জীবনের গল্প

শীর্ণকায় লোকটির নাম জানা হয়নি : অভিজিৎ কুমার দাশ

শীর্ণকায় লোকটির নাম জানা হয়নি। জীর্ণ একটি চালকল (Husking Mill)-এ দেখা হয়েছিল শীর্ণকায় মানুষটির সাথে। অটোরাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হাসকিং মিলের দৈন্যদশার কথা জানাছিল; তাই হাসকিং মিলে অর্থায়নের যৌক্তিকতা যাচায়ের উদ্দেশ্যে যাওয়া হয়েছিল সেখানে। গিয়ে দেখলাম জীর্ণ চালকলে তখন উদ্যোক্তা তো নেই-ই; একজন গ্রাহকও নেই; এক বস্তা ধানও নেই; চাতালটি সর্বশেষ কবে ব্যবহার হয়েছিল তাও বোঝার উপায় নেই, ঘাস জন্মেছে চাতালের স্থানে স্থানে। আছে শুধু শীর্ণকায় লোকটি, তাও বেলা বারোটার সময় দিব্যি ঘুমিয়ে! লোকটির পরিচয় পেয়ে ভাবলাম যেমন দশা চালকলের, তেমনই দশা কর্মচারীর!

উদ্যোক্তার জন্য অপেক্ষা; ভাবলাম এই অবসরে কর্মচারীর সাথে একটু আলাপ করি; এতে কিছু বাড়তি তথ্যও পাওয়া যাবে। আলাপে জানা গেল মিলে এখন কেবলমাত্র গৃহস্থরা ধান ভাঙানোর জন্য আসে, তাও বিকালে দিকে; চাতালটিও‌ ধান উঠার মৌসুমে গৃহস্থরা ব্যবহার করে। এবার লোকটির নিজের কথা জানতে চাইলাম; আর তখনই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বিস্ময়। আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কত বেতন পান মাসে?” উত্তরে লোকটি বললো “তিন হাজার টাকা!” কিন্তু এই তিন হাজার টাকা বলার মধ্যে তার মুখে যে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল তা তিন লক্ষ টাকা বেতন পাওয়া ব্যক্তির মুখেও দেখি না। এমনকি আমার মধ্যেও নেই সেই তৃপ্তি বোধ!

প্রথম দর্শনেই শীর্ণকায় লোকটির জন্য সহানুভূতি জন্মেছিল কিন্তু নিজের প্রতি তার সন্তুষ্টি বোধ যেন আমার নিকট ঈর্ষণীয় হয়ে উঠলো! এবার আমি লোকটির পরিবারের সদস্য সংখ্যা জানতে চাইলাম; তিনি বললেন তিনটি ছেলে-মেয়ে, তিনি আর স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। আমি তখন তার তৃপ্তি’র উৎস খুঁজতে ব্যগ্র; আরো আলাপচারিতার পরে লোকটির জায়গা-জমি কতটুকো আছে জানতে চাইলাম; এবার লোকটির মুখে রীতিমত হাসি ফুটে উঠল এবং বললো “বাবার কিছুই ছিল না, ভিটেমাটিও না, আমি কিনেছি, ২২ শতাংশ!” তখন আমি যেন আরো ঈর্ষান্বিত! না তার সম্পত্তি অর্জনের জন্য নয়; বাবা কিছু রেখে যায়নি এমন একটি বিষয়ও হাসি মুখে বলা যায় ভেবে! মনে মনে বললাম লোকটি স্বাভাবিক মস্তিষ্কের তো?

এবার আমি তাকে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি করলাম, তিন হাজার টাকায় তো কোনভাবেই পাঁচজন মানুষের সংসার চলে না; আপনার সংসার চলে কিভাবে? এবারও তিনি হাসি মুখে বললেন “বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে চাতালে ধান শুকিয়ে ভাঙানোর সময় গৃহস্থদের সাহায্য করি; এতে তারা আমাকে বস্তা প্রতি এক-দেড় কেজি করে চাল দেয়। আর ঐ সময়ে যে চাল পাওয়া যায় তা-ই তো আমরা সারা বছরে খেয়ে পারি না! ঘরে চাল থাকলে আর কি লাগে?” আমি আর কথা বাড়ালাম না; আমি তখন বুঝে গেছি লোকটির সুখে থাকার রহস্য; আর লোকটির প্রতি আমার ঈর্ষা তখন শ্রদ্ধায় রুপান্তরিত হয়েছে। আমাদের সীমাহীন চাহিদার বিপরীতে অল্পতেই তুষ্টি লোকটির সুখের মূল কারণ।

ছেলেবেলায় পড়া ‘সুখী মানুষ’ গল্পটি মনে পড়লো। নাট্যকার মমতাজ উদ্‌দীন আহমদের লেখা। গল্পে কবিরাজের পরামর্শ মোতাবেক অত্যাচারী ধনী মোড়লের অসুখ সারানোর জন্য সুখী মানুষের জামা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পাঁচ গ্রাম খুঁজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া যায়নি। অবশেষে বনের মধ্যে এক কাঠুরেকে পাওয়া গেলো, যিনি সারাদিন কাঠ কেটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং নিজেকে সুখী দাবি করেন। কিন্তু সুখী মানুষটির নিকট জামা চাইতেই জানা গেলো তার কোন জামা নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম গল্পেও সুখী মানুষের খোঁজ পাওয়ার জন্য বনে যেতে হয়েছিল; আর আমি সুখী মানুষের খোঁজ পেলাম একটি বাজারে!

শীর্ণকায় লোকটির মাধ্যমে আমার একটি বিষয়ে বিশ্বাস দৃঢ় হলো: সুখ অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের সাথে সম্পর্কিত নয়। মানুষ যথেষ্ঠ অর্থ উপার্জন করুক, বা না করুক, যখন মানুষ একটি শক্তিশালী সমাজের মধ্যে স্বস্তিকর ও নিরাপদ জীবন উপভোগ করতে পারে তখনই মানুষ সুখী হয়। লোকটি তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই আলাপ আর ভাবনার মাঝে শীর্ণকায় মানুষটির নাম জানা হয়নি; আসলে আমি ইচ্ছে করেই জানতে চাইনি; কারণ ততক্ষণে আমি শীর্ণকায় লোকটির নাম মনে মনে ভেবে নিয়েছি, ‘সুখী মানুষ’!

লেখক: উপ-ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ।