জীবনের গল্প রঙের জীবন

রূপালী চাঁদের বীভৎস আলো || সাখাওয়াৎ আলম চৌধুরী

‘ তুই আবার আমার বাড়িতে আইছস? ‘
‘আমার বাড়িতে আমি আমুনা তো ক্যাডা আইবো? ‘বলেই দরজা দিয়ে জোর করে ঢুকতে গিয়ে পায়ের সাথে পা লেগে পড়ে যায় আরমান। নেশা করাটা এখন নিয়মিত পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে তার। নেশার কারণে ঘর থেকে বের করে দেয় তাকে তার বাবা অনেক আগেই। শুধু নেশা নয় সবরকম খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়েছে সে। তারপরও মাঝে মাঝে আসে বাড়িতে। কিন্তু তার বাবা তাকে পাত্তা দেয় না ঠিক আজকের মতো। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে বড় ছেলে। বাইশ -তেইশ বছরের তাগড়া যুবক। তার বাবা কাসেম মোল্লা। চাষবাস করে পরিবার চালান তিনি। আরমান পড়াশোনা বেশীদূর করেনি। ছোট থেকেই ডানপিটে স্বভাবের। কখনোই সংসারের কোন কাজে আসেনি সে। সবসময়ই ঘরের খেয়ে বনের মোষ চড়াতো সে।

যখন পুরোপুরি ভাবে যৌবনে পা দিল আরমান। তখন থেকেই পরিবারের কাউকে কেয়ার করতো না। দুষ্টু যৌবনের পাল্লায় পড়ে একেবারেই বেয়াড়া হয়ে যায় সে। তার নিষ্কর্মা এবং সেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে বেশ কয়েকবার ঘর থেকে বের দিয়েছিলেন কাসেম মোল্লা। প্রতিবারই ছয় মাস একবছর বাইরে থেকে আবার ঘরে ফিরে আসতো। আর তার মাঝে দেখা দিতো নতুন নতুন পরিবর্তন।

গ্রামে সবাই বলাবলি করে যে আরমান একজন দক্ষ সন্ত্রাসী। কিন্তু নিজের এলাকায় কখনোই তার প্রকৃত রূপ কেউ দেখেনি। তবে তার সাথে যাদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো একমাত্র তারাই জানতো আসলে আরমান কত বড় সন্ত্রাসী। যখন ঘর থেকে নিরুদ্দেশ হতো তখন বাইরে গিয়ে কোন না কোন বড় কাজ না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরতো না। তার বাবা তাকে অনেক চেষ্টা করেছে ভালো পথে আনার জন্য। কিন্তু তার দ্বারা সম্ভব হয়নি বকে যাওয়া সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।

কাসেম মোল্লার বাকি চার সন্তান গুলোর মধ্যে আয়না মেঝ। সে এবার এসএসসি পাস করেছে। কিন্তু পয়সার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। তার ছোট দুই বোন এক ভাই।তারা মক্তব পর্যন্ত পড়েছে। আইরিন পড়াশোনায় ভালো ছিলো বিধায় উপবৃত্তির টাকায় এতদূর পর্যন্ত এসেছে। কাসেম মোল্লার নিজস্ব তেমন কোন জমি নেই। বর্গা চাষ করেই জীবন চালান। তারপরও সবসময় কুলিয়ে উঠতে পারে না। বড় ছেলেকে সবসময় বলে আয় রোজগার করে সংসারের হাল ধরার জন্য। তবে তা হতে হবে সৎপথে। কাসেম মোল্লা কখনোই আরমানের এইসব অন্যায় আয়ের টাকা হাতে নেয় নাই। এমনকি তার স্ত্রীকেও বলে দিয়েছে কখনোই যেন ওর কাছ থেকে যেন টাকা পয়সা না নেয়।………

প্রায় ছয় মাস পর বাড়িতে এসেছে আরমান। তার নেশার অভ্যাস ছিলো আগে থেকেই । কিন্তু কখনো নেশা করে ঘরে আসতো না। তার বাবাকে কিছুটা হলেও ভয় পেতো। তবে আজ নেশা করেই ঘরে ঢুকছে সে। এটা কিছুতেই সহ্য করছে না কাসেম মোল্লা। তাই আরমানকে নেশাগ্রস্ত দেখে তার বাবা মাঝরাত্রিতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয় ।

‘তুই আমার ঘর থেইক্কা বাইর হ ‘ প্রচন্ড চিৎকার করে বলল কাসেম মোল্লা।
কিন্তু নিজের উপর কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ এই মূহুর্তে নেই আরমানের। তাই ধপাস করে পড়ে গেলো বিছানায়। এই অবস্থায় ছেলেকে কি করবে ভেবে পায়না কাসেম মোল্লা। তার স্ত্রী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন কিছুতেই কাসেম শান্ত হওয়ার লোক নয়। যেন ঘুমন্ত আরমানকে এক্ষুনি টেনে বাইরে ফেলে দেয়।

পরে তার স্ত্রী বলে যে সকাল হলেই তাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলব। তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। এখন এই অবস্থায় ও কোথায় যাবে। স্ত্রীর এই কথা শুনে কাসেম আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তখন স্ত্রীকেও গালমন্দ করতে থাকে। অবশেষে একসময় কাসেম শান্ত হয়। পরে কয়েকদিনের মধ্যে আরমানকে বাড়ি থেকে বের দেয় চিরদিনের জন্য। এমন কুলাঙ্গার ঘরে রাখার কোন মানে নেই।

এই ঘটনার পর কাসেম মোল্লার সংসার টেনেটুনে চলতে থাকে। তবে হঠাৎ বন্যায় ফসলের ক্ষতি হলে কাসেমের সংসার চালানো দায় হয়ে পরে। কিছুদিন ধারদেনা করে চললেও শেষ রক্ষা হয়ে উঠে না। দিনে সবার জন্য একবেলাও খারাপ জুটে না। এই অবস্থায় জসিম নামের তার ভাতিজা জানায় যে গার্মেন্টসের কাজ খুব ভালো। সে নিজেও গার্মেন্টসে কাজ করে। চাইলে আয়নাকে গার্মেন্টসে কাজে দিতে পারে। এছাড়া এখানে বেতনও খুব ভালো।

শেষ পর্যন্ত জসিমের পরামর্শে কাসেম মোল্লা সিদ্ধান্ত নেয় আয়নাকে শহরে পাঠাবে কাজ করার জন্য। আর এই কথা তার স্ত্রীকে জানালে স্ত্রী ফরিদা খুবই অবাক হয়।
‘তুমি এইডা কি কইলা?শেষমেশ মাইয়ার কামাই খাইবা তুমি? ‘
‘মাইয়া স্কুলথোন পাস দিছে। ছাকরি করলে ক্ষতি কি? ‘ বলে কাসেম মোল্লা।
‘তুমি কি পুরান কতা ভুইল্লা গেলা। আইরিন যখন দুনিয়াত আইলো। হের পায়ে ছয়টা ছয়টা বারডা আঙ্গুল দেইখ্যা তুমি কইলা এই মাইয়া বড় ভাগ্যবতী হইবে। তুমার মনে নাই হেইবার থেইক্কা আমাগো দিন খুইল্লা গেছে। তুমার চাষের জমি বাড়ছে। ফলনও হইতেছিলো জবরদস্ত। আর তুমি কইলা -ফরিদা আমার মাইয়া সত্যিই ভাইগ্যবতী। আমি এই মাইয়ারে কুনো কষ্ট দিমু না ‘ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফরিদা। আবার বলতে থাকে বরই আক্ষেপ নিয়ে , ‘তুমি অহন এই আদরের মাইয়ারে গার্মেন্টসে দিবা? ‘
‘আমার হগলটি মনে আছেরে ফরিদা, কিন্তু অহন কি করমু। আমরা না অই না খাইয়া থাকমু। কিন্তু এই দুই তিনডা পোলা মাইয়া কেমনে না খাইয়া থাকবো? ‘চোখ ছলছল করে বলে উঠে কাসেম মোল্লা।
বাস্তবতা বরই নির্মম। সত্য যেখানে জ্বলজ্বল করে উঠে সেখানে স্নেহ মমতা বরই ম্রিয়মান। পিতা মাতার কথা আড়ালে শুনে ফেলে আয়না। আর চরম সত্যের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সে। দু চোখ ঝাপিয়ে কান্না আসে তার। দৌড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে জানায় যে সে চাকরি করতে চায়। এভাবে দিনের পর দিন না খেয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার মূল্য অনেক বেশী ।

এভাবেই একদিন আয়না পাড়ি দিলো আলো আধাঁরের মরিচিকার শহর ঢাকাতে। বাবার পরিচিত জসিম ভাই তাকে একটি গার্মেন্টসে চাকরি পাইয়ে দেয়। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও কয়েক মাসের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেয় আয়না। আর খুব দ্রুতই বদলাতে চেষ্টা করে নিজের এবং পরিবারের ভাগ্য। সদ্য কিশোরী উত্তীর্ণ নব যৌবনে পা দেওয়া আয়নার জন্য এই নিষ্ঠুর ঢাকা শহর মোটেই নিরাপদ নয়। সেটা সে কিছুদিন যেতেই বুঝতে পেরেছিল। অফিসে এবং অফিসের বাইরে প্রতিনিয়ত তাকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা হতে হয় ইভটিজিংয়ে। সদ্য গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের প্রতি অনেকেরই ললুপ দৃষ্টি থাকে।

কিন্তু আয়নার মতো মেয়েরা কখনোই তা বুঝতে পারে না বলে খুব দ্রুতই কীট মাকড়দের জালে জড়িয়ে পড়ে। আর তেমন একটি জাল বুনে তারই অফিসের হায়দার সাহেব। প্রথমে বিভিন্ন ভাবে আয়নার ধারে কাছে মেশার চেষ্টা করে। কিন্তু সহজ সরল আয়না শুরু থেকেই এইসব থেকে দূরে থাকে। কিন্তু কোন এক পর্যায়ে হায়দার সাহেবের জোরাজুরিতে আয়না এমন কিছু করে ফেলে যার জন্য হায়দার সাহেব প্রচন্ড অপমানিত হন। যা পুরো অফিসে জানাজানি হয়ে যায়।এমনকি তার কাছের বন্ধুরা তাকে হেয় করতে থাকে। একটা সাধারণ মেয়ের কাছে সে অপমানিত। এরফলে হায়দারে ভিতরে একটা ক্রোধ জন্ম নেয়।

সেই ক্রোধের ফলে প্রথম প্রতিশোধ নেয় আয়নার চাকরি খেয়ে। অফিসে ভালো অবস্থানে থাকার কারণে হায়দার সাহেবের জন্য এটা কোন ব্যপার না। পরে তারই ইশারায় নতুন একটি গার্মেন্টসে চাকরি পাইয়ে দেয় আয়নাকে। কিন্তু আগের চাকরির ভুত যে তার পিছনে আছে সেটা ভুলেও ভাবেনি সে।

নতুন চাকরিতে প্রায় রাত্রি করে বাসায় ফিরতে হয় আয়নাকে। তার ছুটি এমন ভাবে দেওয়া হয় যাতে সে একা যেতে বাধ্য হয়। সেইসাথে যে জায়গায় এখন চাকরি করে সেটা খুবই নিরিবিলি একটা এলাকা। সেই নিরব এলাকা পার করেই বড় রাস্তায় আসতে হয় গাড়ির জন্য। বর্ষার দিনে রাস্তাঘাট খুব দ্রুতই খালি হয়ে যায়। আর এমনই বৃষ্টি বাদলের দিনে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো হায়দার।

খুব ঝড় বাদলের ঐদিনে আয়না একা বাসায় ফিরছিলো। শুনশান রাস্তায় ঝড়ের কারণে লোডশেডিংয়ে পুরো এলাকা অন্ধকার। আয়না দ্রুত হাটতে থাকে গাড়ি ধরার জন্য। কিন্তু তার বদলে তাকেই পেছন থেকে ঝাপটে ধরে একটি যুবক। সাথে সাথে মুখ চেপে তাকে উঠিয়ে নেয় পাশে থাকা মাইক্রোবাসে। চারদিকে অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না। অন্ধকার মাইক্রোবাসের ভিতর যুবকটি দ্রুত মেয়েটির মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়। সেইসাথে হাত পা বেঁধে তাকে ফেলে রাখে পিছনের সিটে।

যুবকটি একটি সিগারেট ধরিয়ে ফোন দেয় একজনকে। ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি তাকে একটি ঠিকানা দেয়।কিছুক্ষণে মধ্যে ঐ ঠিকানায় পৌঁছে গাড়িটি । আর হাতে গুনে নেয় চকচকে টাকার নগদ বান্ডিল। বাইরে বজ্র আলোর ঝলকানির মতো যুবকের চোখেও ঈষৎ আলো জ্বল জ্বল করে উঠে। মনে মনে ভাবে একটা বড় দান মেরেছি।

কিন্তু সে জানে না প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির দিনে সেই মাইক্রোবাসে চলে আরও তুমুল জৈবিক ঝড় কিছু উল্লসিত মানুষের বিকৃত মদদে। উপর্যুপরি ঝড়ের তান্ডবে একসময় ঝিমিয়ে পড়ে মাইক্রোবাসটি। একে একে নেমে আসে হায়দারসহ তার বন্ধুরা।

প্রকৃতির ঝড় থেমে নিরব হয়ে আসে পুরো পৃথিবী। কিন্তু ঝড়ে সাথে সাথে যে আইরিনও থেমে যাবে এটা কেউ কল্পনা করেনি। অনেকক্ষণ পর হায়দারের এক বন্ধু বুঝতে পারে আয়নার কোন সাড়াশব্দ নেই। একসময় তারা বুঝতে পারে আয়না এখন লাশ। এখন কি করবে তারা? এই লাশের ব্যবস্থা কিভাবে হবে? তখন হায়দারের বন্ধু আবার ফোন দেয় ঐ যুবককে। তাকে জানায় যে এই লাশটা গুম করতে হবে। সুযোগ পেয়ে যুবকটি বড় অংকের টাকা দাবি করে। তারা তাতে রাজি হয়।

একসময় যুবকটি এসে আয়নার লাশ সহ গাড়িটি নিয়ে যায় অনেক দূরে কোন এক নদীর পাড়ে নির্জন জায়গায়। খুব শক্ত করে বেঁধে পাথর দিয়ে ডুবিয়ে দিতে হতে। কয়েকদিন পর লাশ বিকৃত হয়ে গেলে আর কোন সমস্যা নাই। সবকিছুর আয়োজন সম্পন্ন করে যুবকটি মেয়েটির লাশ নিতে আসে। বিকৃত ভাবে উলঙ্গ আয়নার এ্যাবড়ো থ্যাবড়ো শরীর কাপড় দিয়ে পেচায় সে। ঝড় থেমে গিয়ে আকাশে একপ্রকার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হয়তো খুব শীঘ্রই ভোর হবে।

সমস্ত কিছু সম্পন্ন করার পর হঠাৎই চোখ গেলো যুবকটির আয়নার পায়ের দিকে। পুরো শরীর কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিলো। কিন্তু পায়ের দিকে যখন কাপড় আলগা হয়ে গেল। তখন কাপড় টেনে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করে মেয়েটির পায়ে ছয়টা ছয়টা বারটি আঙ্গুল। হঠাৎ যুবকটি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বুকের ভিতর কেন জানি ধুক্ করে উঠল। কেননা তার নিজের বোনের পায়েও বারটি আঙ্গুল! নিজেকে প্রথমে দমন করলো সে। না, দেখবে না মেয়েটির মুখ। কিন্তু সহসাই নিজের ভিতরের ঘুমন্ত বিবেকের তাড়নায় সে খুলে দেখলো আয়নার মুখ।

কিন্তু সেই মুখ তার পরিচিত আয়নার মুখ নয়। সেই মায়াবী স্নেহ ভরা মুখে হিংস্র হায়েনাদের নিকৃষ্ট যৌনতার আঁচড়। নেই নিষ্পাপ বোনের আদুরে সেই অধর। এটা সেই মুখ নয় সেখানে ভাইয়ের পরম ভালবাসার চুমু ছিলো। এটা বিকৃত সেই মুখ যা নষ্ট সমাজের লালায় দূর্গন্ধ যুক্ত। যুবকের বুক চিঁড়ে বিকট শব্দে করুন আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। সেই আর্তনাদ গিয়ে পৌঁছালো ভোরের মিষ্টি আলো আঁধার ক্ষনে সবেমাত্র জেগে উঠে কিছু সকাল পাখির কানে। তারা সাথে সাথে ভাইয়ের অস্রুঝরা বিদগ্ধ কান্নার সুর ছড়িয়ে দিল সুন্দর পৃথিবীর বন্ধ মানবতার কানে।

পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম