জীবনের গল্প

ফেলে আসা দিন ও আজ -৪ || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

আমি এরপর ওখান থেকে বিদায় নিতে চাইলাম। কিন্তু সখীমা কিছুতেই ছাড়লেন না। আমাকে বড় এক গ্লাস দুধ, গাছের পাকা কলা আর এক বাটি চিঁড়ে ও আখের গুড় খেতে দিলেন। আমি একদম আঁতকে উঠে বললাম— সখীমা আমি গুড় খেতে পারিনা , আর তাছাড়া আমি এখন খেতে পারবনা । আমি তো স্নানই করিনি। সখী মা কোন কথা শুনলেন না জোর করে সব খাওয়ালেন। বাচ্চা ছেলের মতো চিবুকে ধরে মুখে গুঁজে গুঁজে খাইয়ে দিলেন । আমি বাধ্য ছেলের মতো সব খেলাম তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে সখীমা আর আখড়ার সকলকে জয় গুরু বলে বিদায় নিলাম।

এই যে আমি আমার জীবনী লিখছি। এর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সমাজের এমন কোন কেউকেটা নই যে আমার জীবনী পড়ে কেউ উপকৃত হবে।,, তবুও লিখছি।কেন লেখার প্রয়োজন

হলো?লিখছি শুধু ফেলে আসা জীবন কেমন ছিল? সবাই একদিন বড় হয়ে যায়।

সংসারী হয়ে যায়। কেউ আর নিজের বাল্যকাল ,বাল্যকালের সাথীদের কথা মনে রাখে না। স্কুলের কথা, শিক্ষকদের কথা এ

সব মনে পড়লেও সে কথা কেউ শুনতে চায় না।

আমি কলম ধরলাম তাদের জন্যে,

যারা বাল্যকাল ভুলে গেছে, যারা নিজের জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা ছেলে বেলা বা মেয়ে বেলা ভুলে গেছে। আমি লিখছি যারা একটি সহজ সরল শিশুকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। আমি লিখছি সেই সব লজ্জার কথা যা আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। প্রথমেই যে মোটা সোটা একটি দিদির কথা বলেছিলাম। বাস্তবে সে তো আমার দিদি ছিলনা।এমনকি আমাদের সঙ্গে কোন আত্মীয়তাও ছিলনা।সে আমার থেকে বছর দশেকের বড় ছিল সে সময়। সে এসেছিল আমার গ্রাম সম্পর্কের এক দাদার সাথে। আমার গোটা বাল্যকালটা কেটেছিল তাদের বাড়িতে। কারন আমি ব্রাহ্মণের ছেলে হওযার জন্য মাত্র নয় বছর বয়সে আমার উপনয়ন মানে পৈতে হয়। নিয়ম অনুসারে তিনদিন আমাকে অন্ধকার ঘরে থাকতে হয়। আর সেই সময় আমার পরনে কৌপীন আর সাদা উত্তরীয় ।

মাথা কামানো ,নেড়া মাথা আর মাথার পেছনে একটি শিখা বা টিকি। দু কান ফুটো করে তাতে নিম কাঠি ঢোকানো। তিনদিন পর সূর্যাস্তের আগে আমি সংসারে পা রাখব । তখন যে প্রথম মুখ দেখে তারা ভিক্ষা মা ভিক্ষা বাবা হয়ে যায়। এই একটাই সম্পর্ক ছিল আমার সঙ্গে। কিন্তু আমি যতদিন গ্রামে ছিলাম অর্থাৎ চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তত দিন আমি আমার ভিক্ষামা ,ভিক্ষাবাবার দেখা শুনা করেছিলাম। কেননা আমার ভিক্ষা দাদারা আমার চেয়ে অনেক বড় ।ওরা সবাই বাইরে থাকতো । আর ছিল এক অবিবাহিত দিদি। যাকে আমি কখনো জানতামই না যে দিদি আমার নিজের দিদি নয় ।

দিদি আমার থেকে কুড়ি বছরের বড় ছিল ,কিন্তু আমি ওর সাথে খুব ঝগড়া করতাম। খাবার ফেলে দিতাম।খাইয়ে দিলে অনেকবার ওর আঙ্গুল কামড়ে দিয়েছি। দিদিও আমাকে কষে থাপ্পড় মারতো। আমি চিৎকার করে কাঁদলে ভিক্ষামা দিদিকে বকতো খুব। পরে দিদি আমাকে খুব আদর করে দিত ।

 

এ ভাবেই কাটছিল আমার ছেলে বেলা। তখন আমার দুটো মা দুটো বাবা আর অনেক দাদা অনেক দিদি।আমি মাসের পর মাস ভিক্ষামাদের বাড়িতে থাকতাম ।যখন মায়ের জন্য খুব মন খারাপ হতো তখন আমি বাড়ী চলে আসতাম। এমনিতেই আমি রোজ মাকে দেখতে আসতাম মায়ের হাতে খেয়ে যেতাম। এ পাড়া ও পাড়া আমদের বাড়ী আর ভিক্ষা- মা দের ।

এভাবেই সময় বয়ে যেতে লাগলো আপন গতিতে। আমিও তখন বেশ বড় হয়ে গেছি। ক্লাস ইলেভেনে পড়ি।বছর খানেক পর আমার ফাইনাল পরীক্ষা ।

 

আমার এক দাদা মানে ভিক্ষা দাদা সে তখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসেছিল ।

লক্ষ্মৌ পোস্টিং থাকা কালীন ও সেতার শিখেছিল । চাকরি ছাড়ার পর দাদা তখন সেতার শিখিয়ে বেড়াত বিভিন্ন জেলাতে । সে বিবাহিত ছিল এবং একটি ছেলেও ছিল । আমার চেয়ে চার বছরের ছোট ছিল । দাদা বৌদির মনের মিল ছিলনা। অবশ্য সেটা আমার বোঝার মতো বয়স হয়নি।

যাই হোক এক পৌষ মাসের সন্ধ্যে বেলায় আমার ভিক্ষা দাদা এক মহিলাকে নিয়ে ঢুকলো। বাড়ির সবাই দেখছে কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করতে পারল না –যে এই মেয়েটি কে ? দাদা নিজের স্ত্রীর মতো ওই মহিলাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। প্রথমেই মাকে বলল –মা এর নাম শিবানী ডাক নাম টুলু । আমাকে দেখিয়ে বলল এ আমার ভাই –বিল্টু । আমাকে বললে—

বিল্টু ! দিদির সঙ্গে থাকবি। আমি কাল ভোর বেলায় বাইরে যাব । পরের দিন ভোরে দাদা চলে গেল । আমাদের গ্রামে দু দুটো নদী তার উপর প্রচুর গাছ। সুতরাং ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। আমি সারাক্ষণ টুলুদির সঙ্গে গল্প করে কাটালাম। তার মাঝে পড়ছিলামও কারন সামনে এইচ এস পরীক্ষা। গল্প শুনতে পেলেই দিদি চিৎকার করে ডাক ছাড়ছিলো–বিল্টু –তোর লজ্জা করেনা ?

বেহায়া ছেলে আর এক বছর পর তোর

পরীক্ষা না? অমনি আমি জোরে জোরে পড়তে শুরু করে দিতাম। টুলুদি মুচকি মুচকি হাসছিল ! বললে বাঃ বেশ ফাঁকি মারা হচ্ছে ! আমি বললাম– আরে তুমিই তো গল্প করছো ! তখন টুলুদি কখনো আমার বই টেনে নিচ্ছে ,কখনো বা চুল ধরে নাড়া দিচ্ছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম –আমি কিন্তু দিদিকে বলে দেবো–!- বল না! দেখ আমি কি করি !

 

পৌষ মাস তার উপর নদীর ধারে বাড়ী। কি

মারত্মক শীত। রাত্রে খাওয়া হয়ে গেলে দিদি বলল –অ্যাই বিল্টু তোর পড়ার ঘরে বড় লেপটা দেয়া আছে , তুই আর টুলু ওখানে শুয়ে পড়। টুলুর খাওয়া হলে ও যাবে ততক্ষণ তুই পড়। আমি বাইরে এসে চেঁচিয়ে বললাম– আমি তোমার কাছে শোব। দিদি নিচের থেকে দুম দুম শব্দ করে উপরতলায় উঠে এলো। এসেই আমাকে ধমকে বলল –বাঁদর ছেলে! বাড়িতে গেস্ট এসেছে ! আর তুমি বদমাইশি শুরু করেছ?

আমি নাছোড়ের মতো বললাম–আমি ওর সাথে শোব না! তুমি বড় লেপটা তোমার ঘরে নিয়ে যাও আমি তোমার কাছে শোব যেমন রোজ শুই। দিদি বলল না আজ শো কাল থেকে আমার কাছে শুবি !লক্ষী সোনা ভাই। জেদ করিস না।

 

অগত্যা আমি আর টুলুদি শুয়ে পড়লাম। আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একবার এ পাশ ফিরছি তো একটু পরেই ওপাশ ফিরছি। এরপর আমার জীবনে যা ঘটলো তা আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারিনি।

অনেকক্ষণ ধরেই সে আমাকে খুব আদর করছিল। আমি অতো বুঝিনি তখন। তারপর সে হঠাৎ আমাকে তার দিকে টেনে ফিরিয়ে এত জোরে চাপতে শুরু করলো যে আমার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আমি ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলাম। তারপর আমার পাজামার ভেতর হাত দিতে শুরু করলো। আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। টুলুদি আমার চোখ মুছিয়ে আদর করে বললে –সোনা ভাই আমার! কাঁদছিস কেন? দেখ আমি তোকে কতো ভালবাসছি ! তোর ভালো লাগছে না ? আমি ওর সাথে কোন কথা বললাম না। আমি প্রায় দু ঘন্টা ধরে সেক্সুয়ালি হয়রান হয়েছি। আমি আর পারছিলাম না। আমি উঠে বসলাম। আরে দুষ্টু ছেলে এই ঠান্ডায় লেপের বাইরে কি করছিস? আমি আসতে করে বললাম–আমি সুসু যাব। আমি দরজা খুলে কোনরকমে ছাদে গেলাম। ভীষণ ঠান্ডায় আমি হিম হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি পাশের ঘরে দিদিকে ডাকলাম খুব আস্তে করে ।কোন সাড়া নেই। আমি দু তিনবার দরজায় টোকা দিলাম খুব সন্তর্পণে। কারন পাশপাশি দুটো রুম। যদি টুলুদি পাশের ঘরে বুঝতে পেরে যায় । আর তাছাড়া এমন শিকার কি কেউ সহজে ছেড়ে দেয়? না পারে ? একে শীতকালের রাত তার উপর লেপের ভেতর থেকে দিদি কিছুই শুনতে পেলনা। এদিকে টুলুদি অতক্ষণ না ফিরে আশায় ঠিক বেরিয়ে এসেছে। এসেই আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। বলল– ঠান্ডায় খালি গায়ে কি করছিলি? একেবারে বাচ্চা ছেলে একটা। যথা রীতি শুরু হলো তার আদর সোহাগ আর কামনা চরিতার্থ করার নানান কৌশল। কোন রকমে রাত শেষ হলে আমি অনেক ভোরে উঠে গেলাম। উঠেই দিদি কে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলাম। শীতকালের ভোর। দিদি উঁ আঁ করছে আর ঘুম জড়ান গলায় বলছে –তুই তো বেলা আটটার আগে উঠিস না ? দিদি গজ্ গজ্ করতে দরজা খুলেই আবার লেপের তলায় ঢুকে গেল। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো। আমিও সটান দিদির পাশে শুয়ে পড়লাম। দিদি আমাকে এক হাত দিয়ে আমকে ধরে বললে—কি রে ! এতো ভোরে তুই উঠিস না কোনোদিন ? ঘুম হয়নি বুঝি ? লক্ষী ভাই আমার , ঘুমো । ও উঠেছে ? আমি কোন সাড়া না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

সকালে অর্থাৎ বেলা ন’টায় আমাকে হেঁকে ডেকে তোলা হলো। আমি উঠে পেস্ট ব্রাশ নিয়ে বাইরে এলাম। দিদি বলল –দেখ ওখানে জল গরম করে রাখা আছে। আমি

নিঃশব্দে মুখ ধুলাম। চা খেলাম। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো —কি রে বিল্টু দুধ মুড়ি খাবি না রুটি করে দেবো। আমি বললাম—- না আমি মুড়ি খাবো না ,তুমি আমাকে দুধ দিয়ে দাও আর দুটো বিস্কুট দেবে। আমি দুধ আর বিস্কুট খেয়ে দিদিকে বললাম– আমি বাড়ী যাচ্ছি। দিদি চেঁচিয়ে উঠলো—কি বাড়ী মানে ? তোর না পরীক্ষা? আমি দৌড়তে দৌড়তে বললাম—বিকেলে চলে আসবো।

 

আখড়া থেকে ফিরতে আমার প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেল। আমাদের বাড়িতে অনেক লোক ।মস্ত বড় গৃহস্থ যৌথ পরিবার। বড়দা ,বড় বৌদি ,মেজদা ,মেজ বৌদি ,চারটে ভাইঝি ,চারটে ভাইপো ,আমার ভাগ্নে ছোড়দি, মা ও বাবা । তাছাড়া প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেই । অথচ , আমি যে সকাল থেকে বাড়িতে নেই কারোর কোন হুঁশ নেই । শুধু মা আমার পড়ার ঘরে বসে আছে । আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলাম । মা আমাকে বলল –কি রে তোর কি কোন জ্ঞান গম্যি বলে কিছু নেই ? এতক্ষণ কোথায় ছিলি ? সেই সাত সকালে এক কাপ চা খেয়ে কোথায় গিয়েছিলি ? তোর কি কোন মায়া মমতা বলে কিছু নেই ? আমি বললাম — মা আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম যে আমি পলাশডাঙ্গার আখড়া যাব । মা বললে— আর কখন খাবি ? বিকেল হতে চলল । যা স্নান করে নে । আমি চা করে দি রুটি খা । আমি বললাম ঠিক আছে ।

 

এমনি করেই আমার দিন গুলো কাটছিল। বেকারিত্বের জ্বালা । নন্দিনীকে হারানোর যন্ত্রনা। আর এই বেদনাটাই আমি ভুলতে পারছিলামনা বলেই তো বাইরে বাইরে থাকি । এই কথাটা মা-ই বুঝত ।

বই পড়ে সিনেমা দেখে কোনরকমে দিনটা পেরিয়ে যেত, কিন্তু রাতটা কাটতে চাইত না কিছুতেই ঘুম হত না। আমি মাঝে মাঝে মাঝ রাত্রে বেরিয়ে যেতাম সোজা নদীর মোহনায়। খানিকটা এগিয়ে গেলে শ্মশান। চারদিকে ধু ধু বালি আর মাঝে মাঝে শ্মশান। পোড়া কাঠ ,ভাঙ্গা কলসি ,ছেঁড়া কাপড়ের ফালি ,এধার ওধার দু একটি কড়ি ,ভাঙ্গা চুড়ি। ময়লা বালিশ ,ছেঁড়া কাঁথা আর কিছু আধ পোড়া হাড়। এই ছিল শ্মশানের চিত্র ।

ওখানে একটা দড়ির খাটিয়া ছিল। কেউ মড়া নিয়ে গেছিল ওই খাটে করে। কেন জানিনা খাটটা পুড়িয়ে দেয় নি। আমি ওই খাট টাকে একটা ছাতিম গাছে বেঁধে রাখতাম আর রাত্রি বেলায় ওখানে গিয়ে ওটা খুলে পেতে বসে থাকতাম বা শুয়ে থাকতাম। ভোর হলে বাড়ী ফিরে আসতাম।কেউ টের পেত না। শুধু মা জানতে পেরে গিয়েছিল। আমি আর পারছিলাম না। এভাবে আর নয়! আমায় কিছু একটা করতে হবে। হয় আমি সংসার ছেড়ে চলে যাবো নয় আমার একটা চাকরি চাইই চাই। নইলে আমি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবো।

আমার তখনও রেজাল্ট বেরোতে দের আছে। আমি পরীক্ষার ফল নিয়ে অতো ভাবতাম না। কারন আমি জানতাম আমি পাশ করবো এবং দারুণ ভাবেই করবো।

 

সেই সময় আমার কাছে পাড়ার অনেক মেয়ে দুপুরে পড়তে আসত। ওই ক্লাস ফাইভ থেকে মাধ্যমিক।

তার মধ্যে একজন হঠাৎ আমাকে একটি প্রেম পত্র দিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। সেই মহূর্তে আমি কিছু বললাম না। পরেরদিন আবার ও পড়ার শেষে সবাই যখন উঠে গেছে সে আমার বালিশের তলায় কিছু একটা রেখে বেরিয়ে গেল। সেটাও একটা প্রেম পত্র। এভাবেই শুরু হবে আবারও একটা নন্দিনীর গল্প।আমি ভাবে ছিলাম এখান থেকে পালাতে হবে। আর নয়! আমার হঠাৎ রাজ কাপুরের মেরা নাম জোকারের গান মনে পড়ে গেল। কয়েকটি লাইন আমার মনে আছে —” গোরে তন্ সে চমকে বিজুরিয়া আগ না লাগ যায়ে

প্যার কিয়া হ্যায় নিভানা পড়েগা দেখো দাগ না লাগ যায়ে……..

আমার দাগ লেগে গেছে। আমার মুক্তি নেই এই চেনা জগতে। আমি চলে যাবো অন্য কোথাও অন্য কোনখানে। একবার দাগ লেগে গেলে যেমন দাগী হয়ে যায় তেমনি নন্দিনীর দাগ মোছা যাবেনা।

আমি আমার প্রিয় নদী ,আমার গ্রাম,কলকে ফুলের হলুদ পাখি, কাঁঠাল গাছে বসে থাকা ছোট্ট বুলবুলি, হাজার বছরের

পুরাতন বট বৃক্ষ, আতা গাছের ডালে ঝোলানো দড়ির দোলনা এবং সর্বোপরি আমার প্রিয়তমা মা –এই সব ছেড়ে চলে যেতে চাই। আমার চোখে ঘুম ছিলনা। আমার মনে সুখ কোন সুখ ছিলনা। আমার বড় কান্না পেত । আমার বড় কষ্ট হতো। তাই আমি কোথাও পালাতে চাইছিলাম।

হঠাৎ একটা সুযোগ এসে গেল ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় একটা প্রাইভেট ফার্মের ঠিকানা দিয়ে বললেন চাষনালা চলে যেতে। কিন্তু আমি তো চাষনালা কোথায় তাই জানিনা।উনি বললেন বাঁকুড়া স্টেশনে ট্রেন ধরে সুদাম ডিহি স্টেশনে নেমে গড় গড় করে গড়িয়ে গেলেই চাষনালা কোলিয়ারি। মালিক খুব ভালো । বললে একটা কিছু হিল্লে হয়ে যাবে। ব্যস্ ।আমি ওইটুকুই চাইছিলাম ।

 

আমি বারোই ডিসেম্বর সকাল ছ’টায় বেরিয়ে পড়লাম। একটা নীল ব্যাগ ,তারমধ্যে দুটো পুরনো প্যান্ট দুটো জামা আর একটা পাজামা ,পেস্ট, ব্রাশ

আর মাত্র মায়ের দেয়া কুড়িটা টাকা নিয়ে আগামী ভবিষ্যতের দিকে বেরিয়ে পড়লাম।

পেছনে পড়ে রইল গন্ধেশ্বরী নদী –আমার সাধের নদী -আমার সাথী -আমার মায়ের মতো নদীটি ফেলে চলে গেলাম। আরো অনেক কিছু ফেলে এলাম। আমাদের বাগান আমার হাতে লাগান অনেক গাছ ,আমার পৈতৃক ভিটে , আতা গাছ বাঁশ ঝাড় ,নোনা আতা,ডুমুর চালতা ,তাল ,খেজুর ,অনেক পাখি ,অনেক শালিক ,অনেক কাক,চিল

চড়াই ,বুলবুলি তাদের সবাইকে ছেড়ে অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম ।

 

শুনেছি বাবা বা মায়ের মৃত্যুর পর মুখাগ্নির পর আর পেছন ফিরে তাকাতে নেই । আমার বুক ঠেলে কান্না আসছিল।

আমার মা কেমন করন মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল ! আমার ভাইপো ভাইঝি ,ছোড়দি ,পাড়ার অনেক ছেলে মেয়ে আমার পিছু পিছু আসছিল নদী পেরিয়ে ।

 

……চলবে

 

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত