জীবনের গল্প

ফেলে আসা দিন ও আজ-২ || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

আমরা হাত ধরাধরি করে নদীর বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলাম বাড়ীর দিকে। আমরা বাড়ীর খুব কাছে এসে পড়েছিলাম। আমি একটানে নন্দিনীকে আমার দিকে টেনে কিস করতে শুরু করলাম ,আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলাম।আমি হঠাৎ ওর বুক চেপে ধরলাম এবং খুব জোরে জোরে চিপতে লাগলাম,আমরা উত্তেজনায় হাঁপাছিলাম। নন্দিনী ফিসফিস করে বলল –ছাড় ছেড়ে দে ! আমার লাগছে ,চল বাড়ি প্রায় এসে গেছি। আমি আরেকবার ওকে চুমু খেলাম তারপর আমরা বাড়ীর পথে হাঁটা দিলাম।

 

আমার সামনে পরীক্ষা অথচ মনটা ঠিক মতো কনসেন্ট্রেট করতে পারছিলাম না।

আমি ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধে পুড়ে যাচ্ছিলাম। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল এটা ঠিক হচ্ছে না। এ অন্যায় ,এ পাপ -এ আমি কি করছি। নন্দিনী কেন এলো ? আমি তো বেশ ছিলাম। আমার ছেলেবেলা , আমার গাছ গাছালির প্রেম, আমার মায়ের আশা আকাংখা ,আমার ভবিষ্যৎ ! আমি কেমন ম্রিয়মান হয়ে পড়ছিলাম। আমার কিছু ভালো লাগছিল না । আমার পড়ায় মন বসছিল না । এই সব ভাবতে ভাবতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ।

 

আমার ঘুম ভাঙ্গলো নন্দিনীর ডাকে

ও আলতো করে আমার কপালে হাত রেখে বলল –কি রে অসময়ে ঘুমুচ্ছিস?

 

আমি উঠে বসলাম । ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে কিস করে বলল –কি রে শরীর খারাপ নাকি ? আমি নিজেকে ওর হাত থেকে ছড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম –ওকে বললাম —ইয়ে ! মানে তোর সাথে কথা আছে ! তুই দুপুরে আমার রুমে আসবি ? ও বলল –কেন বলতো ? কেউ বুঝতে পেরে গেছে ? আমি বললাম –না না -আমি তোর সাথে কথা বলতে চাই ।

ও কেমন ঘাবড়ে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ , তারপর বলল –তোর কি হয়েছে বলতো ? তুই কি আমাকে ভালোবাসিস না ? না কি অন্য কিছু?

আমি কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে।

 

কিচ্ছু ভালো লাগছে না । আমি বাগানে গিয়ে আম তলায় বসলাম একটা বেলে পাথরের উপর। হঠাৎ ঈশ্বরের মতো মা এসে দাঁড়াল আমার কাছে। আমি আদুরে গলায় ডাকলাম –মা ! মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জীজ্ঞেস করলো–কি রে দিনু শরীর খারাপ? আমি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললাম। মা হতচকিত হয়ে শুধালো –কি হয়েছে ? খিদে পেয়েছে ? খাবি কিছু ? আমি মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম কিন্তু মাকে বলতে পারলাম না কিছু। মা আর কিছু বলল না।

কেবল বলল —আমার দিনু কখনো খারাপ কাজ করতেই পারেনা। চল বাড়ির ভেতরে চল । এই কথাটা চাবুকের মতো পিঠের চামড়া কেটে বসে গেল ।

মা-র কি অপরিসীম বিশ্বাস ! আমার হৃদয় ভিতরে ভিতর জ্বলে যাচ্ছিল, আমি মা-কে কি করে বলি ? যতক্ষণ না পর্যন্ত মাকে বলতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত মন কেমন আনচান করছে। সমগ্র পৃথিবীর কাছে নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে। এক মাত্রে মা-ই পারে আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে ।

 

কিন্তু মা -কে কি ভাবে বলবো এই লজ্জার কথা ! ঘৃণার কথা ! তবুও মা-ই

একমাত্র ভরসা। সুতরাং মা-কেই বললে

এই মনস্তাপ,এই মনবেদনা,এই আত্ম- গ্লানি থেকে মুক্তি পাবো। অতএব এটাই

আমার বাস্তব সম্মত হলো। আমি মাকে ডাকলাম বার দুয়েক। কোন সাড়া পেলাম না। আমি নিজেই উঠে রান্না ঘরে গেলাম ,দেখলাম মা উনুনের কাছে বসে আর মা-র চোখে জল। আমি মায়ের গলা ধরে জীজ্ঞেস করলাম –কি হয়েছে ? মা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল –কিছু হয়নি, চা খাবি ? আমি বললাম– না মা আমি চা খাবো না। আমি একটু কথা বলতে চাই ।

মা আমার মুখের পানে চেয়ে বললে–বল ! এখানে নয় আমার পড়ার ঘরে তুমি এসো একবারটি। মা উনুন থেকে কড়াইনামিয়ে রেখে বললে– চল ! মা আমার পড়ার ঘরে আসা মাত্র আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলাম একদম শিশুর মতো মাকে জড়িয়ে ধরে। মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধাল–কি হয়েছে ? আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক কষ্টে মায়ের কোলে আঁচলের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে বললাম —–মা আমি নন্দিনীকে ভালোবাসি –! মা কিছু না বলে আমার চোখে হাত দিয়ে দেখল –আমি কাঁদছি। মা করুণা মাখা কণ্ঠে খুব মৃদু সুরে বললে—ভালো তো! এতে তো কোন পাপ নেই ? আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। কি করে কোন মুখে বলি যে আমি এই সব করেছি। আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম -তারপর বললাম মা আমাকে ক্ষমা করে দাও ! আমি খুব খারাপ ছেলে, আমি আর কোনোদিন ভালো হতে পারবো না। মা তো ! এতেই সব বুঝে গিয়েছিল। আমায় শুধু বললে তুমি এখনো বড় হওনি, তাই তোমার কোন পাপ নেই ,

এমন কিছু করিস না যার জন্য সারা জীবন বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। ঠিক আছে লক্ষী সোনা ছেলে। আমার ভিতর তখন উথালপাথাল করছে। কি যেন হৃপিণ্ডের কাছে আটকে আছে। আমি মৃত্যু কি তা জানিনা, কিন্তু আমার মনে হয় আমি সেদিন ক্ষণিকের তরে হলেও মরে গিয়েছিলাম। মা আমাকে আনেক আদর করে উঠে গেল। বলে গেল–সংযমী হও,

ভালবাসার মর্যাদা দিতে হয়। কামনা কিন্তু ভালবাসা নয়। ওটা মোহ। মোহ মুক্ত হলেই দেখবি আর খারাপ লাগবেনা। মা চলে গেল নিজের সংসারের কাজে। আমার মায়ের গানের গলা খুব মিষ্টি ছিলো। মা রান্না ঘরে বসে গুনগুন করে গাইছে —

” মন চল নিজ নিকেতনে ,

সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে

ভ্রম কেন অকারনে ।

মন চল নিজ নিকেতনে ।

আমি মায়ের গানটা শুনছিলাম আর অঝোরে কাঁদছিলাম। আমার সমস্ত পাপ ,সমস্ত তাপ গলে গলে পড়ছিল আমার দুচোখ দিয়ে। আমি অনেকক্ষণ নিস্তেজ নির্মোহ,নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে রইলাম।

মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। তখন প্রায় বেলা দুটো হবে। মা খুব তাড়া দিতে লাগলো। — বাড়ীর সবার স্নান খাওয়া হয়ে গেল। কি ছেলেরে তুই ? যা চটপট স্নান করে নে ,আর কখন খাবি বলতো? আমি দৌড়ে গেলাম স্নান করার জন্য। আমার ভাইপো ছিলো আমার খুব অনুগত। ও বলল–ছোটো কাকু তুমি কলের নিচে বোস

আমি পাম্প করে দিচ্ছি। আমি চাপা কলের মুখে বালতি রেখে বললাম–নে জোর লাগিয়ে পাম্প কর ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে ।

 

ঠিক তিনটে বাজে, হঠাৎ আমার বিনির কথা মনে পড়ল। বিনি আমার বাল্যকালের সাথী। আমরা একসঙ্গে বড় হচ্ছিলাম। পড়তামও এক সাথে। বিনি পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো। কিন্তু গ্রামের স্কুলটা যেহেতু ক্লাস এইট অবধি ছিলো তাই আর ওর পড়া হলোনা। কিন্তু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো বিনি। ও আজো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু ওর আর আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিলো –এতো বন্ধুত্ব সত্বেও

মাসে কুড়ি দিন আবার কখনো কখনো দুমাস তিনমাস কথা থাকত না। আড়ি হয়ে যেত। আমার কেমন যেন মনে হলো বিনির

সাথে কথা বললে হয় ! অথচ তখন তো আমার সাথে ওর আড়ি ছিলো। তবুও আমি গেলাম। দুপুর বেলা ,গরমকাল জানলা দরজা সব বন্ধ। আমি যথারীতি পাঁচিল টপকে ওদের বাড়ীর উঠোনে নামলাম। দেখি সবাই ঘুমুচ্ছে। আমি ওর খাটের কাছে গিয়ে ডাকলাম— এই বিনি ওঠ ! হঠাৎ ওর মা জেগে উঠে আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন—কি রে তুই এই ভর দুপুরে কি করছিস? দরজা তো বন্ধ ছিলো!

তাহলে তুই আবার পাঁচিল টপকে ঢুকেছিস।

কি ডানপিটে ছেলেরে বাবা! ওকে ওঠাচ্ছিস

কেন ? আমি বললাম– খুব দরকার আছে।

ইতমধ্যে বিনি উঠে গেছে । উঠেই শাড়িটা ঠিক করে নিল। আমার সাথে একটাও কথা বলল না। আমি লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম–চল কুয়োতলায় বসব। কথা আছে। ওর মা ঘুমের ঘোরেই বললেন–এই দুপুর রৌদ্রে কুয়োতলায় কি দরকার? আমি কোন উত্তর না দিয়ে বিনিকে বললাম চল না দরকার আছে।

ও খুব রেগে ছিল। তবুও আমার পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। আমি কুয়ো তলার শান বাঁধানো জায়গাতে বসলাম।তখনও

বিনি আসেনি। মেয়েদের অনেক মেয়েলি ব্যাপার থাকে । আমি ওকে আবার ডাকলাম–অ্যাই বিনি ! আসার সময় এক গ্লাস জল নিয়ে আসবি।খানিক পরে ও

এলো জলের গ্লাস নিয়ে। আমি বললাম বস ! কথা আছে। বিনি এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবার রাগত বিড়ালের মতো মুখ ফুলিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল–কেন ? এই তিন দিন কোথায় ছিলি ? ওই মেয়েটার সাথে রাত অবধি নদীতে বসে আড্ডাদিচ্ছিলি , লজ্জাও করেনা ! আমি খুব জোর দিয়ে বললাম —-তোর তাতে কি নেংটি ইঁদুর ? ও আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠল— তাহলে এসছিস কেন হুলো বেড়াল।

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত