অণুগল্প

আমি সে ও সুরঞ্জনা || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

অনিমেষ তো ভীষণ ছটফটে মানুষ।বাচ্চাছেলের মতো সারা ঘর তোলপাড় করে – যতক্ষণ ঘরে থাকে। গান শেখেনি, তবুও সকাল থেকে রাত কখনো রবীন্দ্র সঙ্গীত , কখনো গজল আবার কখনো নজরুল গীতি উচ্চ স্বরে গেয়েই চলে। সুরঞ্জনা চেনে তাকে ! সেই কবে থেকে সুখে দুঃখে একসাথে আছে –সেই বিয়ের পর থেকে ।

আজ ক’মাস অনিমেষ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে । সেই নায়ক নায়ক চেহরা কেমন ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে।

চার মাসে চার কিলো ওজন কমে গেছে।

সেই উদাত্ত কণ্ঠে গান নেই ,

অহেতুক চেঁচামেচি নেই , রাত্রে ঘুম নেই। সুরঞ্জনা ভেবে কুল পায়না ।

কি হলো ? অনিমেষ তো খুব সুখে থাকে । বিলাসিতায় থাকে

আজ বড্ড গরম । এসি চালিয়ে সুরঞ্জনা মশারি খাটিয়ে শুইয়ে দিলো অনিমেষকে । আজ হঠাৎ অনিমেষ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে –ওর খুব প্রিয় গান –” আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

পরান সখা বন্ধু হে আমার

আকাশ কাঁদে হতাশ সম

নাই যে ঘুম নয়নে মম

দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম

চাই যে বারে বার

পরান সখা বন্ধু হে আমার….

সুরঞ্জনা খুশি হয়। সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় যতক্ষণ না সে ঘুমায় ।

 

তখন নিশুতি রাত। সুরঞ্জনা সারাদিনের ক্লান্তিতে গভীর ভাবে ঘুমিয়ে আছে ।

 

অনিমেষের হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন অস্ফুট স্বরে ওকে ডাকছে — ” অনিমেষ ! এই অনি ওঠো ! দেখো আমি এসেছি “!

অনিমেষ অন্ধকারে ঘুমের মধ্যে

কিছুই বুঝতে পারছিল না।সে এটাও বুঝে উঠতে পারছিলনা সে জেগে না ঘুমিয়ে ? কে ডাকে ? কে ?

এবার স্পষ্ট করে ডাকলো –” অনিমেষ আমি এসেছি , আমায় চিনতে পারছো ? আমি –নিপা । চল আমার সাথে , এখনে বড্ড অন্ধকার। চল ছাদে চাঁদের আলোয় বসি , তুমি তো জ্যোৎস্না খুব ভালবাস “।

 

অনিমেষ কেমন ঘোরের মধ্যে তার সাথে ছাদে আসে।তখন মাঝ রাত। সারা পৃথিবী নীল জোছনায় ভাসছে –আহা ! কি মায়াময় রাত !

অনিমেষ একবার দেখে তাকে !সে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়! সে ফিসফিস করে বলে — ” আরে তুমি?” -” হ্যাঁ আমি !কেন বিশ্বাস হচ্ছে না “? অনিমেষ বলে –“তুমি কি করে এলে এখানে ? সুরঞ্জনা যদি জানতে পারে”? নিপা — কেন তুমিই তো চেয়েছিলে আমি আসি ! –হ্যাঁ চেয়েছিলাম ,কিন্তু !—- কোন কিন্তু নয় , এসো –আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দি।

 

নিপার সাথে তো ফেসবুকে পরিচয়! তাকে তো দেখেনি সে —তাহলে ? কিন্তু ওই সবুজ শাড়ী,পান পাতার মতো মুখ,এ নিশ্চয় নিপা। নিপাতো আজকাল এড়িয়ে চলে ।

অনিমেষ নিপাকে জড়িয়ে ধরে । ওর চুলের গন্ধ শুঁকে বুকভরে । মমতায় গলে যায় সে ! — এতোদিন কোথায় ছিলে? আমি তো হাজার হাজার বছর ধরে তোমারই প্রতীক্ষায় বসে আছি নিপা , সেই চাঁপা ফুলের গন্ধ ! সেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো –তুমি কোথায় ছিলে ?

 

নিপা অনিমেষকে আদর করতে করতে বলে —–এতো ভালোবেশ না গো , এতো ভালো বেশ না ।

নিপা হঠাৎ অনিমেষের কোলের ভেতর থেকে বেরিয়ে বলে — অনিমেষ দেখবে না ?

দেখ আমায় কত উপহার দিয়েছে ,দেখবে না? দেখ ! দেখ — কত উপহার , কত ভালবাসা ! একটি বার দেখ না লক্ষী সোনা।

অনিমেষ শিউরে উঠে ! —ওগুলো কিসের দাগ ? নিপা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে — ভালবাসার চিন্হ ! অনিমেষ চিৎকার করে বলে —- এ গুলো ছ্যাঁকার দাগ । কে এমনি করলো ?

নিপা ম্লান হেসে বলে —- হয়তো তুমি হলেও একই হতো ।

অনিমেষ পরম মমতায় নিপার কপালে, ঘাড়ে চুমু খেতে লাগলো পাগলের মতো।

 

নিপা অনিমেষকে হাত ধরে এনে তাকে বিছনায় শুইয়ে দিয়ে বলল —আমি যাই ! আর আমাকে ডেকো না। ভালো থেকো, শরীরের যত্ন নিও , ওষুধ গুলো ঠিক মতো খেও আর শোন বৌদির সাথে ঝগড়া করোনা যেন –আমি এলাম !!

 

সুরঞ্জনা হঠাৎ উঠে বসে , দেখে অনিমেষ ঘেমে কাদা হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি এসি অন করে । অনিমেষ বাচ্চাদের মতো কুঁকড়ে শোয়। আঁচলা দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে দেখে সে কাঁদছে । সুরঞ্জনা বলে — কি হলো ? কাঁদছ কেন ? অসুখ তো সবারই হয় ! সুরঞ্জনা তাকে টেনে তার দিকে ফিরিয়ে জড়িয়ে খুব আদর করে — যেন মা তার রুগ্ন বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে ।

;অনিমেষ কেবলই ভাবতে থাকে নিপা ! কি করে সম্ভব ? নিপা কি সত্যিই এসেছিল ? নিপা কি করে আসতে পারে ? তবে কি স্বপ্নেএসেছিল ?

 

কি জানি ? হতেও পারে । নিপা স্বপ্নে এসেছিল। ওর সবুজ শাড়ী , ম্যাচিং ব্লাউজ

আর সুন্দর পান পাতার মতো মুখ সে দেখে ছিলো কোথাও। অনিমেষ এখন অসুস্থ ! চব্বিশ ঘন্টা নিপার কথা ভেবে ভেবে সে হয়তো ঘুমের মাঝেও তাকেই দেখেছে । আর দুজনের কথোপকথন গুলোর হয়তো একটু হলেও বাস্তবতা আছে।

যুগ যুগ ধরে নিপাদের প্রতীক্ষায় বসে যারা থাকে তারা কোন জীবনে ওদের পায়না ওরা অমনি করেই হঠাৎই ঘুমের মধ্যে বা অবচেতনে একবার আসে। শুধু একবার ! একবার শুধু ! আর নয় এ জীবনে।

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত