প্রায় দুইবছর শ’খানেক দিন পর ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে জয়। উদ্দেশ্য এই শীতে গ্রাম দেখবে, সাথে মায়ের হাতের পিঠা খাবে। জয়দের বাড়িটা একদম অজপাড়াগায়ে। যেখানে এখনো এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক এবং ঠিকঠাক শিক্ষা, কোনোটাই প্রবেশ করেনি। কিন্তু কমদামি চায়না ফোনের কল্যানে সবার হাতে হাতে ফেসবুক আর বাংলা সিনেমা। জয় ভুলেও ভাবেনি গ্রামে তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে। ভাবলে সে এখানে আসার আগে অন্তত হাজার বার চিন্তা করতো।
__________
জয় একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি। আইডির নাম জয়নাল আবেদীন। ফেসবুকে নিয়মিত গল্পটল্প লিখে হাজার দেড় দুই লাইক কমেন্ট পায়। জয়ের বাল্যকালের স্কুলফ্রেন্ড রনি, শিহাব, টিপলু এরা গ্রামে ছোটখাটো কাজ করে এবং রাতে ফেসবুকে এসে জয়কে মেসেজ দিয়ে প্রায় পাগল করে ফেলে। হাজার হাজার সুন্দরীর মেসেজ সিন করে রাখা জয় ভদ্রতার খাতিরে বন্ধুদের মেসেজের রিপ্লাই করে। হাজার হলেও ছোটবেলায় একসাথে কত সময় কাটিয়েছে।
__________
জয়ের গ্রাম্য বন্ধুরা ফেসবুকের বিশেষ এক সমাজের প্রতিনিধি। যাদের প্রধান কাজ সারাদিন যা যা করে সবকিছু বাংলিশ ভাষায় লিখে পোস্ট করা, রেডিওমুন্নার পেজে গিয়ে আমিন লিখে আসা, এবং অতি অবশ্যই সাকিবের ছবিতে কমেন্ট করা, ‘সাকেব তোমার বউ পার্দা কুরেনা কানো।’
কিন্তু এগুলো কোনো ঝামেলা না। ঝামেলা হলো ওদের কোনো ধারণাই নেই যে ফেসবুকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখা যায়। ওদের ধারনা জয় প্রতিদিন যেসব বিশাল বিশাল স্ট্যাটাস লিখে পোস্ট করে সেগুলা তাদের বাংলিশ স্ট্যাটাসের মতই সত্যি কাহিনী। জয়ের দৈনন্দিন জীবনের গল্প।
___________
ঘটনার শুরু এখান থেকে। জয়কে গঞ্জের স্টেশন থেকে পিকআপ করে নিয়ে যেতে আসলো শিহাব আর রনি। ট্রেন থেকে নেমে জয় হাত নাড়লো। শিহাব এসে জয়ের ব্যাগ কাধে নিতে নিতে বললো, ‘দোস্ত একাই আইলা, ভাবি কই? ভাবিরে আনলা না?’
জয় অবাক হলো, `ভাবি?’
– হ, ভাবি। আমরা কিছু জানি না ভাবছো? আমরা তুমার সবকিছু পড়ি। সুমা ভাবিরেও আমরা চিনি। যার বাপের হাতে আরেকটু হইলে তুমি মরতে গেছিলা। পরে উনি নিজে মাইয়ারে তোমার সাথে বিয়া দিলো।
– সুমা ভাবি? হোয়াট? ওহ সোমা!
হঠাৎ করেই মনে পড়লো জয়ের। কয়েকমাস আগে সোমা নামের এক চরিত্রকে নায়িকা করে উত্তম পুরুষে একটা গল্প লিখেছিলো জয়। যেটাতে সোমার সাথে শেষে ওর বিয়ে হয়। এই গাধারা গল্পটাকে সত্যি হিসাবে ধরে নিয়েছে।
ও বললো, `দেখ, তোরা যা ভাবছিস তা না। সোমা নামে কেউ নাই।’
– কেন? তালাক হয়ে গেছে নাকি?
– উহু তা কেন হবে?
– তাইলে থাকবো না কেন? ভাবি রাগ করে বাপের বাড়ি গেছেগা?
উফ, জয় ভাবলো এদের সাথে তর্ক করাই বেকার। যত্তসব গাধার দল। তারচে টপিক চেঞ্জ করে ফেলা ভালো হবে। জানতে চাইলো, এলাকার সবার কি খবর?
রনি বললো, এলাকার খবর ভালোই, কিন্তু তুমার মা তুমার উপর হেব্বি ক্ষেপে আছে।
– কেনরে? কি হইলো!
– সেটা গেলেই দেখবা।
__________
জয় বাসায় পৌছে আম্মাকে সালাম করতে উদ্যত হলো। জয়ের আম্মা সালাম গ্রহন না করে উল্টাদিকে ঘুরে গেলেন। অবাক হলো জয়।
– আম্মা কি হইছে তোমার? আমি এতোদিন পর আসছি তুমি খুশি হওনি?
জয়ের মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, ‘খুশি ক্যামনে হমু, হা? আমার কি আর সেই কপাল আছে। একটামাত্র পুলা আমার, আমারে না জানায়ে বিয়ে করে ফেলে। শহরে একা একা ঘর সংসার করে। আমরা গ্রামে থাকি বইলা বউমার পরিবারের সাথে আমাগোর পরিচয় করায়ে দিতে শরম পায়। এরম পুলা ধরছিলাম আমি পেটে। সবই আমার কপাল। দুই মাস আগে বিয়া হইছে আর আমি শুনলাম কালকা রাতে। এইটা শুনার আগে আমার মরন হইলো না ক্যান?’
জয় রেগেমেগে বন্ধুদের দিকে তাকালো।
টিপলু নিজের কান ধরে বললো, ‘স্যরি দোস্ত আমরা বলতে চাইনাই। এতোদিন লুকায়েই রাখছিলাম। কাল ভাবলাম তুমি হয়তো ভাবীরে নিয়া আসবা। তাই কাকীমারে আগে আগে বইলা রাখছি। না বললে দেখা যেত তুমার বউরে দাবড়ানি দিছে। কিন্তু তুমি তো ভাবীরে আনলাই না। আমরা তোমার ভালোই চাইছিলাম কিন্তু।’
– হোয়াট দ্যা ফাকিং ভালো চাওয়া, জয় রাগের চোটে কি বলবে ভেবে পেলো না।
রনি এবার জয়ের আম্মার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চাচী, পোলা ভুল কইরা ফেলছে এ নিয়ে আর মনে কষ্ট পাইয়ো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।’
জয়ের অবাক চোখের সামনে দিয়ে জয়ের আম্মা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেলো।
__________
মায়ের রাগ ভাঙাতে দুইদিন লাগলো জয়ের। কিন্তু বিশ্বাস করাতে পারলো না যে সে বিয়ে করেনি। গ্রামের সব মানুষ কি আর মিথ্যা কথা কয়? এই হলো তার মায়ের যুক্তি। শেষমেশ ব্যাপারটা মেনে নিয়ে মাফ চেয়ে ঝামেলা মেটালো জয়। শালার অশিক্ষিত ক্ষ্যাত ফাউলগুলা ওর লাইফ হেল করে দিলো। বন্ধু নামের কলংক যত্তসব।
_________
দুইদিন পর।
জয় তার ভক্তদের অনুরোধে গ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিলো। যার নাইন্টি পার্সেন্টই বানানো। তিনবেলা মজার মজার পিঠা খাওয়া আর সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখার সাথে সাথে জয় পোস্টের মধ্যে একটা অদ্ভুত কাহিনী এড করে দিলো। স্ট্যাটাসটা ইন্টারেস্টিং বানানোর জন্য।
জয় লিখলো, `গ্রামে একটা ফকির বাবা আছে। যিনি জয়ের হাত দেখে বলেছেন জয় নাকি একজন সিরিয়াল কিলার। সে শহরে অনেকগুলো খুন করে এসেছে।’
__________
পরদিন দুপুরে জয় অবাক হয়ে দেখলো রনি টিপলু সহ আরো কয়েকজন যুবক তার বাড়ির সামনে। যুবকদের সাথে দড়ি দিয়ে বাধা একজন বৃদ্ধ লোক।
ও বের হতেই রনি এগিয়ে আসলো, ‘হালা রমজান ফকির তোর হাত দেইখা উল্টাপাল্টা কথা কইছে, না? হালারে হেব্বি মাইর দিছি। হালায় শহর থেকে কেউ আসলেই তারে শান্তিতে থাকতে দেবেনা। উল্টাপাল্টা কথা বলে ভড়কে দিয়ে টাকাপয়সা নেয়ার ধান্ধা করবে। তুই কোনো টাকাপয়সা দিসনি তো?’
– না, কিন্তু, ইয়ে মানে..
– কোনো কিন্তু না। দিসনি বাইচা গেছস। হারামী একটা ফ্রড। এতো মাইর দিলাম তাও স্বীকার করেনা। বলে তোরে নাকি সে দেখেই নাই। কতবড় মিথ্যুক দেখছোস?
_________
জয় কি বলবে ভেবে পেলোনা। এগুলো কি হচ্ছে ওর সাথে। এখন এই ছেলেগুলারে বুঝানোও সম্ভব না যে জয় যা লিখেছে সেটা সত্যি না। বিয়ের ঘটনায় ও এই জিনিস অন্তত বুঝেছে। এদের মাথায় একবার যা ঢুকবে তো ঢুকবেই। জয় বুদ্ধি করে বললো, রমজান ফকিরের কোনো দোষ নাই। আমিই ওর কাছে গেছিলাম হাত দেখাতে।
তারপর বন্ধুদের বিষদৃষ্টির সামনে দিয়ে রমজান ফকিরকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে বিদায় করলো।
__________
আর না, জয়ের বহুত শিক্ষা হইছে। ও কান ধরে শপথ করলো গ্রামে থাকতে থাকতে আর কোনো স্ট্যাটাস দিবে না। গল্পও লিখবে না। শহরে ফিরে গিয়ে লেখালেখি শুরু করবে আবার। তবে তার আগে এই গাধাগুলোরে অবশ্যই ব্লক দিয়ে নেবে।
__________
একসপ্তাহ বেশ ভালোভাবে গ্রামে কাটালো জয়। এবারে একটু বেশি শীত পড়েছে। সারাবছর ঢাকায় প্রচন্ড গরমে কাটানো জয় তাই শীতটা বেশ ইঞ্জয় ই করলো। আর একদিন পর ঢাকায় ফিরবে ও। এমন সময় ঘটলো ঘটনাটা।
__________
রাতে ফেসবুকে ঢুকে জয় দেখলো একটা পেজে গল্প লেখা প্রতিযোগীতার ফলাফল দিছে। আর সৌভাগ্যক্রমে জয় ফার্স্ট হয়ে গেছে। প্রথম হওয়া সেই গল্পটা আবার পেজ থেকে পোস্ট করে ওকে ট্যাগ করে দিয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে বাধ্য হয়েই ট্যাগ এপ্রুভ করতে হলো জয়ের।
__________
কমেন্টে অনেকগুলো অভিনন্দনের জবাব দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো জয়। মাঝরাতে প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে একসাথে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গেটে শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ কিছু দিয়ে আঘাত করছে। চোখ মুছতে মুছতে বিছনা থেকে নেমে গেট খুলতে গেলো জয়। হঠ্যাৎ একটা হাত শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরলো। অন্ধকারে কেপে উঠলো জয়। জয়ের আম্মা হাত ধরে ফিসফিস করে বললো, `ওরা তোরে খুঁজতাছে। সাগরের বইন গলায় ফাস নিছে একটু আগে নাকি তোর লাইগা। তোরে খুন কইরা ফেলবো ওরা, খুন কইরা ফেলবো।’
__________
কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাভাবনা করার সমস্ত ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো জয়। তারপর বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়লো আজকে এপ্রুভ করা গল্পের কাহিনীটা। বড়লোকের এক ছেলে গ্রামের এক নিরীহ মেয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় করে শারীরিক সম্পর্ক করে। তারপর ধোকা দেয়। সেই দুঃখে আত্মহত্যা করে মেয়েটা। মেয়েটার নাম থাকে সাবরিনা।
জয় ফিসফিস করে জানতে চায়, `সাগরের বোনের নাম কি?’
জয়ের আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বলে, `সাবিনা।’
__________
বাইরে কোলাহল আরো বেড়েছে। বাইরের গেট ভেঙে পড়ার প্রচন্ড শব্দ হয়। এই ভীষণ শীতের রাতেও কুলকুল করে ঘামতে থাকে জয়।
আপনার মন্তব্য লিখুন