সবুজ খন্দকার:
চলচ্চিত্র: সাপলুডু
পরিচালক: গোলাম সোহরাব দোদুল
কলাকুশলী: আরিফিন শুভ, বিদ্যা সিনহা মিম, তারিক আনাম খান, জাহিদ হাসান, সালাউদ্দিন লাভলু
দেশ: বাংলাদেশ
সাল: ২০১৯
রেটিং: ৩/৫
যে ছবির কাহিনিই নায়ক
আরিফিন শুভকে বলা হচ্ছে এই সিনেমার নায়ক, কিন্তু আসলেই কি তাই? অন্তত আমার তা সিনেমা হলে বসে একবারও মনে হয়নি। বরং বাঘা বাঘা সব অভিনেতার ভীড়ে শুভকে অনেকটা ম্লানই লেগেছে। খোদ শুভও বোধকরি সেটা জেনেই প্রচারনায় অংশ নেওয়া সব আলাপে বলেছেন, গল্পটাই ছবির হিরো।
শুধু আরিফিন শুভ নন, বিদ্যা সিনহা মিমকেও কান্না, কিছু প্রেম আর নিরব থাকা ছাড়া খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়নি। তবুও বলবো এই দুইজন অভিনয় কিন্তু খারাপ করেননি। গল্পের প্রয়োজনে তাদের হয়তো ওইটুকুই যথেষ্ট ছিলো। একটি থ্রিলার গল্পের মূল উপাদান গল্পের গাঁথুনি আর শেষ অবদি গল্পের উত্তেজনা ধরে রাখা। সাপলুডু কতটা পেরেছে সেটা? আসুন দেখা যাক।
গল্প সংক্ষেপ
পাহাড়ি আদিবাসী অধ্যুষিত এক গ্রামের বার্ষিক অনুষ্ঠানে হামলা চালায় একদল স্বার্থান্বেষী। তারা কে বা কারা তা কেউ জানে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পুষ্প সেই গ্রামের এক নেতার মেয়ে। প্রতি বছরের মতো এবারও ছুটিতে এলাকায় এসেছেন। কিন্তু এই ঘটনায় ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার পাশাপাশি সেই দলটি মেরে ফেলে পুষ্পের বাবাকেও। পুষ্প পালিয়ে যায়। ঘটনাক্রমে আলোকচিত্রী আশফাক ছবি তোলার কাজে সেই গ্রামেই ছিলেন। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে এই হামলার সাথে জড়িতদের কিছু প্রমাণ। এটা দেখে ফেলে শত্রু পক্ষ। পালিয়ে যান আশফাক এবং দেশের কথা ভেবে ক্যামেরার মেমোরি কার্ডটি হস্তান্তর করেন একজনের কাছে।
সিনেমার শুরুতেই আমরা দেখি, আরমান পাশের গ্রামে যাবার আগেই পালিয়ে আসা পুষ্প ও সাথে থাকা তিতলির সাথে দেখা হয়। শত্রুরা আক্রমণ করলে সে তাদের নিয়ে নিজের গ্রামে আসে এবং বড়ভাই ইরফানের কাছে আশ্রয় চায়। ইরফান তাকে তরুছায়া সংগঠনের ফ্লোরার কাছে রাখে। আহসানউল্লাহর রাজনৈতিক সব তদারকি করে ইরফান। উপরমহল থেকে আহসানের উপর চাপ বাড়ে এবং সে পুষ্পের সাথে আলাপ করেও খুব একটা কিছু উদ্ধার করতে পারে না। মরার উপর খাড়ার ঘা হয় স্থানীয় হাতপাতালে এক বোমা হামলা। সেখানে মারা যায় বাচ্চা মেয়ে তিতলি আর আহসানের লোকসহ অনেক নিরীহ মানুষ। এডিসি নজরুল এসব কিছুর পেছনে আহসানের লোকদের হাত আছে বলে প্রমাণ করে, কিন্তু আহসান তা অস্বীকার করে। আরমান হামলার সাথে জড়িত একজনকে চিনে ফেলে ও তাকে ধরতে গিয়ে ফেঁসে যায়। এর মাঝে আততায়ীরা ফ্লোরা আর আরমানের মাকেও মেরে ফেলে। পালিয়ে যেতে গিয়ে এনকাউন্টারে পড়ে যায় আরমান। ইরফান পুষ্পকে সামনে রেখে ভাই আহসানের বিরুদ্ধে লোক খেপিয়ে তোলে হত্যার বিচারের দাবিতে। আরমান জনগণের সামনে মারা গেলেও এডিসি নজরুলের হাতে তৈরি হয় কালাচান নামে পরিণত এক যোদ্ধায়। বিভিন্ন ঘাত পেরিয়ে ছদ্মনামে কালাচান বের করে সেই মেমোরি কার্ডের অবস্থান। কিন্তু জানতে পারে না তখনও কে আসলে এতগুলো খুন আর ফটোগ্রাফার গুমের পেছনে দায়ী। আপনাকে সেটা জানতে হলে হলে পুরোটা ছবিটা দেখতে হবে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ।
কেমন ছিল অভিনয়
তারিক আনাম, জাহিদ হাসান আর সালাউদ্দিন লাভলুর ত্রিমুখী অভিনয়ের তোড়ে অনেকটাই টালমাটাল ছিলেন নায়ক আরিফিন শুভ। যার যার জায়গা থেকে এই তিনজন অসামান্য। আরিফিন শুভ ছবির প্রথম অংশ থেকে পরের অংশে অনেকটাই সরব থাকলেও তাকে একটা খেলার গুটির মতই লেগেছে। তার কিছু এক্সপ্রেশনে উন্নতি চোখে পড়েছে। মিমের খুব একটা অভিনয়ের জায়গা না থাকলেও সে ভাল করেছে। রুনা খানের বিড়ি টানার দৃশ্য দর্শককে বিনোদন দিয়েছে। শতাব্দী, মারজুক রাসেল, ইন্তেখাব দিনার এক কথায় অসাধারণ। সুষমা সরকার কিংবা শিল্পী সরকার অপু খুব একটা অভিনয়ের জায়গা পাননি। তবে ভালো করেছেন।
পরিচালনা
পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুলের টিভিতে পর্দার পেছনে কাজ করার অভিজ্ঞতা ১৮ বছরের মতো। অনেক টিভি নির্মাতারা যখন অনেক আগেই বড় পর্দায় চলে এসেছেন সেখানে বলা হচ্ছে দেরি করেছেন দোদুল। তবে দর্শক গল্পের জন্য কতটা প্রস্তুত, ইন্ডাস্ট্রি কী ধরনের গল্প চায়, সেটা ঠিকঠাক বানাতে, এটাকে দেরি বলবো না। ছবিতে একের সাথে অন্যের খেলা আর গল্পে চরিত্রগুলোর রং বদলানো, এতগুলো জাত অভিনেতা নিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজটা বের করে আনতে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। দর্শককে প্রথম ছবিতে থ্রিলার স্বাদ দিয়ে সিটে বসিয়ে রাখতে পেরেছেন। তাই তাকে সাধুবাদ। কাহিনি অনুসারে পরিচালনা ভালই ছিলো। বিশেষ করে প্রতিটি নতুন চরিত্রকে যার যার স্থান থেকে দারুণভাবে ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেছেন বলে এত চরিত্র থাকার পরেও খারাপ লাগেনি।বরং দর্শকদের হইহই করতে দেখেছি। কাউকে একক গুরুত্ব না দিয়ে গল্পটাকে বলে গেছেন সুন্দরভাবে। শেষ দৃশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন আবারও নতুন কোন খেলা শুরুর।
চিত্রনাট্য ও সংলাপ
কাহিনি অনুযায়ী চিত্রনাট্য ভালোই সাজানো, তবে টুইস্টটা ধরে রাখতে গিয়ে কিছু জায়গায় এত বর্ণনামূলক আর বিবৃতিমূলক সংলাপ ছিলো যেটা বিরক্তিকর। আরিফিন শুভর পাখি নিয়ে রসিকতা আর সালাউদ্দিন লাভলুর আঞ্চলিকতা বেশ ভালো ছিল। তারিক আনামের সংলাপ ছিলো অনেকটাই এলাকার নেতা হিসেবে খুব সাধারণ। তবে ছোট ছোট চরিত্র করা প্রত্যেকে তাদের জায়গায় একশ ভাগ দিয়েছেন বলাই যায়। মিমের সংলাপ খুব একটা মনে রাখার মতো ছিল না।
সংগীতায়োজন
ময়না ধুম বাদে বাকি গানগুলো অপ্রসাঙ্গিক লেগেছে। কণা তার আয়ত্বকরা ভাষায় দারুণ গেয়েছেন। মিউজিকে ইমন সাহা বরাবরই ভালো। হৃদয় খান স্যাড ঘরানার গানটা ভালো গাইলেও আহামরি কিছু না। ইমরানের সুফি গানে নতুনত্ব ছিলো।
দৃশ্যায়ন, সেট ডিজাইন, গ্রাফিক্স
টেকনাফ, উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে, পুরান ঢাকাসহ কয়েকটি স্থানে শুট হয়েছে। রাজু রাজ ক্যামেরা ও ড্রোনে চোখের শান্তি দিয়েছেন। অন্ধকার আর আলোর খেলা, চেজিং দৃশ্য দারুণ ছিলো। তবে লং শট খুব একটা ভালো লাগেনি। কালার গ্রেডিং নিয়ে অভিযোগ থেকেই যাবে। সেট ডিজাইন ভালো ছিলো। শুধু জঙ্গলের টায়ারে আগুন লাগিয়ে পথ আটকানোটা চোখে লেগেছে। বিস্ফোরণের দৃশ্য ও গ্রাফিক্সের কাজ মোটামুটি।
দুর্বল দিক
বিরতির পর অতিঅভিনয় বা অনেক বিবৃতিমূলক সংলাপ বিরক্তিকর লেগেছে। সাধারণ একটি টুইস্টকে টেনে ধরে রাখায় মাঝে গল্প কিছুটা পড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে যদি শুভকে ধরা হয়, তবে এটি খুব দুর্বল দিক। কারণ তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির মতো এখানে তার ক্যারিশমাটিক তেমন কিছু নেই। দুবার গুলি করতে গিয়ে একবার ফেসেছেন অন্যবার পায়ে গুলি খেয়েছেন। কিছু জায়গায় পার্শ্ব অভিনেতার দাপটে চাপা পড়েছেন। খুব আশা নিয়ে যারা যাবেন বা বাইরের থ্রিলার দেখে অভ্যস্ত, তারা হয়তো টুইস্টটা সহজেই বুঝে যাবেন।
শক্তিশালী দিক
সাধারণ দর্শক শেষ অবদি ছবিটি না দেখে উঠতে পারেননি। কারণ ছবিতে আসলে একক কোনো আধিপত্যবিস্তারকারী নায়ক নেই। ছবির অভিনয় মন মাতানো, গল্পের গাঁথুনি কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক। একেবারে শেষ দৃশ্যে সিকুয়াল হবার ইঙ্গিত দেয়া দর্শকের আগ্রহের আরেকটি কারণ। বোঝা গেল, খেলা এখনো শেষ হয়নি।
শেষকথা
বাংলা সিনেমায় বস্তাপচা ছবির আকালের দিনে, কোনো উৎসব বাদে সাপলুডুর মতো সিনেমা একটা স্বস্তির জায়গা। সেজন্য বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়াকে ধন্যবাদ জানানোর আছে। প্রথম সপ্তাহে ৪২টি হল পেলেও ছবিটি কয়েক সপ্তাহ ধরে অল্প করে হলেও চলার কথা। কারণ এতে মৌলিক গল্প আছে। প্রথম সিনেমা হিসেবে পরিচালক গল্প নির্বাচন ভালো করেছেন। আশা করছি তিনি নিয়মিত হবেন।
আপনার মন্তব্য লিখুন