জীবনের গল্প

মাচিকো কিও জীবনী

সবুজ খন্দকার:

অড্রে হেপবার্ন কিংবা মেরিলিন মনরো। তারকা বললে দুজনের একজন উঁকি দেবেনই, দিব্যি করে বলতে পারি। পঞ্চাশের দশক তখন। জাপানে এক নারী তারকার দ্যুতি নিয়ে প্রথম হাজির হলেন রূপালি পর্দায়। জাপানি সিনেপ্রেমীদের মতো আমারও তাঁর জৌলুশে মোহবিষ্ট হই। কারণ তখনো জাপানি সিনেমাতে নারীর অংশগ্রহণ ততটা ঝলমলে নয়। আমরা আরও আগ্রহী হই তাঁর প্রতি। তাঁর প্রথম সিনেমার পরিচালক যে ছিলেন জাপানের পন্ডিত সিনেমা করিয়ে, আকিরা কুরাসাওয়া। এরপর তাঁকে দেখব আরও জাপানের সিনেমার নানা মাস্টার মশাইদের সিনেমাতে। ইয়াসুজিরো ওজু, তেনোসুকি কিনুগাসা, কেনজি মিজোগুচি, কেন ইচিকাওয়ার মতো মাস্টারদের হাতে তিনি অভিনয়ে হয়ে ওঠেন পোক্ত। মাচিকো কিও; জাপানের গ্রাঁ প্রি অভিধায় ভূষিত শিল্পীকে নিয়ে আজকের বয়ান।

আকিরা কুরাসাওয়ার রশোমন সিনেমার সামুরাইয়ের স্ত্রীর চরিত্রে জীবনের প্রথম অভিনয়। তবে মাচিকোর যাত্রাটা খুব একটা সহজ ছিল না। ১৯২৪ সালে জাপানের ওসাকার মোতোকো ইয়ানোতে এই অভিনেত্রীর জন্ম। জাপানের বড় বড় সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন দীর্ঘ অভিনয়জীবনে। তিনি জাপানে নারী তারকা হিসেবে এক কিংবদন্তি। জাপানি চলচ্চিত্রে তাঁর আগে কেউ এতটা ঝলমলে হয়ে দেখা দেয়নি। যদিও মাচিকোর সৃজনশীল যাত্রা শুরু হয়েছিল অভিনয় নয়, নাচ দিয়ে।

পাঁচ বছর বয়সে মাচিকোর বাবা তাঁকে ছেড়ে চলে যান। এরপর মা ও নানীর কাছেই বড় হয়েছেন মাচিকো। মাচিকো কিও হিসেবে তিনি পরিচিত হলেও তাঁর নাম ছিল কিও। ১২ বছর বয়সে নাচের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তাঁর নাম হয় মাচিকো। তিনি সেখানে নাচ শেখেন। ১৯৪৯ সালে সিনেমাতে ঢোকার আগ পর্যন্ত সেখানেই নাচিয়ে হিসেবে কাজ করেন।

 

১৯৪৯ সাল। প্রযোজক মাসাইকি নাগাতার চোখে পড়েন মাচিকো। নাগাতার সঙ্গে একটি রোমান্টিক সম্পর্কেও জড়িয়ে যান মাচিকো। সেই নাগাতাই তাঁকে রূপালি জগতের ঝলমলে দুনিয়ায় নিয়ে আসেন। তিনি হয়ে ওঠেন জাপানের নারী তারকা।

১৯৫০ সাল। বিখ্যিাত পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া হাত দিয়েছেন রশোমন তৈরিতে। এই সিনেমারই কেন্দ্রীয় একটি নারী চরিত্রের জন্য লোক দরকার। প্রযোজক নাগাতা আগে থেকেই পরিচিত কুরোসাওয়ার। অনুরোধ করলেন এই ছবির সামুরাইয়ের স্ত্রী হিসেবে মাচিকো কিওকে নেওয়ার জন্য। নাগাতাও বিখ্যাত সব সিনেমার প্রযোজক। তাঁর কথা রাখলেন কুরোসাওয়া। আর সামুরাই এর স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিলেন মাচিকো। সিনেমাটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে জেতে গোল্ডেন লায়ন। অভিনয়ে প্রশংসা পান মাচিকো। জাপানি সিনেমা বিশ্ব চলচ্চিত্র দরবারে পরিচিত হয় অন্যভাবে। আর মাচিকোর অভিনয়ের দরজা যেন খুলে গেল দুম করে। একের পর এক চলচ্চিত্রে নিজেকে মেলে ধরলেন অন্যভাবে। কুরোসাওয়ার পরে বিখ্যাত সব পরিচালকের ডাক পেলেন তিনি।

অভিনয়ে এক প্রকার নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। সে কথা বলেছেন তাঁর পরিচালকেরাই। সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফিতে পরিচালক কুরোসাওয়া লিখেছেন, ‘শুটিংয়ের আগে মহড়ায় আমি মাচিকোর ডেডিকেশন দেখে বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই। সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠিনি, তখনই তিনি এসে হাজির। পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে আমার কাছে বসে থাকতেন। বলতেন, “দয়া করে আমাকে কিছু শেখান।” আমি তাঁর কথায় অবাক হতাম।‘

১৯৫৩ সালে কিনুগাসার গেট অব হেল সিনেমাতেও দেখা যায় মাচিকোকে। এই সিনেমার প্রযোজক ছিলেন মাসাইকি নাগাতা। কান চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রাঁ প্রি পুরস্কার ঘরে তোলে সিনেমাটি। সম্মানসূচক অস্কার পুরস্কারও জিতে নেয় সিনেমাটি। এত বড় বড় পরিচালক আর বিখ্যাত ছবিতে চমৎকার অভিনয়ের জন্য মাচিকোর নাম দেওয়া হয় জাপানের ‘গ্রাঁ প্রি অ্যাকট্রেস‘ হিসেবে।

জাপানের আরেক মাস্টার চলচ্চিত্রকার কেনজি মিজোগুচি। তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র উগেস্তু। সেখানেও দেখা মিলবে মাচিকোর। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি সিলভার লায়ন জিতেছিল। সিনেমাটি জাপানী সিনেমার সোনালী যুগের উজ্জ্বল নিদর্শন।

হলিউডেও নাম লিখিয়েছিলেন এই অভিনেত্রী। দ্য টিহাউস অব দ্য অগাস্ট মুন সিনেমাতে মাচিকোকে দেখা গেল। বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন হলিউডের মারকুটে অভিনেতা মারলন ব্রান্ডো। এ ছাড়া জাপানি টেলিভিশনের কিছু নাটকেও অভিনয় করেন মাচিকো। ২০০০ সালে এন এইচ কে টেলিভিশনের একটি ড্রামা সিরিজে ছিল তাঁর শেষ অভিনয়।

মাচিকো কখনো বিয়ে করেননি। তবে মাসাইকি নাগাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। ২০১৯ সালের ১২ মে মারা যান এই তারকা অভিনেত্রী। মৃত্যুর দুই বছর আগে ২০১৭ সালে মাচিকোকে জাপান একাডেমি প্রাইজ অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়।

মাচিকো কিওর উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো-
রশোমন, উগেস্তু, ওল্ডার ব্রাদার ইয়ঙ্গার সিস্টার, গেট অব হেল, দ্য প্রিন্সেস সেন, প্রিন্সেস ইয়াং কুই ফেই, তুজুরো নো কোই, স্ট্রিট অব শেম, দ্য টি হাউজ অব দ্য অগাস্ট মুন, দ্য হোল, ইউরাকুচো দ্য আইমাশো, দ্য লয়াল ৪৭ রোনিন, সরো ইজ অনলি ফর উইমেন, ফ্রোটিং উইডস, অড অবসেশন, দ্য ফেস অব অ্যানাদার, কেনজি মিজোগুচি: দ্য লাইফ অব ফিল্ম ডিরেক্টর, তোরা‘স পুওর লাভ।