আজকাল স্পষ্ট ভাষায় ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা না বলে বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ক্ষমতাকে ‘কর্তৃত্ববাদ’ বলার চল হয়েছে। এটা ইংরেজি ‘ডিক্টেটরিয়াল রুল’-এর বাংলা অনুবাদ। কিন্তু খুবই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই ধারণাটি চালু হোল। ফ্যসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিছকই ডিক্টেটরিয়াল কিম্বা কর্তৃত্ববাদী শাসন না। যারা ‘কর্তৃত্ববাদ’ মার্কা তত্ত্ব দিচ্ছেন তারা বলতে চাইছেন, একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির হাতে সকল ‘কর্তৃত্ব’ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, অতএব তাকে সরালেই বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।
এদের আপনি সহজেই চিনবেন। এরা এর আগে এক এগারো ঘটিয়ে ‘মাইনাস টু’ ঘটাতে চেয়েছিল। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে এরাই দাবি করছিল, আমরাই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এনেছি।
তখন আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারা দাবি করত বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুই ‘ব্যাটলিং বেগমস’। যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাঘটনে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ডব্লিওটিও, পরাশক্তি ইত্যাদির কোন ভূমিকা নাই। এমনকি দিল্লীও কোন ভূমিকা নাই। যেন, ইসলাম আতংক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ সুবাতাস হিসাবে দুনিয়া জুড়ে বইছে। বাস্তব পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিয়ে চটকদার ‘ব্যাটলিং বেগমস’ দিয়ে রাজনীতি ব্যাখ্যার অতি সরলীকৃত পদ্ধতি জনপ্রিয় করে তোলা হল। এই সময়েই দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ ধারনা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যাখ্যা করার একটা দারুন চল দেখা গিয়েছিল। দাবি করা হোত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্দশার জন্য খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার ঝগড়াবিবাদই শুধু দায়ী। আর কেউ না, আর কিছু না। এদের ‘ব্যাটল’ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে দুই বেগমকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে অপসারন করতে হবে।
মাত্র কিছুদিন আগের এই ইতিহাস। ভুলে যাবেন না। যারা আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন, বাংলাদেশের রাজনীতির এই সরলীকরণের বিরুদ্ধে আমি সবসময়ই সোচ্চার থেকেছি এবং এক এগারো ঘটিয়ে ‘মাইনাস টু’ প্রকল্প বাস্তবায়নের নিরাপোষ বিরোধিতা করেছি। সে সময় আমি সবাইকে একটি কথাই বোঝাতে চেয়েছি। সেটা হোল যেমন প্রজা, তেমনই রাজা। আমরা যেমন, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও তেমনই হবে। তাহলে দরকার নাগরিক মানবিক অধিকার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং সর্বোপরি কিভাবে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দিতে হয় সে ব্যাপারে আমাদের নিজেদের সচেতনতা অর্জন করা। গণক্ষমতা তৈরি এবং গণপ্রতিরক্ষার জন্য নিজেদের সংগঠিত করাই প্রধান কাজ। নিজেদের বুঝ নিজেরা ঠিক না করলে বানরে পাকা কলা বারবারই খেয়ে যাবে।
মাইনাস টু যারা কার্যকর করতে চেয়েছে তারা এখন বিশ্বাস করে খালেদা জিয়াকে তারা ‘মাইনাস’ করতে পেরেছে, এখন বাকি আছে শেখ হাসিনা। তাকে মাইনাস করতে হবে। ফ্যাসিবাদের পরিবর্তে ‘কর্তৃত্ববাদ’ নামক গড়ে হরিবোল ধারণা চালু করে তারা এই ধারণাই প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে বর্তমান ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসককে উৎখাত করা গেলেই বাংলাদেশ ঠিক হয়ে যাবে। ‘কর্তৃত্ববাদ’ ধারণা এবং এখন তার ব্যাপক প্রয়োগের মধ্যে আমি এই আওয়াজই শুনতে পাচ্ছি।
সামরিক একনায়কতন্ত্র, সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বাকশালী শাসন এবং এখনকার দিল্লী সমর্থিত বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র — সবই ‘কর্তৃত্ববাদ’। তাই ‘কর্তৃত্ববাদ’ দিয়ে কিছুই বোঝা যায় না। বরং জনগণকে সুনির্দিষ্ট ভাবে দিল্লী সমর্থিত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্তব্য থেকে সরিয়ে আনবার জন্যই এই গড়ে হরিবোল ধারণাটির ব্যবহার ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিকে হঠিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখা।
জনগণের সমস্যা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিশাবে খালেদা বা হাসিনা না। জনগণের সমস্যা ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিষ্কার ভাবে চেনা। চিনলেই লড়া যায়। চিনিনা বলেই জনগণের দুর্দশা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ‘কর্তৃত্ববাদ’ দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাই হুঁশিয়ার হবার সময় এসেছে।
ব্যক্তিকে সরালে ব্যবস্থার কোন হেরফের হয় না। অক্ষুণ্ণ থাকে। অতএব ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বুঝতে শিখুন। ব্যবস্থা উৎখাত হলে ব্যক্তিও আর টেঁকে না। কিন্তু ব্যাক্তিকে সরিয়ে ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যায়।
যদি বুঝি তাহলে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ফলে তৈরি জনসচেতনতাকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরিণত করাই এখনকার কাজ। ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার অধীনে ‘বিচার’ চাওয়া অর্থহীন। তামাশাও বটে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকেই আরও পাকাপোক্ত করে। কারন এখনও বাংলাদেশে তরুণ ছাত্রছাত্রীরাই সংগ্রামী আন্দোলনের অগ্রভাগে রয়েছে এবং নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তাহলে আসুন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে বলতে আমরা কি বুঝি তা নিয়ে আলোচনা করি। কেবল তখনই জনগণের বর্তমান কর্তব্য আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝতে পারব।
আপনার মন্তব্য লিখুন