জীবনের গল্প

ফেলে আসা দিন ও আজ-৩ || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

যাই হোক বিনিকে মোটামুটি সব বললাম, কেবল কিছু অংশ চেপে। তা নাহলে আরো ঝগড়া হতো।সব শুনে বিনি বললে–ও একটা শহুরে মেয়ে ও তোকে সরল বোকা পেয়ে খেলাচ্ছে ;আমি বলছি তুই ওখান থেকে এখনই যদি বেরিয়ে আসতে না পারিস -পরে খুব দুঃখ পাবি। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। হঠাৎ আমি উঠে গেলাম, –বললাম আসি। পরে তোর সাথে কথা বলবো।

 

আমরা সেদিন নদীর পাড় ধরে ধরে অনেক দূর অবধি হেঁটে গেলাম, যে খানে গন্ধেশ্বরি নদী মিলে গেছে দ্বারকেশ্ব নদের সাথে। ওই জায়গাটা এতো সুন্দর ও নয়নাভিরাম যে গেলে আসতে ইচ্ছে করেনা। তা ছাড়া নদীর মাঝে বড় বড় টিলার মতো পাথর খাড়া উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটা বৈশিষ্ট হল ওখানে একটা দ্বীপ আছে। চারদিকে নদী মাঝ খানে প্রায় একশ বিঘার মতো একটা দ্বীপ।

ওখানে প্রচুর বন কুল, বৈঁচি আর নাম না জানা প্রচুর গাছ। আর আছে শেয়াল,

সাপ,কাঁকড়া বিছে। সাধারনত ওখানে খুব একটা কেউ যায় না।

আমরা সেদিন দুজনে ওখানেই গেলাম। সুর্য তখন ডুবু ডুবু । পশ্চিম আকাশ লালিমায় লাল। অপরূপ প্রাকৃতিক

সৌন্দর্য -দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

 

আমি আর নন্দিনী বসলাম বালির উপরে।

ও আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুমু খেল। আমি ওকে বুকে টেনে খুব আদর করলাম। আমি ওকে বললাম দেখ্ সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এখানে বেশিক্ষণ থাকবো না। এখানে গোখরো সাপ আছে , আর প্রচুর শেয়ালও আছে। ও কেমন আছন্ন হয়ে ছিলো। হঠাৎ দেখলাম ও কাঁদছে। আমি ওকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে বললাম –কি হলো ? নন্দিনী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল -কাল ভোরের ট্রেনে আমি চলে যাবো। এখন যাবো না। তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে থাক। ব্যপারটা ভারি হয়ে যাচ্ছিল দেখে আমি বললাম –আরে তুই তো আর চির দিনের মতো চলে যাচ্ছিসনা।

চল একটা গান শোনা ! ও কাঁদছিল ! আমি নিজেই একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত ধরলাম।

 

আমি জানি আমার গানের গলা ভালো নয় তবুও আমি শুরু করলাম :

” কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না

শুকনো ধুলো যত

কে জানিত আসবে তুমি গো

অনাহুতের মতো

কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না

শুকনো ধুলো যতো —

পার হয়ে এসেছ মরু নাই যে

সেথায় ছায়া তরু

পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো

এমন ভাগ্য হত

কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না

শুকনো ধুলো যতো —-

!অলসেত বসে ছিলাম আমি

আপন ঘরের ছায়ে জানি নাই যে তোমায়

কতো ব্যথা বাজবে পায়ে পায়ে

ওই বেদনা আমার বুকে বেজেছিল

গোপন দুঃখে

ওই বেদনা আমার বুকে বেজেছিল

গোপন দুঃখে

দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো —

গভীর হৃদয় ক্ষত —

কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না

শুকনো ধুলো যতো ।

 

আমিও কেমন উদাস হয়ে গিয়েছিলাম। আগামী কাল তো ও চলে যাবে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম , নন্দিনী তখনও বালির উপর আধশোয়া অবস্থায় ছিলো। আমি ওকে বললাম –এই চল্ ! অনেক রাত হয়ে গেছে ! আর তাছাড়া জায়গাটাও ভীষণ ফাঁকা! ও কেমন উদাসী গলায় বললে –কাল থেকে তো আমি আর থাকবোনা । আবার কখন আসবো কে জানে। আমি কি করে থাকবো বলতো তোকে ছেড়ে ? আর শোন্ ! কোনদিনও এই গানটা গাইবি না কারো কাছে। বুঝলি? আমি ম্লান হেসে বললাম আমি তো গাইতে চাই নি ! তোকে বললাম তো, তুই তো তখন কেঁদেই অস্থির ,তাই তো –ও আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল–তুই আমাকে ছুঁয়ে বল আর কারো সামনে গাইবি না ! আমি বললাম ঠিক আছে গাইবো না। কিন্তু এতো বাজেও গাইনি !-দারjুন গেয়েছিস।

কিন্তু এ গান আমার জন্য গাইবি শুধু।

 

আমরা পাশাপশি হাঁটছিলাম। ও আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললে–কাল এমন সময় তুই কি করবি?

