আমাদের একখানা অদৃশ্য হাত আছে; অনেকে আবার ডান হাত কিংবা বাম হাতের চেয়ে সেই হাত বেশি ব্যবহার করেন। আর সেই অদৃশ্য হাতের কুশলী ব্যবহারে নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চেপে যায়। নিশ্চয় বুঝেছেন সেই হাতের নাম অজুহাত। পেশাগত হোক কিংবা ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে অন্যের দোষ কোন না কোনভাবে নিজের ঘাড়ে চাপেনি এমন মানুষ বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবে না; আবার উল্টোটিও সত্য, আমরাও কমবেশি নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপায়! তবে কিছু কিছু মানুষের জন্য বিষয়টি একদম সহজাত; সফলতা আর অর্জনসমূহ পুরোপুরি নিজের কিন্তু ব্যার্থতার দায় অন্যের। এদের হাবভাবে মনে হয় কোন নীতি বর্হিভূত কাজ তারা করতেই পারেন না; অথচ নীতির ধার তারা খুব কমই ধারে!
এমন কয়েকটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে, বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম কেন মানুষগুলো এমন করে? কেন তারা সোজা পথে হাঁটে না? ভাবনা থেকেই বইপত্র উল্টিয়ে দেখলাম বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভাবেন, গবেষণাও হয়েছে অনেক। আর বিষয়টির একটা গালভরা নামও আছে “Self-Serving Bias”; বাংলায় যাকে “স্ব-সেবা পক্ষপাত” বলা যেতে পারে; বিষয়টি আবার Behavioral Finance-এ পাঠ্য।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ব্যর্থতার দায় অস্বীকার এবং সাফল্যের মাত্রাতিরিক্ত কৃতিত্ব দাবি করে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির জন্যই আমরা নিজের দোষ অন্যের অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে থাকি। আর এই কাজটি নারীদের তুলনায় পুরুষরাই বেশি করে থাকেন। আবার প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশু এবং বৃদ্ধদের মধ্যে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রবণতা বেশি।
বৃদ্ধ বয়সে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা জনিত ভোগান্তি সহ্য করতে হলেও জীবনের পরিতৃপ্তি মানের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটে না। এতে যা ঘটে তা হলো, আত্মবিশ্বাস থাকে ভরপুর কিন্তু ক্ষমতা থাকে না! ফলে বৃদ্ধ বয়সে গৃহীত নতুন কোন উদ্যোগের অর্জন প্রাপ্ত বয়সে গৃহীত উদ্যোগের অর্জনের মতো না হওয়াই স্বাভাবিক; কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ তা স্বীকার করতে চায় না; তখন বৃদ্ধ মানুষ অজুহাত খোঁজে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়।
প্রাপ্তবয়স্কই হোক কিংবা বৃদ্ধ, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো যাদের স্বভাব ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পরিমিতিবোধ থাকে না। অতিরিক্ত ঝুঁকি গ্রহণ অনেক সময় তাদের ব্যর্থতার কারণ হয় কিন্তু অবধারিত ভাবেই সেই দায় অধস্তন কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর চাপিয়ে দেয়া হয়; যেমন: “অধস্তনরা দক্ষ ছিল না কিংবা কোভিড পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারতাম।”
যাহোক, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমরা আখেরে নিজের ক্ষতিই করে থাকি। এতে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে যায়; দক্ষ মানুষের সঙ্গ হারিয়ে চাটুকর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ি এবং কোন কাজের বাস্তব প্রতিক্রিয়া পাবার উপায় থাকে না। ফলে সীদ্ধান্ত গ্রহণে আরো ভুল হয়, ব্যর্থতার পাল্লা আরো ভারী হতে থাকে। তাই আমাদের অদৃশ্য হাতখানা যতই নিয়ন্ত্রিত রাখা যায় ততই মঙ্গল।
আপনার মন্তব্য লিখুন