অণুগল্প

ভালোবাসা তবে প্রেম নয় || জহির রায়হান

ভালোবাসা,তবে প্রেম নয়…

✍ জহির রায়হান

 

মনটা খুব একটা ভালো ছিল না। বেশ কিছুদিন ধরেই ভালো নেই। তবে আমি আছি, বেশ আছি। কেননা কষ্টগুলো যে খুব মিষ্টই লাগছে। লাগবে না? খুব কাছের একজন মানুষের দেয়া কষ্ট যে!

মনে পড়লো, ‘বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও। মুখের কথায় হয় যে গান, তুমি যদি গাও।’

তবুও মুখে যেন এক চিলতে হালকা মেঘ জমে ছিল, যে মেঘে সম্ভবত বৃষ্টি আসেনা।

শুয়ে ছিলাম, না শোয়ার মত করে। আর যে জিনিসটাকে খুব বেশি ভালো লাগে না, অথচ একেবারেই ছেড়ে দিতেও পারি না, সেই কম ভালোলাগা, কম খারাপ লাগা, কখনওবা  মিষ্টি,কখনওবা  টক-ঝাল মেশানো ফেসবুকে প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার অর্থহীন অপচেষ্টা চলছিল। বুঝতে পারছিলাম ভালো লাগছিল না। কিন্তু বের হতেও কেন যেন ইচ্ছে করছিল না। তাই অনেকটা এলোমেলো পথচলার মতই ফেসবুকিং চলছিল।

 

 

হঠাৎ আমার বৃদ্ধ মোবাইলটাতে একটা কল এসেছে। স্বভাব কিংবা বদঅভ্যাস অনুসারে আগে নাম্বারটির পোস্টমর্টেম করে নেয়া হল। কিন্তু ততক্ষণে বেচারা কলটি কুমারী কলে (মানে মিসড কলে) পরিণত হয়ে উঠেছে। আমিও এ নিয়ে আমার অঘর্মাক্ত মাথাটাকে ঘামাতে দিলাম না। আর সাধারণত এসব ব্যাপারে নাকটাকে অগলিতই রাখি। তাই আবার ফেসবুক, আবারও সেই ফেসবুক।

কিন্তু একটু বাদেই আবার কল বেজে উঠলে এবার আর কুমারী কল হতে দিলাম না। কিন্তু তাতে কী, এ যে আস্ত এক কুমারী।

-আসসালামু আলাইকুম।

ওপাশ থেকে দ্রুত উত্তর শেষ করে

– হ্যালো, আমি অহনা।

– কী ব্যাপার, কী হয়েছে? বলো।

– একটু বাসায় আসেন।

– কেন?

– একটু দরকার আছে।

– কী দরকার বলো?

– না, মানে আপনার জন্য চা তৈরি করছি। আপনি আসেন।

আমার মনে পড়ে গেল, চা খেতে চেয়েছিলাম সেই কবে। এতদিনে উনার বুঝি একটু করুণা হল। বললাম,

– না, দেখো আমি আজ আসতে পারব না।

– উফ্, আসেন তো।

– না, না। আজ নয়। আরেকদিন।

– না, না, আজ আসেন। কিচ্ছু হবে না।

– না, থাক। আজ আসা ঠিক হবে না।

এ কথা শুনে রেগে গিয়ে বললো

– থাক, আপনার খাওয়া লাগবে না। রাখি।

– না, না, রেখো না। শোনো….

হঠাৎ কেন চা, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। বললাম আজ আসা যাবে না, কাল আসবো।

 

 

….অহনা যাকে ভালোবাসে, প্রতিদিনই আসে। ফ্যামিলির উপস্থিতিতেই কথা বলে। কিন্তু তিনি, মানে ওর উনি নাকি মাঝে মাঝেই মুখ ফুলিয়ে রাখেন। তখন তার মুখের মেঘ কাটানোর জন্য নাকি ওকে প্রায়শই ‘প্রিজারভেটিভ’ দিতে হয়।

‘ভালোবাসা’ যখন ‘রিলেশনশিপ’ হয়ে ওঠে, তখন সেই ‘রিলেশনশিপ’কে সতেজ রাখার জন্য ‘প্রিজারভেটিভ’ দিতে হয়। প্রেমিক-প্রেমিকা তখন ইচ্ছায় কিংবা কিঞ্চিৎ ইচ্ছায় ‘ভালোবাসা’কে-ই ‘প্রিজারভেটিভ’ মনে করে ব্যবহার করে। কিন্তু শেষে এসে অবশেষে দেখে যে, এতদিন যে ‘ভালোবাসা’কে ‘প্রিজারভেটিভ’ ভেবেছিল, তা আসলে ‘প্রিজারভেটিভ’ ছিল না, ছিল ‘ফরমালিন’।

 

বললাম, – ঠিক আছে, তাকে চা খাওয়াও। কিন্তু বুঝলাম এই চা আমার জন্যই। কেননা ওর উনার আসতে তখনও অনেক বাকি।

গতকাল তিনি নাকি ওকে একটু কিস দিতে চেয়েছিলেন। ও রাজি হয় নি। বলেছে, ‘এসব থাক। কাল আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াবো।’

অহনা খুব ভাল চা বানাতে পারে, তা নয়। ও আসলে এসব আদৌ পারে না।

কেন জানি না, ও আমার কাছে অনেক কিছুই লুকোতে চাইলেও সহজে পারে না।

প্রথম প্রথম কিছু বলতাম না। পরে মনে হলো, ও সত্যি ভুল করছে। ভালোবাসার সাথে এখনই প্রিজারভেটিভের কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না। এটা পাপ। তাই সেদিন ওকে অনেক করে বোঝালাম। বললাম ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য আরও তো কত উপায় আছে। তুমি রান্না করতে পারো না। সেটা তো তিনি জানেন। তার জন্য কিছু খাবার তৈরি করে তাকে বলো, ‘তুমি তো জানো আমি রান্না করতে পারি না। তবু তোমার জন্য এটা তৈরি করেছি।’ দেখবে তিনি যদি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসেন, তবে তোমার রান্নাটা যেমনই হোক, ওটা তার কাছে অমৃত হয়ে উঠবে।

ফোনে কথা শুনে মনে হল কিছুটা হলেও সেদিনের বোঝানোটা কাজ দিতে শুরু করেছে। আমার খুব ভালো লাগছিল তখন।

কথা তখনও চলছিল।

– আপনি না হয় একটু পরেই আসেন।

– কিছু মনে করো না, দেখো, কাল আসবো।

– আসলে আপনি একটা গাঁধা। মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। রাখছি।

– না, না, শোনো, শোনো, …. কথা শেষ হল না। তার আগেই লাইনচ্যুতি।

 

কিন্তু কী একটা ভালোলাগা যেনো আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কী যে ভালোলাগা, তা বোঝানোর ভাষা আমার নেই। অজান্তেই খুব হাসছিলাম। একা ছিলাম। তাই হাসতে বাধা ছিল না। অনেক্ষণ সে হাসি যেন থামছিল না। বারবার অহনার কথাগুলোই কানে বাজছিল, ‘আপনার জন্য চা তৈরি করছি’। কিংবা ‘আপনি একটা গাঁধা’।

 

রক্তাক্ত প্রান্তরের একটা সংলাপ মনে পড়ছিল। “অন্তরে অমৃত না থাকলে এত গরল উগরে দিতে পারতো না।”

অথচ এই সেই অহনা, যে আমাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে অবহেলা, অবজ্ঞা করে আসছিল।

……কিন্তু আজ?

এটা কি ভালোবাসা?

হ্যাঁ, ভালোবাসাই তো। এটাও ভালোবাসা, তবে প্রেম নয়।

 

যাত্রাবাড়ী,ঢাকা