আমি কিছু বলতে পারলাম না। বললাম —

চল্ অনেক রাত হয়ে গেছে। আমরা দুজনেই জানতাম না যে এটাই আমাদের শেষ দেখা -এ জীবনে।

হ্যাঁ ! এ জীবনে সেদিনই ছিলো আমাদের শেষ দিন। তারপর আর কোনোদিন দেখা হয়নি-কথা হয়নি।

 

আমরা সেদিন বেশ রাত করে ফিরলাম। নন্দিনী ওদের বাড়ী চলে গেল। আমি আমার পড়ার ঘরে ঢুকে গেলাম। কিছু জানতেই পারলাম না। আসলে হঠাৎ ওর মা,দাদা, বৌদি এসে পড়ে। ওরা বিকেল পাঁচটায় আসে। এসেই নন্দিনীর খোঁজ শুরু করে ।

কিন্তু সবাই জানত ও আমার সঙ্গে আছে কিন্তু কোথায় আছে কেউ বলতে পারেনি ।

কিছু একটা সন্দেহ তো ছিলোই । সেদিনের পর পুরোটাই জানাজানি হয়ে গেল। সেদিন রাত্রে ওর সাথে কি হয়েছিল আমি আজো জানিনা। পরেরদিন সূর্যাস্তের আগেই ওকে নিয়ে চলে যায়। আমার সাথে শেষ দেখাটাও হয়নি।

নন্দিনী তো একা গেল না। সাথে করে নিয়ে গেল আমার হৃদয়, ভালোবাসা,পড়াশুনা আর ঘুম। আজো আমি স্বভাবিক ভাবে ঘুমুতে পারিনা।

তখন আমার পার্ট টু পরীক্ষা। ওই মানসিক অবস্থাতেই আমি পরীক্ষায় বসলাম এবং পাশও করে গেলাম। ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করার পর অখণ্ড সময় আমার কাটতে চাইত না। সেই সময় আমি প্রচুর পড়া শুনা করতাম। শ্রীমদ্ভগবদগীতা,

উপনিষদ ,বেদ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ,বিভূতি ভূষণ, জীবনানন্দ , কাজী নজরুল, মুন্সী প্রেম চাঁদ শেক্সপিয়র ,ম্যাক্সিম গোর্কি, লিও তলস্তয়,নিকোলাই অস্তভস্কি, নিকোলাই গোগোল ,কার্ল মার্কস, যা পেতাম তাই পড়তাম।

ওই রকম সময়ে আমি আমাদের গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরে একটা আশ্রমের সন্ধান পাই। গ্রামটার নাম পলাশডাঙ্গা। কিন্তু রাস্তা খুব খারাপ। পুরো ধানক্ষেতের মাঝে যে আল গুলো আছে ওতে সাইকেল চালান খুব মুশকিল ছিল। যা শুনেছিলাম তার চেয়েও অনেক খারাপ রাস্তা। যাই হোক এ ঘণ্টার পথ তিন ঘন্টা লাগলো। অবশেষে পৌঁছলামআশ্রমে। ওখানে আখড়া বলে। মস্ত একটা খোলা গেট ,না কোনো লোহা বা কাঠের নয়।বাঁশ দিয়ে তৈরী ওপাশ থেকে এপাশ ওপরে বাঁশের বাখারি বেঁকিয়ে বাঁধা আর তার উপপর একটা মস্ত মাধবী লতা গেটের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে গিয়ে মিশে একটা অদ্ভুত সুন্দর গেট তৈরি হয়েছে । আমি আখড়ার ভেতরে ঢুকলাম। মাঝে মস্ত বড় উঠোন আর তার দুপাশে খড়ের চালে ছাওয়া মাটির বাড়ী। গোবর নিকানো উঠোন ঝক ঝক করছে , দেয়াল গুলিও খুব সুন্দর করে লেপা ।

 

আমি উঠোনের পাশে আমার সাইকেল রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম । হঠাৎ এক মধ্য বয়সী মহিলা রে রে করে তেড়ে এলেন। তার প্রশ্ন বান শুনে ভাবছিলাম কোনটার উত্তর দেব ? আমি কে ?কেন এসেছি? কোথায় থাকি ? এখানে কাকে চাই ? আমি খুব বিব্রত বোধ করছিলাম। কি যে বলি আর কোন কথাটা দিয়ে শুরু করি –ঠিক সেই সময় ঘরের ভেতর থেকে গেরুয়া শাড়ি পরা এক অপরূপ মহিলা এসে ওই মহিলাকে থামালেন । ভদ্র মহিলা অসমান্য রূপসী। কপালে তিলক । নাকে রসকলি । উনি মৃদুস্বরে বললেন– এখানে কাউকে খুঁজছো বাবা ? আমি বললাম–না না ! আমি এমনি আশ্রম দেখতে এসেছি।

ভদ্র মহিলা বললেন—কোথায় থেকে এসেছ তুমি ? আমি আমাদরে গ্রামের নাম বললাম। উনি শুনে অবাক বিস্ময়ে বললেন— সে তো অনেক খানি রাস্তা !

