সাহিত্য বার্তা

আহ্ জীবন | মেহেদী হাসান তামিম

গল্পের জন্য ছুটতে পারি আরো কয়েক পৃথিবী, আরো অসংখ্য জীবন। এমনকি স্বজন বন্ধু সমাজ সংসার রুটি রুজি রোজগার সবকিছু তাচ্ছিল্য করে, তাদের বিনিময়েও…

গল্পের মানুষগুলো, তাঁরাই প্রতি পদে-পদে লড়াই করে আমাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, ভেতরের আমিটাকে দেখিয়ে দিয়েছে, তাঁরাই আমাকে চিনিয়েছে— ওটা যুদ্ধ, এটা প্রেম-ভালোবাসা, ওটা স্বপ্ন, ওই যে দেখছ পতপত করে উড়ছে— ওটাই বিজয়, আর এই যে… এটাই বেঁচে থাকা।

এই মানুষগুলোর কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। আজকের আমি মেহেদী হাসান তামিম, জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা বলব, ‘আমার জীবনটাকে গল্পের কাছেই আমি উৎসর্গ করেছি।’

আরিচা ফেরিঘাটের ‘নেহাল মিয়ার ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ‘সয়ফুল ছড়াকার’কে কাস্টমার ডাকতে দেখেছি। উচ্চস্বরে কাস্টমারদের যখন ডাকে, তার চোখেও আমি স্বপ্নকে ছলছল করতে দেখেছি।

হাঁপানির টান আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ ভাঙা শরীরেই ‘বাক্সবন্দি পরম্পরা’কে কাঁধে বয়ে নিয়ে বেরোয় নিবারণ কাকা। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই একমাত্র সহায় ও সম্বল, চপ্পল-জুতা সেলাইয়ের সারঞ্জামাদিতে ঠাঁসা ওজনদার বাক্সটিই তার জীবন, তার বেঁচে থাকা – মরা। এখনো প্রতিদিন একই রুটিনে আমার অফিস হাউজ বিল্ডিংয়ের পূর্ব কোণাটায় সকাল সকাল এসে বসে। ‘কাকা, কেমন আছেন…’ জিজ্ঞেস করি, মুখে কিছু না বললেও মিটিমিটি হাসে। সেই হাসিটি আমার কাছে মোনালিসার হাসির থেকেও দুর্বোধ্য মনে হয়, অধরা ঠেকে। আমি নিশ্চিত হতে পারি না, তিনি ভালো আছেন কিনা!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছিলাম ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। হল থেকে হাইকোর্টের দিকের গেট দিয়ে ঢোকা বা বেরোবার সময় মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম ‘হুরমতি’দের। মেয়েটা বাপের গায়ের রঙই পেয়েছে, মিশকালো। কালো সেই দুনিয়া থেকে হীরকৌজ্জ্বল আলো আমার চোখ আর হৃদয়কে ধাঁধিয়ে দিয়ে গেছে কতবার!

হলের বন্ধু ও রুমমেট ছিল ‘রোমান’। বন্ধুটির অন্তর বেদনা এখন যেমন ব্যথাতুর করে, ‘প্রীতিলতা’র প্রতি তার কোমল নিঃসীম প্রেমানুভূতিগুলোও আমাকে তুমুলই স্পর্শ করত।

‘মতি রাজাকার’ আমার গায়ের মানুষ। মানুষজন আজো তাকে তীব্র ঘৃণায় থুতু দেয়। তবুও মতি তার সাথে ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনা কাউকেই বলে না। মানুষের ঘৃণায়, প্রতিদিনই সে বহু বহুবার মরে যায়, তবু বলে না!

আমার প্রাক্তন অফিসের প্রধান সহকারী ‘কুব্বত আলী’র মৃত্যুর পর প্রথম প্রথম কয়েকবার তার স্ত্রী-কন্যার খোঁজ নিতে পেরেছি। সময়ের স্রোত আর ব্যস্ত জীবন, বহুদিন হলো আর কোনো খরব রাখতে পারেনি। তবে শুনেছি, তারা ভালো নেই।

বাদল – নিয়তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই খুব কাছের বন্ধু। ওদের জীবনের প্রতিটি খুনসুঁটি মনোমালিন্য, প্রতিটি ঝগড়া আর প্রতিটি কান্নার এক আজব আদিম সাক্ষী আমি।

আগারগাঁ পাসপোর্ট অফিসে নান্টু আর দালালির কাজ করে না। গায়ে ফিরে গেছে। জীবনের একমাত্র চাওয়া তার জিহ্বার হারানো স্বাদ আবার সে ফিরে পেয়েছে।

অশীতিপর বৃদ্ধা ‘মিনু খালা’ আর তার থেকে বয়সী খালু— দুজনের জীবনই আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটিতেই কেটে গেল।সারাবছরই সেখানে মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। তবে গেলবার কুরবানীর ঈদে ফ্ল্যাটটিকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখেছিলাম। ইংরেজী মিডিয়ামে পড়াশোনা করানো, বর্তমানে আমেরিকার গ্রীন কার্ডধারী ছেলে-মেয়েরা নাতি-নাতনী পরিবারসহ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বাবা-মার কাছে আসার সুযোগ পেয়েছিল। কয়েকদিন আগে খালুও মারা গেলেন। জানাযার নামাজে রীতি অনুযায়ী কাউকে মরহুমের পক্ষ হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়, দেনা-পাওনা পরিশোধের অঙ্গীকার করতে হয়। সেদিন নিকটাত্মীয় কেউ না থাকায়, না আসতে পারায়, দীর্ঘকালের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী হিসেবে দায়িত্বটি আমিই পালন করেছি।

অচিন স্বপ্ন, অজানা গন্তব্যের পথে’ এখনো অন্ধ হেঁটে চলা থামায়নি সদরুলরা। ছুক্কু মিয়া ঘুঘুডাঙ্গার একমাত্র জামে মসজিটির পেশ ইমাম। তবে দাঁড়ির শোক হুজুরে অন্তরে এখনো আসে। নীলা, রুমা, জীয়ন, নবাব, তুলসী বউদি, হারেছ চাচা, আজরফ মাস্টাররা, এখনো ধুঁকে ধুঁকে জীবন চলেন, কেউ খুঁড়িয়ে, আবার কেউ কেউ প্রদীপ্তিতে।

এই জীবনের গল্পগুলোই #আহ্_জীবন।

গ্রন্থটির প্রতিটি মানুষ, এই জগত সংসারেরই। মানুষগুলো আমাদের চারপাশের-দূর বহুদূরের। প্রত্যেকেই চেনা-জানা, খুব কাছের, বাঁচতে চাওয়া আর বাঁচা কে বেচে, বেঁচে থাকা মানুষ। মানুষগুলো আমাদের ভীষণই পরিচিত।

পাঁচ বছর আগে শুরু করেছিলাম মানুষগুলোর গল্প লেখা। অবশেষে আল্লাহর রহমতে আজ প্রথমবারের মতো গুছিয়ে শেষ করতে পারলাম। বিন্দু বিন্দু পরিশ্রম, যত্ন আর ভালোবাসা নিংড়ে গড়ে তোলা গল্পগুলোই আমার বেঁচে থাকা।

আশা করছি, প্রিয় প্রকাশনী, ভালোবাসার ‘ঐতিহ্য’, আগামী একুশে বইমেলায় ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে, পাঠক বন্ধুদের হাতে, বই আকারে ‘আহ্ জীবন’ তুলে দিতে পারবেন। আমার তুমুল আনন্দ হচ্ছে। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল পর আজ শান্তিমতো বহুক্ষণ ঘুমাতে পারব।

সকলের কাছে নিবেদন, #আহ্_জীবন এর মানুষগুলোর সাথে থাকবেন।

মেহেদী হাসান তামিম
৭ডিসেম্বর১৯