জীবনের গল্প

আত্মকথা-২ || মানজারুল ইসলাম দুলাল

চর থেকে বিদায় নিয়ে আসলাম কারণ লেখাপড়া করতে হবে। ইস্কুলে ভর্তি হলাম সন্ন্যাসীকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।আমার লেখা পড়া ভাল লাগতো না শুধু ঘুরতে ভাল লাগতো। বিকেল হলে নদীর পারে যেতাম ভাল লাগতো নদীর স্রোতমাখা ঢেউ এর খেলা দেখে সন্ধ্যা হলে বাসাতে ফিরে আসতাম। এভাবে একাকি চলছে জীবনের দিনগুলী বন্ধু বান্ধব ছিল শুধু খেলা ধুলার ক্ষেত্রে কোথাও ঘুরতে নয়।১৯৯৮ সাল টি ছিল আমার জীবনের একটি বিয়োগান্ত সময়। এই সময়ে বন্যায় কবলে পরে আমাদের বাড়ি ভাঙতে হলো, এই বন্যাটি ছিল দীর্ঘায়ু।পুরো এলাকায় বন্যার পানি দ্বারা আচ্ছাদিত, রাস্তাঘাট ভেঙে মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যাহত হয়, নৌকা ছাড়া যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিল না।

 

যাক অবশেষে আমরা একটি আরডিআরএস এর মাঠে কিছু উচু যায়গা থাকাতে আমাদের বাড়ির ক্ষনস্থায়ীর জন্য ঐখানে তোলা হল। আমার বাবা ছিল একজন ব্যবসায়ী আমরা সাত ভাই সাত বোন ছিলাম আমার মা ছিল দুই জন আমি বড় আম্মার কাছে থাকতাম। আমার মা থাকতো চরে, আমি মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম। আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার বাবা আমাকে আমার বড় ভাবির কাছে তুলে দেয় আমাকে মানুষ করে গড়ে তুলতে। আমার ভাবির নাম হোসনে আরা বেগম আর বড় ভাই হল আজিজুল হক বিডিআর, তাদের কোন ছেলে সন্তান ছিল না শুধু একটি মেয়ে ছিল তাই ভাবি আমাকে তার সন্তানের মত করে লালন পালন করতো। তার বুকের স্তান আমাকে পান করিয়ে আমাকে বড় করেছে আমি সারাটি জীবন তার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো।আমার বড় হওয়ার প্রতিটি ধাপে ধাপে তার অবদান অপরিসীম।

 

যাক বন্যার মধ্যে মন সব সময় ভাল থাকে না, কোথাও ঘুরে শান্তি নেই। শুক্র বার রাত ২টা হবে আমি মা আর বাবা একই ঘরে শুয়ে আছি হঠাৎ বাবা ঘুম থেকে জেগে মাকে বলছে আমার ভাল লাগছে না, শরীর প্রচন্ড গরম লাগছে তখন মা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলো আবার বলল আমি বাহিরে যাব আমার শরীর অস্তির লাগছে তাকে বাহিয়ে এনে উঠানে বসিয়ে সকলে বাতাস করতে লাগলো। কিছু সময় পর তার শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে গেল কিন্তু তার মুখে কোন কথা নেই

কিছুক্ষন পর বমি করতে লাগলো তখন প্রায় রাত তিনটা বাজে কোথাও নেয়ার কোন যায়গা থাকলেও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো। আবার কিছু সময় পর তিনি প্রকৃতির ডাকে সারা দেন।আমরা সকলে দিশেহারা হয়ে গেলাম কিছুই বুঝতে পারছিলাম। এই ভাবে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে নৌকাতে করে সদরে নেয়ার বন্দোবস্ত করা হল কিন্তু ভাগ্য বড় কঠিন নিষ্ঠুর আচরণ করলো, কিছু সময় পর যখন নৌকা ফিরে এলো তখন কারো বুঝতে বাকি রইল না। সারা বাড়ির কান্না ঢল পরে গেলে আমি ছিলাম ছোট সাত বছর হবে আমি বুঝতাম না তাদের কান্না যখন তারা আমাকে জড়িয়ে কান্না করতো আমি তাদের সাথে কান্না করতাম ।

 

সেই দিন বুঝতে পেরেছি আপন জনের হারানোর কি ব্যথা, সেই দিন থেকে আমার বাবা ডাকটি হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। বাবার আদর কি আমি জানি না তার শাসন কি আমি জানিনা। আমি নিঃস্বগতায় ভুগী একাকিত্ব আমার কষ্টগুলো কেউ বোঝেনি আমার দুঃখগুলো কেউ বুঝতে চেষ্টা করেনি। আমি প্রতিটি ধাপ অনেক কষ্ট করে পারি দিয়েছি। গুরু জন চলে গেলে পৃথিবীতে কষ্টগুলো আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারিনা স্বপ্নেএসে দেখা দাও, দুঃখ টাকে আরো বাড়িয়ে যাও।

 

পৃথিবীর আলো আমি দেখিয়াছি

তোমার ভালবাসা বঞ্চিত থেকে।

শৈশব কাটিয়েছি ভাবির কাছে

শাসন পেয়েছি বড় ভাইয়ের কাছে

তবুও তোমার জন্যই কাদি

হে আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা।

একবার কেঁদে ছিলাম বলে

কত খেলনাই না দিয়েছিলে মোরে।

এখন কত বার কাঁদি, গভীর রাতে

তবুও দাও না কেন মোরে।

 

(চলবে)

 

রাজিবপুর,কুড়িগ্রাম