বস বস বাবা । উঠোনের মাঝে একটা মস্ত বকুল গাছ আর তার গোড়াটা লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । কি রমণীয় পরিবেশ। খুশিতে আমার মন ভরে গেল। আমি বললাম– এই বকুল তলায় বসি ?

উনি বললেন–হ্যাঁ হ্যাঁ বোস বাবা। তুমি বোস আমি তোমার জন্য জল নিয়ে আসি । তারপর আমি ওখানে অনেক ক্ষণ থাকলাম। আমাকে ওঁরা জল খাওয়ালেন –এবং খাবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করছিলেন, কিন্তু আমি মায়ের কথা বলে চলে আসার অনুমতি পেলাম। একটা জিনিস লক্ষ করলাম আশ্রমের সকলেই –সখী মা -বলে ডাকছে ।

এ ভাবেই আমার সখীমা-র সাথে পরিচয়। আমার সেই সময় আমার মনের যা অবস্থা — তখন সখীমার সঙ্গে পরিচয়

আর এই আশ্রমিক পরিবেশ আমাকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল। এ ভাবেই আমার সখীমার সাথে পরিচয়। অনেক স্নেহ অনেক ভালবাস পেয়েছিলাম সখী মা-র কাছে।

এর পর আমি বেশ কয়েকবার ওই আখড়ায় গেছি। সখীমার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আর অবাকও হয়েছি তার জীবন কাহিনী শুনে। সখীমা মেট্রিক পাশ। স্বামী সরকারি চাকরি করতেন।সন্তান আছে। এই বাবাজী! মানে যার সাথে ঘর সংসার ছেড়ে এই আখড়ায় আসেন। অতো সুন্দরী যুবতী স্বাস্থবতী মহিলা এবং রীতিমত বনেদি বাড়ীর গৃহ বধূ হয়ে এই আখড়ায় কেন এসেছে ? এর কোন উত্তর আমি খুঁজে পাইনি । কেননা বাবাজী আদৌ কোন সুন্দর নয় ব সু গায়কও নয়। আমি ওনার অনেক গান শুনেছি।অতি বাজে কর্কশ কণ্ঠ।

 

একদিন আমি আখড়ায় ছিলাম আর বাবাজীও ছিলেন। সকাল দশটা সাড়ে দশটা হবে। দেখলাম লম্বা বারান্দায় শতরঞ্জি পেতে গানের আসরের ব্যবস্থা চলছে। উনি বললেন — এসো এসো বস। বাউল গান ভালো লাগে? আমি হেসে ঘাড় নাড়লাম। একজন শ্রীখোল নিয়ে বসেছে,একজন মন্দিরাআর দুজন একজন খমক,

আর দোতারা। বাবাজীর হাতে একটা একতারা। প্রথমে গৌর চন্দ্রিকা তারপর বাবাজী গান ধরলেন লালন সাঁইয়ের —“আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময় –পারে লয়ে যাও আমায় —

এতো কর্কশ আর বেসুরো গাইছিলেন যে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমি

হঠাৎ আমি বাবাজীর সাথে গানটা ধরলাম।

দেখলাম সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে। আমি তখন চোখ বন্ধ করে গাইছিলাম — আমি অপার হয়ে বসে আছি — ও হে দয়াময় পারে লয়ে যাও আমায় —

একা আমি রইলাম ঘাটে ভালো সে বসিল পাটে । ওগো তোমা বিনা ঘোর সংকটে

না দেখি উপায় —

পারে লয়ে যাও আমায় —-

নাই আমার ভজন সাধন

চিরদিন কু পথে গমন

ওহে নাম শুনেছি পতিত পাবন

তাই তে দেই দোহাই

পারে লয়ে যাও আমায় ।

অগতির না দিলে গতি

ঐ নামে রহিবে অখ্যাতি

লালন বলে অকুলের পতি

কে বলবে তোমায় —

পারে লয়ে যাও আমায় ॥

 

গান শেষ হলে সবাই তালি দিল,খুব খুশি বিশেষ করে সখীমা খুব খুশি। সখীমার কণ্ঠও কিন্তু ভারি চমৎকার কেননা আমি যখন গাইছিলাম তখন সখীমাও সাথে গাইছিলেন।

 

 

…….. চলবে……..

 

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত