অণুগল্প

নয়শো’ ছত্রিশ নাম্বার বেড : আকিব শিকদার

মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই, যা আমি পেয়েছি অসুস্থ থাকা দিনগুলোতে। সুচিকিৎসার জন্য মাদ্রাজ নিতে হবে বলে ডাক্তারেরা যখন আমাকে ঢাকা মেডিকেল থেকে রেফার করে দিল, আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের বাড়িতে। পাশাপাশি তিন গ্রামের লোকেরা প্রায় প্রতিদিন রোগী দেখতে আসতো। সাথে নিয়ে আসতো তাদের গাছে ধরা টাটকা ফলমূল, শাকসবজি। কিন্তু আমিতো কিছুই খেতে পারতাম না। মুখে নিলেই নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতো।
আমাকে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, ডাক্তারেরা টেস্টের রিপোর্ট দেখে বলেছিলো- হারপিক খেয়ে ছিলেন নাকি! পাকস্থলীতে এত ঘাঁ আগে দেখিনি!
আসল কারণটা বলি। আমি ছিলাম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এজেন্ট। সকালে মালামাল নিয়ে মার্কেটে যেতাম, ফিরতাম সন্ধ্যায়। দুপুরে বাইরে খেতে হতো পুরি-সিঙ্গারা, পুরাতন তেলেভাজা সমচা। প্রায়ই পেট ব্যথা করত। ভাবতাম আলসার, হয়তো সেরে যাবে। কিন্তু যেদিন মধ্যরাতে বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দেখি রক্ত, সেদিন মেসের কয়জন আমাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। টানা একানব্বই দিন মুখে কিছু খেতে পারিনি। স্যালাইন পুশের উপর বেঁচে ছিলাম। যে আমি ইনজেকশনের সুচ দেখলেই কুকড়ে যেতাম, সেই আমি কি না হাত পেতে নিতে থাকলাম একের পর এক ভ্যাকসিন। প্রতিদিন সাতটি করে সুচের গুতো। হাতের রগগুলো চালুন এর মত ঝালাপালা। দুই হাতে দুটি ক্যানোলা। মুখে কিছু খেতে পারি না, তাই সেলাইনই ভড়সা।
সাড়ে-চার মাসে জীবন সম্পর্কে এত দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার যা কিনা দীর্ঘ ত্রিশ বছরেও হয়নি। আমার বন্ধুরা প্রথম কদিন খুব খবরা-খবর নিলেও সপ্তাহখানেক পর ভুলে যেতে থাকলো। শুরুতে তারা রেগুলার এসে আমার পাশে বসে সেলফি তুলে ফেইসবুক মাতিয়ে সিমপ্যাথি ক্রিয়েট করতে চাইতো। তারপর আর খবর নেই। মেস-মেম্বাররা প্রথম প্রথম ফলমূল নিয়ে দেখতে যেত, পরে তো ভুলেই গেল। এবং দ্বিতীয় মাসে আমাকে জানালো তারা আমার সিটে নতুন মেম্বার তুলেছে। মার্কেটিং এর চাকরি তো, এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে কম্পানি জানালো আমার পোস্টে নতুন লোক নেবে। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলাম অর্পিতার কাছ থেকে। অর্পিতা আমার প্রেমিকা। ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাবার পথে রাজশাহীতে প্রায়ই রাত কাটাতাম অর্পিতার সাথে। হোটেলে পরিচয় দিতাম স্বামী-স্ত্রী। কথাটা এমনই ছিল, আমরা পরস্পর পরস্পরকে ছাড়া বিয়ে করব না। অর্পিতার পরিবার থেকে বিয়ের চাপ আসলে সে রাজী হচ্ছিল না। কিন্তু যখন জানালো আমার এই দশা, বাচি কি মরি ঠিক নেই, তখন সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেল। মুমূর্ষ রোগীর মৃত্যু দেখার জন্য অপেক্ষা করে কী লাভ!
ঢাকা মেডিকেলের নয়শো’ ছত্রিশ নাম্বার বেডে শুয়ে থেকে যখন খুব অস্বস্তি লাগতো, মাকে বলতাম- মা আমাকে একটু ছাদে নিয়ে যাবে? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি নেই তাই বিকেলে ডাক্তারেরা যখন অফ-ডিউটিতে থাকে, মা আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ছাদে রেখে আসতেন। আমি আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাবতাম- গাছ মরে যাবার আগে তার উঁচু ডালপালা আর দূরবর্তী শেকড়গুলো মরে যেতে থাকে। মানুষের মরা শুরু হয় তার স্বপ্ন ও আশা গুলোর মৃত্যু থেকে। তবে কি বিধাতা আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন!
কিন্তু আমার মা তো আমাকে মরতে দিবেন না। যমদূতের থাবা থেকে তার ছেলেকে বাঁচাতে সবসময় পাহারায় থাকছেন, প্যাঁচার ছোঁ থেকে বাচ্চাকে বাঁচাতে যেমন সতর্ক থাকে মেঠো-ইঁদুর।
মাদ্রাজ নিতে হলে অনেক খরচ। পাসপোর্ট ,ভিসা-প্রসেসিং। বাড়ি-ভিটা ছাড়া আমাদের যা ছিল মা সব বেচে দিলেন। একমাত্র ছেলেই যদি বেঁচে না থাকে সম্পত্তি দিয়ে কি হবে!
এদিকে বিধাতার কি খেলা! তিনি হয়তো মায়ের ভালোবাসা পরীক্ষা করতে চাইছিলেন। আমার মা সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে গেল। যেদিন জমি-জিরাত বেঁচা শেষ, সেদিনই আমি দু’চামচ ডাবের পানি মুখে নিয়ে গিলে ফেললাম, নাড়িভুঁড়ি উল্টে বমি এল না। তারপর ক্রমে ক্রমে চামচের সংখ্যা বাড়তে থাকল এবং এক সপ্তাহের মাঝে আর সব খাবারের দিকেও হাত বাড়ালাম।
এখন ঢাকা মেডিকেলের দিকে গেলে নয়শো’ ছত্রিশ নাম্বার বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভাবি- কী দিন গিয়েছে আমার! সাড়ে চার মাসে জেনেছি এমন অনেক কিছু যা ত্রিশ বছরেও জানতে পারিনি। অসুস্থতার কালে যেসব নার্সদের সাথে কিছুটা খাতির হয়েছিল, তারা আমায় টুকটাক কুশল বিনিময়ের পর বলে- যে দশা হয়েছিল আপনার, ঈশ্বর নিজ হাতে রেখে না গেলে বাঁচার কথা ছিল না…

হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।