রঙের জীবন

অভাগা || সোহেল হামজাহ্

           অভাগা

✍ সোহেল হামজাহ্

 

অভাগার পুড়ে কপাল

জলে ডুবে মরে স্বপ্ন।

করিম চাচা_

হাটুজলে দাঁড়িয়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গুনগুন করে অবিরামভাবে কি যেন পাঠ করে যাচ্ছে করিম চাচা। স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারতেছিনা দূর থেকে। তবে সেই সুর কালবৈশাখী স্রোতে ভেসে আসতেছে কানে। যেপথ মানুষ চলাচলের অযোগ্য সেপথ ধরে জল চলাচল করতেছে এইভাবে আর কিছুক্ষণ বৃষ্টি নামলে এই সভ্যতার শহরকে মৃত শহর বলে ঘোষণা করবে আবহাওয়া দপ্তর! যোগাযোগ মাধ্যম। নিশ্চিত।

 

করিম চাচা- একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। রফিক ছিদ্দিক বা (R S) রোড়ের আকাঁবাকা চত্বরে একটা ফার্মেসীর খানিকদূর রাস্তাধারে চাচার দোকান- শার্ট পিছ, পেন্ট পিছ, গেঞ্জি, গামছা, লুঙ্গি, টুপি, রুমাল,এসব বিক্রি করে কোনমতে চলে চাচার চার সদ্যসের সংসার।

 

করিম চাচা রসিক মানুষ

হেসে মেতে মিলেমিশে একাকার জীবন তার। চাচাকে বহুবার বলতে শুনেছি! কে বলেছে এটা দোকান! দোকান না অনেকটা দোকানের মতন দেখতে। এসব বলে হাসতে থাকে সর্বদা, চাচার কথায় একলফজ ভুল নেয়; আসুন সেটা মিলিয়ে নেওয়া যাক একটা সাত ফুট কিম্বা আট ফুট সাইজের লম্বা উঁচু একটু, কাটের বাক্স, তালা ঝুলানোর জন্য সামনে তিন তিনটে লক লাগানো ব্রিটিশকোম্পানি তালা হয়ত আমার এই জিন্দেগীতে আর কোথাও এমন তালা দেখেছি বলে মনে পড়তেছেনা

 

করিম চাচা পরহেজগারদের একজন। আমার নয় বছরের এই কর্ম জীবনে কখনওই চাচাকে ঝগড়াফসাদ করতে দেখিনি,আবার দেখিনি কখনওই কান্না করতে। আযান হওয়ার পরপর তালায় বাক্সবন্দি, কাগজে (নামাজের বিরতি) নোটিশ ঝুলতে দেখেছি।

 

করিম চাচার

তবে আজ কি হয়েছে ! ছুটির দিন কালবৈশাখী ঝড়- । এই বুড়ো বয়সে বৃষ্টিতে ভিজে গান গাইবার স্বাদ জেগে উঠেছে নাকি!গান ধরেছে না আল্লাহকে ডাকছে সেটা কাছে না গেলে কিভাবে বুঝব ;! মনগড়া ভাবা ঠিক হচ্ছে কি!?

 

আমার নাকি আমাদের হবে সঠিক জানিনা! একটা খারাপ স্বভাব আছে সেটা হল; পজিটিভ চিন্তাধারা মস্তিষ্কে আগে ধরা দেয়না দ্রুত যতটা ধরা দেয় নেগেটিভ চিন্তাধারা গুলো-। আমার- আমাদের মস্তিষ্কের বিস্ফোরণ ঘটা খুব জরুরি যেন সঠিক দিক অতিদ্রুত সনাক্ত করতে পারে আর বেঠিক দিক গুলো এড়িয়ে যেতে পারে।

 

করিম চাচা_ আর আমার দূরত্ব ত্রিশ কদমের কম হবে না; একজন উঠতি যুবকের কাছে ত্রিশ কদম এই আর এমন কি মহাভারত দু,চারলাফে পৌঁছে যেতে পারব নিশ্চিত। কিন্তু হাটু জলে কি লাফানো সম্ভব! কখনওই না ; তাই এক পা দুই পা করে করে চাচার দিকে এগুচ্ছি ছাতা হাতে। চাচার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম তখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আল্লাহ্‌র নিরানব্বই নাম জপতেছে চাচা কিন্তু আল্লাহ্‌কে মসজিদে বা বাসায় বসে ডাকতে পারে আপত্তি কোথায়! বৃষ্টিতে ভিজেভিজে ডাকতে হবে কেন? কাহিনী কি!

