরা পেত দুধরনের শাস্তি। কিন্তু প্রয়োজনটা ছিল একই ধরনের অর্থাৎ দৈনিক শ্রমের প্রয়োজন। সুতরাং বয়োজ্যেষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ নরনারীদের একটি প্রজন্মে আমি দেখেছি, এই সম্পর্কটা ‘তুমি এটা কর আর আমি এটা করি’র চেয়ে অনেক বেশি সহমর্মিতার এবং ভিন্ন কিছু নয়। এছাড়া দাস ব্যবস্থার পরেও আমরা সবাই জানতাম যে, আমাদের সব সময়ই কাজ করতে হবে; বিবাহিত হই বা না হই। এটা আমরা আগেই বুঝতে পেরেছিলোম, সে কারণে কাজ করা কিংবা গৃহিণী হওয়ার বিলাসিতা আমাদের ছিল না যা কিছু কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের রয়েছে। কাজ সব সময়ই এর একটা অংশ হয়ে উঠত। আমরা যখন অনুভব করলাম যে, কর্মক্ষেত্র এবং গৃহ, দুটোকেই এক সাথে পাওয়া দুর্লভ তখন আমরা সাংঘাতিক মানসিক পীড়ন অনুভব করলাম, আর বুঝলাম আমরা নির্যাতিত। কিন্তু আমরা যদি এটাকে নিজের করা কেবল আরো একটি বিষয় হিসেবে দেখি তাহলে এটা এক অগ্রগতি। কৃষ্ণাঙ্গ নারী হচ্ছে একই সাথে জাহাজ এবং নিরাপদ বন্দর।
লেস্টার: সত্যিই এটা একটি সুন্দর রূপক। কাজ এবং শক্তির প্রসঙ্গে আপনি একটু আগেই উল্লেখ করেছেন যে, আপনি বেড়ে উঠেছিলেন সুন্দর শান্ত এক তরুণী হিসেবে। একেবারে শুরুতেই আপনি ওই সময়কার মেয়েদের তীব্র সেকারিন ভাবমূর্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন? এক্ষেত্রে আপনার বাবার বলা ভূতের গল্পের কোনো ভূমিকা ছিল কি? আপনার শিক্ষকদের? আপনার পরিবার থেকে, মনে হয় বেশ ভালো শক্তিশালী একটা প্রেরণা এসেছিল।
ছবি: বাদিক থেকে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস ও টনি মরিসন।
মেক্সিকোতে ফুয়েন্তেসের বাসায়
মরিসন: হ্যাঁ, আমি নির্দেশ গ্রহণ করে, বড়দের মান্য করেই বেড়ে উঠেছিলাম। কিন্তু একই সাথে তারা আমাকে এমন কিছু দিয়েছিলেন যার অর্থ আমি অনেক পরে বুঝেছি। আমাদের কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। আমি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর যখন দেখলাম, অন্যদের প্রত্যাশা কম তখন আমি স ধরনের বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে এবং অতিক্রম করতে চাইলাম। কারণ আমার বাবা-মা ভাবতেন আমরা প্রতিভাবান, আর আমাদের যে সমস্যা ছিল তা বাহ্যিক। সামাজিক প্রতিকূলতা,অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা কিংবা জাতিবিদ্বেষের সমস্যাও ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরা ছিলাম আলাদা ধরনের মানুষ। জীবনের প্রতি আমার বাবা-মাও ওভাবেই সাড়া দিতেন। আমরা যখন অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে ছিলাম, মনে পড়ছে তখন মাসে চার ডলার ভাড়া দিতে হতো (যা এখন খুব বেশি মনে হবে না কিন্তু তখনকার জন্য এটা বড় অঙ্ক) এবং বাবার তখন কোনো কাজ নেই, ঐ চার ডলার তার ছিল না। তো বাড়িওয়ালা দরজায় একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল: ‘বিতাড়িত।’ আমার মনে আছে, মা বাইরে গিয়ে সাইনবোর্ডটি নামিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেন, যেন এতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। এসব ঘটনার পেছনে সব সময়ই এক ধরনের আক্রমণাত্মক এবং ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। কেউই তাদের বাড়াবাড়িতে প্রতিবাদ করত না, মেনে নিত। অতএব এই দুর্ভাগ্য নিয়েই কিছু করা সম্ভব হতে পারে–এ রকম একটা মনোভাব আমি পরিবারের লোকদের মধ্যে দেখেছি। বলতে গেলে তারা এ থেকে পালিয়ে বেড়ায়নি।
লেস্টার: ‘সৃজনশীল আগ্রাসন’ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, শ্বেতাঙ্গ যে লোকটি আপনার পিছে লেগেছিল, আপনার বাবা কি সত্যি তাকে সিঁড়ির নিচে ফেলে দিয়েছিল? ঘটনাটা কি সত্যি?
মরিসন: সত্যি এবং মনে রাখার মতো ঘটনা। মনে আছে আমার এবং আমার ছোট বোনের পিছে পিছে এক শ্বেতাঙ্গ লোক আমাদের বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত এসেছিল। আমরা দোতলায় এক ঘরে থাকতাম। বাবা তখন বাসায়, লোকটাকে তুলে তিনি সিঁড়ির নিচে ছুড়ে মারলেন। তারপর আমাদের ট্রাইসাইকেলটাও ওর ওপর ছুড়ে মারলেন। বাবা খুব লম্বা ছিলেন আর ঐ লোকটিও ছিল বিশাল আকৃতির। তিনি যা জানতেন তা হলো এই যে তার দুই মেয়ের পেছনে লোকটি লেগেছে, আর জানেনই তো তিনি সংসার এবং ঐ সব রক্ষা করেছিলেন। কিন্ত আমার কাছে এটা বেশ মজার ব্যাপারই ছিল কারণ আমেরিকায় অনেক লোকই আছে কিন্তু শারীরিকভাবে অথর্ব শ্বেতাঙ্গ লোক আমি আগে কখনো দেখিনি। সুতরাং অল্প বয়সেই আমি প্রথম যে জাতিবিদ্বেষ দেখি তাতে বিজয়ী ছিলেন বাবা, শারীরিক অর্থে বিজয়ী এবং গুরত্বপূর্ণ প্রথম যে ব্যাপারটি দেখলাম তা হলো আমার বাবার এক ধরনের দৃঢ়তা।
লেস্টার: সিভিল রাইট মুভমেন্টের প্রথম দিকে, রোসা পার্কের সময়টায় আপনি হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, হাওযার্ড খেলোযাড়দের সাথে যোগ দেন এবং দক্ষিণাঞ্চল ঘুরতে যান। আপনার খেলাগুলোতে কি সেই একই শ্বেতাঙ্গরাই অংশগ্রহণ করেছিল যারা আপনাকে তাদের রেস্তোরাঁ কিংবা বাসের সিট ব্যবহার করতে দিত না? খেলাগুলো কারা দেখত?
মরিসন: আমাদের দর্শকদের মোটামুটি সবাই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। আপনি তো আসলে শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে আসেননি। আমার বইগুলোতে এ বিষয়ে কিছু লোক খানিকটা ঝগড়া করে, কিন্তু আমরা আসলেই শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে আসিনি। কৃষ্ণাঙ্গ লোকজন যখন দক্ষিণাঞ্চলের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে কথা বলে তখন তো কেউ কেউ বিস্ময়ে হতবাক, কারণ দক্ষিণের এই ভয়ংকর খ্যাতিটা ছিল। কিন্তু সেখানে প্রায় সারা জীবন বাস করা অসম্ভব নয় এবং তেমন কোনো জাতিবিদ্বেষপূর্ণ ঘটনা কখনই দেখবেন না। কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ে যে কেউই নিরাপদ, বেশ সুখী বোধ করত। আসল দুঃখটা-যদিও তা ছিল প্রগতিই-এসেছিল একীকরণের আন্দোলনের সময়। কৃষ্ণাঙ্গরা বিবেকবান শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে এসেছিল; কিন্তু তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল সেইসব লোকদের ক্রোধ ও বিদ্বেষের যারা একীকরণের বিপক্ষে ছিল। সুতরাং বলা যায় শ্বেতাঙ্গদের দিক থেকে তাদের এবং অন্যদের মধ্যে আকস্মিক ঘনিষ্ঠতা লোকজনকে এক বিরাট বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দেয়। ওহাইওর লোরেইন-এ আমার অবস্থা ছিল ভিন্ন ধরনের। ওটা ছিল এক দরিদ্র শহর আর বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা অনেক লোকজন ছিল সেখানে। প্রথম প্রজমন্মটি ছিল ইউরোপীয় এবং মেক্সিকান, সবাই কাজ করত ইস্পাত কারখানায়। আমি কখনই কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবেশীদের মধ্যে ছিলাম না। আমাদের প্রতিবেশিদের যেটা বৈশিষ্ট্য ছিল তা হলো দারিদ্র্য, একই রকমের অর্থনৈতিক অবস্থান।
ছবি: আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে
লেস্টার: ১৯৬২ সালে আপনি হাওয়ার্ড-এ শিক্ষকতা করতে যান। ওই সময়ই সিভিল রাইট মুভমেন্ট তীব্রতর হতে থাকে, ডক্টর মার্টিন লুথার কিং-এর আন্দোলন নিজস্ব গতিবেগ অর্জন করেছিল, ঐ সময়টা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে কীভাবে দেখেন?
