রঙের জীবন

‘ক্রিকেট ব্যাট অথবা স্টেনগান এর গল্প’ || আদিল

‘ক্রিকেট ব্যাট অথবা স্টেনগান এর গল্প’

– আদিল

 

১.

শীত ঋতু প্রায় শেষ।এপ্রিল মাসের দশ দিন ইতিমধ্যে পার হয়ে গিয়েছে। দুই দিনের বিরতিতে বোনের সাথে দেখা করতে এসেছে রুস্তম।দুই দিন পর পরবর্তী আক্রমন।নিজেদের কে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করতে হয়ত ক্যাপ্টেন এই ফর্মুলা নিয়েছেন।পরবর্তী টার্গেটটা অনেক বড় বলেই বাড়তি সতর্কতা..

-ভাই!

-কি হয়েছে আপা!

-নিজের মুখের অবস্থা দেখেছিস একবার?

মনে মনে হাসল রুস্তম।কি আর হবে? হয়ত দাড়ি মোচে ঢেকে গিয়ে মুখটা আমাজন জঙ্গলের মত হয়ে গিয়েছে।অনেকদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখা হয় না।অবশ্য এখানে ওর কোনো দোষ নেই।আয়নার সামনে দাঁড়ানোর ফুসরৎ ই বা কোথায়!

অনেক ব্যস্ততা তার এই সময়ে..

-আরেকটু মাছ দিবি আপা?

মুচকি হেসে রুস্তমের পাতে অনেকখানি মাছ উঠিয়ে দেয় তার মিতু আপা।ভাইকে পাশে বসিয়ে তার প্রিয় টেংরা মাছ রেঁধে খাওয়ানোর মধ্যে একরকম সুখ খুঁজে পান মিতু।যদিও ইদানিং সেই সুযোগটা সে কমই পায়। এখন তাদের বাসায় খুব কমই আসে রুস্তম….

-আব্বা আম্মার সাথে দেখা করবি না?

খাওয়ার মাঝখানে খুব কম কথা বলে রুস্তম।যথারীতি মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিল রুস্তম। কিছুটা অবাক হয় মিতু। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করে,

-দেখা করবি না মানে?

এবার বিরক্ত হয় রুস্তম।খাওয়ার মাঝখানে কথা বলা সে একদম পছন্দ করে না।

মুখ বাঁকা করে উত্তর দেয়,

-করব না মানে করব না।তাছাড়া এখন আব্বা আম্মার সাথে দেখা হলে তারা আমাকে ছাড়বে ভেবেছিস?

-না ছাড়লে থেকে যাবি!

-থাকব মানে? এখন থেকে যাওয়ার সময় না।তুই এরকম করলে আমি তোর সাথেই দেখা করব না আপা!

-আচ্ছা করব না। তবুও তুই মাঝে মধ্যে আমাকে দেখা দিয়ে যাস ভাই। আবার বড় টেনশন হয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে

মৃদু হাসল রুস্তম। নারী জাতিটা এরকমই। প্রিয় মানুষদের প্রতি অপরিসীম টান থাকে তাদের।সাথে দুশ্চিন্তাও।মনে মনে ভাবল এখনই বাইরে থেকে একবার ঘুরে আসতে হবে।

 

২.

যদিও রোদটা শীতের সকালের মত মিষ্টি না তথাপি এই হালকা রোদের মধ্য দিয়ে হাটতে খুব একটা খারাপ লাগছে না।অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে রোদটা তাঁতিয়ে উঠবে। আজাদ বয়েজ ক্লাবের মাঠে একবার ঘুরে আসা দরকার। মনে মনে ভাবল রুস্তম। পরক্ষনে আবার ডিশিসন চেঞ্জ করল। এখন এসব জায়গা ঘুরে বেড়ানো ততটা নিরাপদ না। তাছাড়া এখন সেখানে গেলে তার মনটা খারাপ হয়ে যাবে নিশ্চিত।আউয়াল ভাইয়ের জন্য।আউয়াল ভাই ক্রাকডাউনের রাত্রে মারা গিয়েছেন।ক্লাবের বড় ভাইসম মানুষ ছিলেন। রুস্তমকে অনেক স্নেহ করতেন। এখন আউয়াল ভাইয়ের কথাটা মাথায় আনা উচিত হবে না তার। ইদানিং নিজেকে চিনতে পারে না রুস্তম। আউয়াল ভাই,২৫শে মার্চ ইত্যাদি কথা গুলোর কথা গুলো মনে পড়লেই নিজের মধ্যে কেমন যেনো উত্তেজনা চলে আসে।হাত মুষ্টিবদ্ধ, চোখে মুখে কাঠিন্য এসে পড়ে।টিম ডিনামাইট এর সদস্যদের সাথে দেখা করে টার্গেট সম্পর্কে কতটুকো তথ্য নেয়া হয়েছে তা একবার তদারকি করা দরকার! চারিদিকে একবার সতর্ক চোখে তাকিয়ে ত্রস্ত পায়ে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে হাঁটা দিল রুস্তম।

 

৩.

-রুস্তম, একটু এদিকে আয় তো

-বলেন বস্…..

-আরে বস্ টস রাখ। ছেলেটাকে তোর সাথে প্রাকটিসে নিয়ে যা। কোয়ালিটি আছে। ভাগ্য সহায় হলে তোর সাথে পাকিস্তান টিমে ওপেন করবে।

বিরক্তি ভরা মুখে রুস্তম বলল

-পাকিস্তান টিম না বস্। স্বাধীন বাংলা টিম।বিশ্ব কাঁপানো টিম হবে আমাদের..

এবার অবাক হয় আউয়াল। বলে কি ছেলেটা! স্বাধীন বাংলা টিম! হতেও পারে।শেখ সাহেবের রেসকোর্সে দেয়া ভাষণে ছেলেদের রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। খুব সম্ভবত দেশে বড় রকমের গণ্ডগোল হতে চলেছে।

-আচ্ছা ঠিক আছে। তুই এখন প্রাকটিসে যা। বিকেলে ম্যাচ আছে…

চোখে মুখে নতুন বাংলার স্বপ্ন নিয়ে প্রাকটিসে চলে গেল রুস্তম। অপরদিকে আউয়ালের কানে তখনো বাজছে, -পাকিস্তান টিম না বস। স্বাধীন বাংলা টিম।বিশ্ব কাঁপানো টিম হবে আমাদের। হঠাৎ করে ফিক করে হেসে ফেলে আউয়াল।এই হাসিটা সে কেন হাসল সম্ভবত আউয়াল নিজেও জানে না।

 

৪.

অ্যাটাক শেষে নির্ধারিত স্থানে ফিরে এসেছে টিম ডিনামাইটস এর গেরিলাদের একাংশ। অবশ্য এখন ওরা গেরিলা থেকে বেশি পরিচিত বিচ্ছু নামে।মিলিটারিদের ত্রাস। অ্যাটাকটা সফল হয়েছে।সবাই মোটামুটি ঠিক আছে। কেবল মাত্র রুস্তমের ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল ছুঁয়ে একটা গুলি বেরিয়ে গিয়েছে। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। অনেকক্ষণ নিরীক্ষা করার পর গম্ভীর গলায় বললেন,

-তোমার তিনটে আঙ্গুল কেটে ফেলতে হবে রুস্তম।

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রুস্তম। বোধহয় বড় রকমের একটা শক খেল। তার মুখ দেখে মনে হবে ফাঁসির সংবাদেও সে এরকম হতবিহ্বল হত না। ধরা গলায় ডাক্তারকে বলল,

-আঙ্গুল তিনটে কাটবেন না স্যার। আমি আরো অনেক সময় যুদ্ধে থাকতে চাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি দেশের হয়ে ওপেন করমু।

অবাক হয়ে গেলেন ডক্টর।রুস্তমের চোখদুটোতে তখন লাখো স্বপ্নের হাতছানি!সচারচর এরকম স্বপ্নবাজ যে মানুষ দেখতে পাওয়া যায় না!

-ওকে ম্যান। তোমার আঙ্গুল কাটা যাবে না

যুদ্ধ জয়ের হাসি তখন রুস্তমের মুখে। আঙ্গুল গুলো কাটা গেলো না তার। কিছুদিন এর মধ্যে সুস্থ হয়ে পুনরায় মেতে গেল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়।

 

৫.

নিজেদের করা সবথেকে ভয়াবহ অপারেশনটা সফল করে পরবর্তী আক্রমনের ছক কষছে টিম ডিনামাইটস এর গেরিলারা। মাত্র পাঁচ মিনিটে দুইটা মিলিটারি জিপ উড়িয়ে দিয়েছে।১৭ জন স্পট ডেড। অনেকগুলা আহত।বাহ্যিক দৃষ্টিতে আক্রমনটা ছোট বলে মনে হলেও এটার অ্যাফেকশন অনেক গভীর।অন্তত মাস দুয়েক মিলিটারিরা বেশ ভয়ে থাকবে।রুস্তম জানে মিলিটারিদের এই ক্রাশ হওয়ার খবর ঘন্টা খানেক এর মধ্যে সব জায়গায় ছড়িয়ে যাবে।মুক্তির আশায় হাঁস-ফাঁস করা মানুষগুলো একটু আশার আলো দেখবে।রুস্তম ভাবে, যে দেশে এত মুক্তিপাগল সেদেশকে কখনই পদতলে রাখতে পারবে না হানাদাররা। মীরাটার একবার খোঁজ নেয়া দরকার। গণ্ডগোলের মধ্যে কেমন আছে মেয়েটা?ইদানিং মীরার কথা মনে আসলে নিজের মধ্যে পুলক অনুভব করে। নিজের অজান্তেই একটা মুচকি হাসি বের হয়ে আসে মুখ থেকে।ব্যাপারটা খেয়াল করে মুরাদ।মুচকি হেসে প্রশ্ন করে..

-কিরে!! একা একা হাসছিস যে?

রুস্তম জানে এখন টপিকটা হবে ওর আর মীরাকে কেন্দ্র করে। মীরার সাথে কোনো রিলেশন নেই রুস্তম।কিন্তু সেটা মানতে নারাজ তাঁর বাকী সহযোদ্ধােরা।এটা নিয়ে ঠাট্টা চলবে।তাই সুকৌশলে আড্ডার টপিকটা চেঞ্জ করার চেষ্টা করে রুস্তম,

-আরে, এমনিই হাসছি।আচ্ছা হানাদাররা কি বোকা তাই না! তুই ওদিক হতে দু রাউন্ড গুলি———

দরজায় ঠকঠক শব্দে কথাটা শেষ করতে পারল না রুস্তম।রক্তশুন্য হয়ে গেল ওদের মুখ।অজানায় আশঙ্কায় ভীত চোখগুলো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।বুটের আঘাতে দরজা ভেঙ্গে গিয়েছে ততক্ষণে।অস্ত্রহীন থাকার কারণে বিনে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করল টিম ডিনামাইট এর গেরিলারা।

 

৬.

জেলটার নাম এখনো জানতে পারেনি রুস্তম।এছাড়া ওর সঙ্গী সাথীরা কোথায় আছে সে জানে না। নিরস্ত্র থাকার কারণে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় সহজেই ওদের ধরে ফেলে পাকবাহিনী।চোখ খোলার পর রুস্তম আবিষ্কার করল সে এখন একটা জেলখানায় বন্দী……

-রুস্তম সাহেব, কেমন আছেন?

চেহারা না দেখলেও রুস্তম বুঝতে পারে এটা জামাল মাতাব্বর। এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান। বাঙ্গালী হয়েও পাকিস্তানীদের পা চাঁটা কুত্তা হয়েছে।প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু সম্ভব না। সংক্ষেপে উত্তর দিল,

-ভালো আছি।

-কিন্তু আমাদেরকে তো ভালো থাকতে দিচ্ছেন না!

-হাসালেন মাতাব্বর সাহেব।দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না!

মুখের উপর যেনো একটা থাপ্পড় খেলেন জামাল মাতাব্বর !সেটা হজম করে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

-আপনাদের অস্ত্রের চালানটা কোথা দিয়ে আসে?

-কেন বলব?

-নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য বলবেন।আমি কথা দিচ্ছি আপনি আমার সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিলে আপনাকে ছেড়ে দিব।

জামাল মাতাব্বরের কথা শেষ হওয়ার আগেই হো হো করে হেসে উঠল রুস্তম।পুরো রুম কাঁপানো হাসি।প্রবল হাসির শব্দে খানিকটা চমকে গেলেন জামাল মাতাব্বর।পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন করলো,

-হাসছেন যে!

-হাসছি আপনার মূর্খতামি দেখে।কি যেনো বললেন?সব তথ্য দিলে আপনি আমাকে ছেড়ে দিবেন? আপনি কি করে ভাবলেন?যখন দেশ-ই আমার পরিবার তখন নিজের পরিবারের জন্য দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব!!!

-নিজের থেকে দেশের প্রতি বেশী দরদ হয়ে গিয়েছে তাই না? সোজা কথায় কাজ হবে না দেখছি!

টানা আধাঘন্টা টর্চার করার পরও ওর থেকে কোনো প্রকার তথ্য নিতে ব্যর্থ হলো মানসুর।কিছুতেই মুখ খুলছে না রুস্তম।অত্যাচারে সব কৌশলই প্রয়োগ করা হয়েছে রুস্তমের উপর।নখ উপরে ফেলা,দুই কাঠির মধ্যে আঙ্গুল রেখে ভেঙ্গে ফেলা,গরম পানি গায়ে ঢালা ইত্যাদি।কিন্তু রুস্তম তাঁর স্বীদ্ধান্তে অটল।সব কৌশলে ব্যর্থ হয়ে মিলিটারিদের একজনের কানে কি যেনো বললেন মাতাব্বর।কিছুক্ষণ পর একটা মিলিটারি বাসে করে রুস্তম সহ বাকী গেরিলাদের বিলের ধারে নিয়ে যাওয়া হল।

 

৭.

রেডিওতে খবরটা শোনার পর থেকে নিজের মধ্যে একধরনের পুলক অনুভব করছে নাছিমা আফরোজ মিতু।আজ বিকেলে নাকি পাকবাহিনীর সারেণ্ডারের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবে।তাহলে হয়ত রুস্তম ফিরে আসবে।সেই যে মে মাসে ভাইটা নিখোঁজ হল আর ফিরে আসল না।আব্বা আম্মাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দমিয়ে রেখেছে। ভাইকে হারিয়ে প্রথম প্রথম খুব খারাপ লেগেছিল মিতুর।কান্নাকাটিও করেছিল খুব। কিন্তু এখন আর কান্নাকাটি করে না এই ভেবে যে দেশ স্বাধীন হলে রুস্তম নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।তার স্বামী কোথা হতে যেনো একটা পতাকা সংগ্রহ করে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে টাঙিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।স্বামীকে উদ্দেশ্য করে সে বলল,

-পতাকা আরেকটু উপরে লাগাও।রুস্তম আসলেই যেনো চোখে পড়ে!

-আচ্ছা লাগাচ্ছি।আর ট্যাংরা মাছগুলোকে একটু ভালোভাবে রান্না করো।রুস্তমটা অনেকদিন পর আসতেছে।

-আচ্ছা।

দ্রুত পায়ে ঘরে চলে গেলো রুস্তমের মিতু আপা।আজ তার অনেক কাজ।তার কানে কেবল একটা কথাই বাজছে “রুস্তমটা ফিরছে আজ”

সত্যিই কি ফিরছে রুস্তম?হয়ত ফিরছে অথবা ফিরছে না।