 

করিম চাচার পিছু দাঁড়িয়ে আছি আমি লক্ষ্য করলাম চাচা জলে গভীরে দুহাত ডুবিয়ে একটাকিছু উপরে তুলতে চাচ্ছে কিন্তু বয়স্ক বলে সমস্ত শক্তি দিয়ে ও তুলতে সক্ষম হচ্ছে না ! ডাক দিলাম চাচাকে ; চাচা চাচা ও চাচা! কে কে? বলে পিছু ফিরে তাকাতে’ই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল; অথচ আমি আজ প্রথমবার চাচা কিম্বা কোনো বৃদ্ধা কাউকে কাঁদতে দেখলাম! আর বুকে জড়িয়ে ধরেছি এই প্রথম বার বাবার বয়সী কাউকে। আমি জীবনে বহুবার বাবাকে বা বাবার বয়সী লোকগুলোকে প্রচণ্ড ঘামতে দেখেছি,কাঁদতে এ প্রথম। কান্না থামেনা ছোট্ট বাচ্চাদের মতন কেঁদে যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করব সেই সাহস পাচ্ছিনা, কাউকে কাঁদতে দেখলে আমি নিজে ইমোশনাল হয়ে পড়ি, তবু বুকে সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম! কি হয়েছে চাচা কাঁদতেছ কেন! আর জলে কি ডুবেছে এমন যা তুলতে চাচ্ছ! চাচা বলে উঠল আমার সবকিছু ভেসে গেল! কিছু বাঁচাতে পারলামনা! তখনো আমার মাথায় আসেনি চাচা কি ভেসে যাওয়ার কথা বলল বা কি এমন আছে চাচার দোকানটা ছাড়া যে ভেসে যাবে!

 

করিম চাচা আমাকে বলে উঠলেন! দোকান ডুবে গেছে একটু তুলতে হবে এই কথা শুনা মাত্র ! আমি নিজেই স্তব্ধ, নির্বাক, হাভাবোবা হয়ে গেলাম। আর বুঝতে বাকী রইলো না চাচা হাটুজলে কি হাতড়াচ্ছে! আর উপরে কি তুলবার চেষ্টা করতেছে! বাক্সটাতে পুরোপুরিভাবে জলে ডুবে আছে,দুজন দ্বারা এটা উপরে তুলা অসম্ভব প্রায়। অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না! এমন বৃষ্টিতে রাস্তায় মানুষ তো দূরের কথা পোকামাকড়ের আনাগোনাও নেয়। জল থেকে উঠে স্থলে এসে বন্ধু কয়েকজনকে ফোন দিলাম আশেপাশে তাদের বাসা ছুটে আসল দ্রুত এমন মর্মান্তিক ঘটনা শুনে। পাঁচজনে মিলে কোনমতে উপরে তুললাম, দুঃখজনক বিষয় সবকিছু একদম ভিজে গেছে যেমনটা ভিন্ন প্রজাতির মাছেরা জেলের জালে আটকা পড়েও জলে ডুবে দেয়।

 

করিম চাচা বেকার

ছাদে মোটা রশি টাঙিয়েছে সেদিন ভেজা কাপড় শুখাইবে বলে। দুদিন পেরিয়ে গেল! মেঘ আকাশ থেকে সরে না আর রোদও মেঘ ছেদ করে ক্ষমতা দেখাতে পারেনা! ধৈর্যহারা মনে হচ্ছেনা তবুও মানুষটাকে আবার দুঃখ প্রকাশ করতেছে ও না। শুধু বলতেছে আল্লাহ্‌ যা করে ভালোর জন্য করে।

 

বন্দরনগরী, চিটাগাং