মরিসন: আমার মনে হয় হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ঐ ঘটনার প্রথম দিককার অবস্থাগুলোর সাক্ষী ছিলাম। স্টোকেলি কার্মিখায়েল ছিল আমার ছাত্র। সে ছিল গড়পড়তা মানের ছাত্র; কিন্তু ক্লাসে সে বুদ্ধিমানই ছিল। ও এমন ধরনের ছাত্র ছিল যে অন্যদের সক্রিয় করে তুলতে পারত। প্রাণবন্ত উপস্থিতির মতোই চমৎকার ছিল সে। ১৯৬৪ সালে ও যখন গ্রাজুযেশন করছে আমি বললাম, ‘স্টোকেলি, তুমি এখন কোথায় যাবে?’ ও বলল, ‘ইউনিয়ন থিয়োলজিক্যাল সেমিনারিতে আমি মনোনীত হয়েছি।’ ও ধর্মতত্ত্ব পড়তে যাচ্ছিল, তবে প্রথমে এক গ্রীষ্মে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য সে মিসিসিপি যায়। আমি নিশ্চিত সে থিয়োলজিক্যাল সেমিনারিতে আর কখনই ফেরেনি। এই ছেলেগুলো, এদের বেশিরভাগই ছিল আমার ছাত্র। আমার বয়স তখন বেশ কম। আমার ছেলে জন্মগ্রহণ করে ১৯৬১ সালে এবং আমার মনে হয় এসব ঘটনা থেকে আমি কিছুটা সরে আসি। আমি ভাবতাম যে, আমি বোধহয় সব সমযই পেছন দিকে যাচ্ছি। আমি একীকরণের পক্ষে ছিলাম না। কিন্তু প্রকাশ্যে আমি তা বলিনি। কারন সন্ত্রাস এবং বিচ্ছিন্নতার কদর্য দিকগুলো আমি জানতাম। তবে একীকরণ বলতে এও বোঝাত যে, আমরা সুন্দর কোনো কৃষ্ণাঙ্গ কলেজ বা কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষা পাব না। শ্বেতাঙ্গ শিশুদের সঙ্গ পেলে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা ভালো শিখবে–জানি না কেন এই ধারণাটি হয়েছিল। তখন থেকেই আমি ভিন্ন কিছু ঘটতে দেখেছি সেখানে, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বলত, ‘আমরা শ্বেতাঙ্গদের সাথে কিছুই করতে চাই না।’ আমি সব সময়ই মুহূর্তের আয়নার অন্য পিঠে থাকতাম। কিন্তু আমি জানতাম যে বর্ণবাদীরাও তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য বিচ্ছিন্নতা চেয়েছিল… যেটা ঘটা উচিত বলে আমি ভেবেছিলাম তা হলো সুন্দর ফ্যাকাল্টি, শিক্ষা এবং এর রকম আরো যা যা প্রয়োজন তার জন্যই টাকাটা সেখানে আসা দরকার। পাবলিক স্কুলের ব্যাপারেও আমার উপলব্ধিটা একই রকম ছিল। এই সমস্যাগুলো দূর করার স্বার্থেই আমার ছেলেকে নিউইয়র্কের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাওয়ার জন্য বাস ব্যবহার করতে দিতাম না। টাকাটা বরং কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবেশীদের মধ্যে রেখেই আমরা আমাদের নিজস্ব চমৎকার ফ্যাকাল্টি, পাঠ্যসূচি ইত্যাদি তৈরি করতে পারি। এ ব্যাপারে ঠিক কোনটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমার জানা ছিল; কিন্তু আমি বরাবরই ভাবতাম ঐ শ্রমের ফলগুলো সম্ভবত একই সাথে কিছুটা বিষ বহন করতে যাচ্ছিল।
লেস্টার: তো আজ এই দেড় দশক পর, অবস্থাটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? পঞ্চাশের শেষার্ধে এবং ষাটের দশকে (ভিয়েতনাম যুদ্ধ সত্ত্বেও) পরিবর্তনের একটা আশা ছিল: সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন। আমার ধারণা এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে তখন কিছুটা প্রগতি এসেছিল। কিন্তু আমি যদি সঠিকভাবে বুঝে থাকি তাহলে বলব এদের বেশিরভাগ অর্জনই স্থবির হয়ে যায় কিংবা বিপরীত দিকে মোড় নেয়। সত্তরের শেষের দিকে এই যে বিপরীত গতির শুরু তা নিশ্চতভাবেই আজ আমাদের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েও আছে। আপনি এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
মরিসন: হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিছু অর্জন হয়েছিল কিন্তু এর ফলে কিছু ভয়ানক ব্যাপারও ঘটে। এর একটা হচ্ছে গণমাধ্যম কর্তৃক গণঅধিকার আন্দোলনকে আত্মসাৎ যা একে ফ্যাশন করে তোলে। পরে দাসত্ব-পরবর্তী দিনগুলোয় যেমন ঘটেছিল–আমেরিকায় বিলোপবাদের পক্ষে যখন সমর্থন তৈরি হয়, তখন নারীবাদ অনুসরণ করেছিল গণঅধিকার আন্দোলন, আর তাই এই শক্তিটা কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের এমন এক অদ্ভত পছন্দের দিকে ঠেলে দেয় যা ছিল প্রতারণাপূর্ণ : কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন কিংবা নারীবাদের জন্য কাজ করা। এই অসম্ভব পছন্দ থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নেই। কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন আর নারী স্বাধীনতা-এ দুয়ের মাঝ থেকে কেন আমাকে একটি বেছে নিতে হবে?
লেস্টার: অল্প সময়ের জন্য ওহাইওর লোরেইনে ফিরে আপনি বলিছিলেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ এবং বিভিন্ন অভিবাসীকে যা ঐক্যবদ্ধ করেছিল তাহলো এদের অভিন্ন দারিদ্র্য। আপনার কি এদের সাথে বেশ ভালো যোগাযোগ ছিল? বিভিন্ন ধরনের নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃপরিবর্তন ছিল কি?
মরিসন: হ্যাঁ, অভিবাসীদের জানতে হতো বা ঐ রকম এক জায়গায় ওদের শিখতে হয়েছিল জাতিবিদ্বেষ, ওখানে তারা নিশ্চয়ই এসব সঙ্গে করে আনেনি। যে জিনিসটা আমাদের শহর কিংবা আমাদের প্রতিবেশ আর আমাদের স্কুলগুলোকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে এবং যে কোনো ধরনের হানাহানি থেকে মুক্ত রেখেছিল তা হলো শ্রেণীগত ঐক্য। আমরা সবাই ছিলাম একই শ্রেণীর আর তাই একে অপরের ওপর পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল ছিলাম। খাবার, কাজ এবং ভালো-মন্দগুলো ভাগাভাগি করে নিতাম অনেকখানি। কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ত, জাতপাতের কথা না ভেবেই লোকজন তাকে দেখতে যেত আর সেবাযত্ন করত। আমি যখন খুব ছোট, আমাদের পাশেই একদিকে ছিল এক গ্রিক পরিবার আর অন্যদিকে ছিল এক ইটালীয় পরিবার, কিছু কৃষ্ণাঙ্গ লোকজনও ছিল, তবে এদের সামাজিক সমাবেশগুলোয় প্রাইভেসি থাকত। ওতে আমরা যেতাম না। মানব স্বভাবের ধরনটাই এমন যে কোনো তিক্ততা বা বিদ্বেষ তাতে নেই। দক্ষিণাঞ্চলে ছিল দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ এবং দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের বসতি, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কাছে যেটা নিশ্চিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাহলো এই যে, এই দুই শ্রেণীর লোকজন বিশ্বাস করে যে তাদের জীবনটা ভিন্ন প্রকৃতির। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ এবং দরিদ্র শ্বেতাঙ্গরা অভিজাত ভূস্বামীদের কাজ করত। এটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক যে মার্টিন লুথার কিংয়ের মৃত্যুর আগে তার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট্ট শহরগুলোয় তাকে যেতে হচ্ছিল। দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ কৃষক এবং দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ লোকদের সম্মিলিত সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেছেন এবং তাদের স্বার্থ যে অভিন্ন, তাদের শক্রও যে এক–এটা তাদেরকে বুঝাতে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সমস্যাটা কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি কিংবা শ্বেতাঙ্গদের নির্যাতন নয়–এটা ছিল ওখানকার শ্রেণীসংগ্রাম এবং এরা সব সময়ই বর্ণবাদী অবস্থান থেকে সাড়া দিত বলে ওটাই ছিল শাসকশ্রেণীর সুবিধা। বর্ণবাদ নিশ্চিতভাবেই অর্থনৈতিক বৈষম্যে সহায়ক। আমি একটা টিভি অনুষ্ঠান দেখেছি। একবারই দেখেছি মাত্র এবং আমি ছাড়া মনে হয় পৃথিবীর আর কেউই এটা দেখেনি। তার মৃত্যুর ঠিক আগেই কিং একটা চার্চের মধ্যে ছিলেন, শ্বেতাঙ্গদের এক চার্চে, সেখানে ছিল দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ লোকজন। এক লোকের কথা মনে পড়ছে যার কাছে এটা পবিত্র কিছু মনে হয়েছিল। ঐ সময়ই সে, এক দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ, প্রথম বুঝতে পারল কীভাবে সে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তার শক্র যে ঐ পাশের কালো কৃষকটি নয়, যে হয়ত আরো দুফিট বেশি জমির মালিক, আসলে তার শক্রটি হচ্ছে হয় ব্যাংকিং কাঠামো নয়তো আইন, অন্তত অন্য কিছু। আসলে ওটাই হচ্ছে প্রকৃত উপলদ্ধি। ঐ ধারণাটি (Idea) যদি সংক্রামক হয়ে থাকে আর তা যদি দেশব্যাপী ছড়িয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছিল। এই কারণেই কিংয়ের মৃত্যুটা সব দিক থেকেই ক্ষতিকর। প্রভাব বিস্তারের এমন একটি পর্যাযে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন যেখানে কিছু একটা ঘটার পক্ষে আসলেই বিপজ্জনক হযে উঠেছিলেন তিনি। সেখানে কখনই আসলে শ্রেণীসংঘাত ছিল না বরং শ্রেণী ঐক্যটাই ছিল। কারণ একটি পুঁজিবাদী সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হওয়ার স্বাধীনতা তাদের ছিল, তাই বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে কখনই গুরত্বপূর্ণ সহযোগিতা হতে পারত না। কিন্তু ওহাইও’র লোরেইন-এ একই পরিবেশে থাকাকালে এটা কেমন ছিল তা আমি জানি, সেখানে ছিল শ্রেণী-ঐক্য, শ্রেণীগুলোর মধ্যে সহযোগিতা।
লেস্টার: ডক্টর মার্টিন লুথার কিং কি সে কারণেই নিহত হয়েছিলেন?
মরিসন: আমি বরাবরই ভাবতাম যে যেহেতু তিনি এমন একটি অবস্থানে পৌঁছে গিযেছিলেন যেখান থেকে ভিয়েৎনাম যুদ্ধ, শ্রেণী সমস্যাগুলোর মতো বিষয়কেও প্রভাবিত করতে পারতেন। সে কারণে তিনি আসলেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন, সত্যিই বিপজ্জনক। এ জন্যই তার মৃত্যুটা এমন এক সময়ে হলো যখন তা ঐ প্রশাসনের জন্য দরকার হযে পড়েছিল।
ছবি: সাপ্তাহিক নিউজউইক সাময়িকীর প্রচ্ছদ-কাহিনীর বিষয় টনি মরিসন
লেস্টার: আজ যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি তা নিশ্চয়ই জাতি এবং শ্রেণীর প্রাচীরগুলো অতিক্রম করে যায়। আপনি কি এখন ‘পিস মুভমেন্ট’ দ্য ফ্রিয়ার মুভমেন্ট;-এর মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়?
মরিসন: কয়েক দিক থেকে আমি গভীরভাবেই জড়িত। তবে যে কোনো সংগঠনের জন্যই পৃথিবীর সবচে’ বাজে সদস্য বলেই আমি কোনো কিছুতে যোগ দেই না। আমার ওপর যদি কেউ ভরসা করে, আমি হযত এতে সঠিকভাবে সাড়া দিতে পারব না, তবে বলা বা লেখার ক্ষেত্রে আমি সক্রিয়। একটি আন্দোলনকে বিভিন্ন অবস্থান থেকেই সহযোগিতা করার থাকে। আপনি তো জানেন, এ রকম জটিল আন্দোলনগুলোতে প্রাথমিকভাবে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ–শান্তি, যুদ্ধ-বিরোধী মনোভাব, অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন এবঙ আরো কিছু– সেখানে আপনার সব ধরনের লোকই দরকার। মিছিলের ভূমিকা আছে, জার্নালিজমের ভূমিকা রয়েছে, শিল্পীদের ভূমিকা রয়েছে, আছে শিক্ষকদের ভূমিকা, সব ধরনের মানুষেরই কিছু করার রয়েছে। সব ধরনের দক্ষতা এবং প্রতিভাকেই এই আন্দোলনগুলো ধারণ করতে পারে।
লেস্টার: টনি মরিসন, আপনার কাছে শেষ প্রশ্নটি হচ্ছে লেখক সম্পর্কে ‘এসেন্স’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে আপনি একবার বলেছিলেন, ‘নারীদের জন্য লেখেন এমন নারীও নিশ্চয়ই আছেন, আবার গভীর উপলদ্ধি থেকে লেখেন এমন নারীও আছেন… ফ্লানেরি ও ‘কনোর এবং ইউডোরা ওয়েল্টির মতো নারীরা শুধু মানুষ হিসেবেই লিখেছেন। কখনো কখনো পুরুষ সম্পর্কে লিখেছেন, কখনো বা তাও নয়।’ এ বিষয়ে আপনার অবস্থানটি কোথায়?
মরিসন: আমার অবস্থান পরের শ্রেণীতে। আমি কোনো লিঙ্গকে নির্দিষ্ট করে লিখি না… কৃষ্ণাঙ্গ লোকদের সংস্কৃতি নিয়ে একজন লেখকের কিছু করার আছে– এই বোধ আমার কল্পনায় যা জাগিয়ে তোলে তাই ঘটে। সমগ্র পৃথিবীকেই আমি আমার ক্যানভাস হিসেবে বিবেচনা করি এবং একজন নারী হওয়ার অনুভূতি ও উদ্দীপনা উপলদ্ধি করে আমি লিখি। কিন্তু নারীদের সাহিত্য বলতে যা বোঝায় আমি তেমন কিছু লিখি না। আমার ধারণা এটা আমাকে সীমিত করে ফেলবে। একজন লেখক হিসেবেই আমি মূল্যায়নযোগ্য যেহেতু আমি একজন নারী, সেহেতু আমি মনে করি, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে নারীদের বিশেষ ধারণা রয়েছে। এটা এমনভাবে আসে, আর আসে নারীদের কল্পনামনীষা থেকে, যেখান থেকে তারা পৃথিবীটাকে দেখতে পায়। শুধু নারীদের সম্পর্কে আর নারীদের জন্য লেখা নারীদের সাহিত্য আমি অপছন্দ করি না, যদিও এদের কোনো কোনোটি বেশ শক্তিশালী ও বেশ সুন্দর। অবশ্য আমি নিজে মোটেই সে রকম লিখি না কারণ এটা অনেক কিছুকেই সীমিত করে ফেলে। এটা চোখে ঠুলি পরানোর মতো ব্যাপার। যখন লিখি তখন অনুভব করতে চাই যেন সব কিছুই আমার সামনে রয়েছে।
আপনার মন্তব্য লিখুন