অণুগল্প

ঋতুটি বর্ষা এখন পঞ্জিকার পাতা : আকিব শিকদার

ব্যস্ত জীবনের বাস্তবতা আমাদেরকে গন্ডারের মত অনুভূতি শূন্য করে দিয়েছে। তাই তো আমাদের চামড়ায় তীব্র আঘাত না লাগলে আমরা আন্দাজ করতে পারি না একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। অথচ কী আশ্চর্য, আমরা এখন প্রায় ভুলতেই বসেছি যে বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু। আষাঢ়—শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। ঋতুটি বর্ষা এখন পঞ্জিকার পাতায়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে জীবন যখন প্রায় ওষ্ঠাগত, তখন পৃথিবীতে শান্তির বার্তা নিয়ে আসে বর্ষা। কদম গাছের পাতায় বৃষ্টির প্রথম স্পর্শ জানিয়ে দেয় কদম ফুল ফোটার সময় এসে গেছে। বৈশাখী তাণ্ডবে যে মাঠ ফেটে চৌচির হয়েছিল, বর্ষার ঐশ্বরিক ছোয়ায় তাতে জমে উঠে নরম কাদার আস্তর। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা বর্ষার অপেক্ষায় প্রহর গুনে। বৃষ্টির বদান্যতায় খাল—বিল যখন জলে টইটুম্বুর, তখন শাপলা ফুলের কাজ ফুকলা দাতের খুকির মত হি হি হি করে হেসে ওঠা।
যারা নাগরিক জীবন যাপন করেন, তাদের কাছে বর্ষা আসে চরম দুর্ভোগ নিয়ে। বাইরে বের হবে, ছাতা কোথায়! রাস্তায় এত জল জমে গেছে যে, হাটুর উপর কাপড় গুটিয়ে নিয়েও নিস্তার নেই। জুতোজোড়া নিশ্চিত নষ্টের দখলে। আর রিক্সাওয়ালা, হ্যা হ্যা… তিনি পনেরো টাকার রাস্তা যেতে ভাড়া চাইবেন পচিশ টাকা। এদিকে নতুন খননকৃত গর্তে অসতর্ক পা ফেলে বিড়াল—ভেজা হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই।
চাতক পাখি কি এখন বর্ষার অভিসারে কেঁদেকেটে বুকফাটা! সে বার্তা দলিল হয়ে ধরা দেবে বাঙালি কবির ছন্দময় কবিতা। আমাদের দিদিরা এখন আর ব্যাঙ ধরে এনে আঙিনায় গর্ত করে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়াতে মাতেন না। সেই যুগ চলে গেছে। তাই বলে বর্ষার আনন্দে ব্যাঙ—সম্প্রদায় ক্ষেতের আলে বসে ঘেঙর ঘেঙ গান গাইবে না, তা তো মানা যায় না। বর্ষা এলেই খালে বিলে নতুন প্রাণ লাফিয়ে উঠে। মাছের প্রজনন মৌসুম এটি।
বাদামওয়ালা যদি ঠোঙা প্রতি বাদামের দাম পাঁচ টাকা বেশি নিতে চায়, কেউ অভিযোগ জানাতে পারবে না। বর্ষা বলে কথা! এই বর্ষায় প্রচন্ড বর্ষণে প্রেমিক—প্রেমিকারা দ্বিতীয় ছাতাটি গুটিয়ে নিয়ে ব্যাগের ভেতর রেখে একটি ছাতার নিচে হাতে হাত ধরে হাঁটতে চাইবে, এটা কি অস্বাভাবিক…! ওরা যদি হাতের ছাতাটি বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে মাথার উপর কচুপাতা মিলিয়ে ধেও, হা—করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া পথচারীদের কিবা করার আছে! বর্ষা আমাদের শেখায় কী করে রোমান্টিক হতে হয়।
বর্ষা শৈশবের ঋতু, তারুণ্যের ঋতু। বর্ষা মানেই গ্রামের ছেলেদের হাতে ফুটবল আর এক—হাটু কাঁদাতে বেদম লাফালাফি। বিধাতা জানেন দুষ্ট ছেলেদের খেলার ব্যবস্থা করতে হবে, তাই জাম্বুরা গাছে ধরিয়ে দেন প্রমাণ—সাইজ জাম্বুরার সমাহার। আর গাছ মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই জাম্বুরা ফুটবলের সাজ ধরে মাঠে মাঠে গড়ায়, ছেলেদের পায়ে পায়ে। ছোটবেলায় খড়—বিচলি জড় করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফুটবল খেলতাম আমরা। কয়েকদিনে খেলা যখন বেশ জমে উঠত, তখন সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে কিনতাম আসল ফুটবল। চার নম্বর ডিয়ার, অথবা সুপার। শর্ত থাকতো চাঁদার টাকা যে বেশি দেবে, ফুটবলটা তার ঘরেই থাকবে। অধিকার তারই একটু বেশি।
আকাশে মেঘ ছিল বলে স্কুলে যাওয়া হয়নি। মাথার উপর পাকা ছাদ না থেকে টিনের চাল থাকলে ভালো হতো। শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে শোনা যেত বৃষ্টিপতনের শব্দ। মায়েরা যতই শাসন করুক, তাই বলে কি ছেলে—মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজবে না। ডাক্তারের তেতু—ঔষধ গলাধকরণ কষ্টকর, তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার একশো তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কপালের উপর জল—ন্যাকড়ার ওজন সহ্য করা। তবে বৃষ্টি—ভেজার আনন্দের কাছে এসব কষ্ট, এসব যন্ত্রনা সামান্য নস্যিতূল্য।
বর্ষা আসে, মাছ চুরি করা বেড়ালের মতো চুপিচুপি পালিয়েও যায়। আমাদেরকে দিয়ে যায় কিছু আনন্দ, কিছু মধুর স্মৃতি। আমরা বৃষ্টিজব্দ আবছা—অন্ধকার ঘরে ভাজা শিম বিচি চিবাতে চিবাতে ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনি — “আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে…”

# হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।