এই মধ্যরাত্রিতে আমাদের বাস ছুটে চলছে ঘুমের চাদরে ঢেকে যাওয়া শহরের কালচে রঙা পিচ ঢালা পথ ধরে । ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিতে শহরের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে পিচ ঢালা এই পথটা । এই পথ ঘেঁষে টিন আর কংক্রিটে মোড়ানো দোকানগুলোও সারাদিনের ক্লান্তি শেষে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে । এই নিস্তব্ধ নির্জন রাত্রিতে আমাদের বাস চলার শব্দ কিংবা হেড লাইটের তীক্ষ্ণ আলোতেও ওরা চোখ খুলছে না । ইট পাথরের ধুলোমাখা ব্যস্ত এই শহরটা রাতের নিস্তব্ধতায় কেমন যেনো শান্ত হয়ে গেছে । শান্তশিষ্ট ঘুমিয়ে যাওয়া শহরটাকে জাগিয়ে রেখেছে শুধু ল্যামপোষ্টের বাতিগুলোই । ল্যামপোষ্টের বাতির সাথে শহরের অলিগলিতে জেগে আছে দলবেঁধে কয়েকটা কুকুর । হঠাৎ করে অনেক দূর থেকে ভেসে আসে বাশির শব্দ । এই বাশির শব্দ জানান দেয় এই শহরের বুকে আরো একজন নির্ঘুম থেকে এই শহরটাকে পাহারা দিচ্ছে ।
শহরের রাস্তা পেরিয়ে লোকারণ্য বিহীন সবুজের ছায়াঘেরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলছে আমাদের বাস।এই রাস্তার দুপাশের গাছগুলো মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে । হেডলাইটের আলোতে দুপাশের গাছগুলোর মাথা এলিয়ে ঘুমানোর দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে ওরা আমাদেরকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে ।
.
বাসযাত্রীদের কেউ কেউ হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে, কেউ কেউ জুতো খুলে সামনের সিটে পা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে, কেউ কেউ কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে, কেউ কেউ গল্প করতে করতে সময় পার করছে, কেউ কেউ জানালা খুলে উদাস মনে নানান হাবিজাবি কিছু ভেবে চলছে । রাতের এই প্রকৃতি দিনের কঠিন হৃদয়ের মানুষটার খোলস ভেঙে বাইরে নিয়ে আসে ভেতরের কোমল হৃদয়ের মানুষটাকে । বিষণ্ণ মনে সে ভেবে যায় কখনো না ভাবা ভাবনাগুলো । এমন কিছু নিয়েই সে ভাবে যা নিয়ে ভাবা যায় বলেও সে কখনো ভেবে দেখে নি । এলোমেলো সমস্ত ভাবনা … স্মৃতিকাতরতা আর কল্পনাই থাকে এই ভাবনাজুড়ে ।
এই বাসে আরো একজন মানুষ জেগে আছে যার গল্প কেউ বলে না, যার বেদনাভরা আকুতির কথা কেউ জানে না, যার বুকের ভেতর হাহাকারের শব্দ কেউ শুনে না । এই মানুষটা এক কঠিন দায়িত্ব পালন করছে । ঘুমিয়ে থাকা, গল্প করা, গান শোনা, ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব । জগতে দায়িত্ববানরাই থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে … নিতান্তই অবহেলায় ।
আপনার মন্তব্য লিখুন