‘প্রাইভেট টিউটর ছিলাম। এক বিত্তশালীর মেয়েকে পড়াতাম। একদিন তার বাবা আমাকে পিটিয়ে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে গেল।’
‘কেন?’
‘মেয়ের বইতে একটা চিঠি ছিল।’
‘কী লেখা ছিল চিঠিতে?’
‘কবিতা।’
‘কী কবিতা?’
‘রোমান্টিক কবিতা। কবিতা বেশ বড়। পরে বলছি।’
‘আপনি লিখেছেন?’
‘না।’
‘এরপর কী হলো?’
‘দোষ হল আমার। চিঠি পড়ল মেয়ের বাবার হাতে। সেখান থেকে তার বড়ভাই জানল। বড়চাচাও জেনে গেল। সবাই মিলে মেয়ের সামনেই আমাকে পেটাল।’

মোহাম্মদপুর মিলেনিয়াম হাসপাতালের আইসিইউ এর ছয় নম্বর শ্বেতশুভ্র বিছানায় শুয়ে অস্পষ্ট স্বরে আমাকে ব্যর্থ প্রেমের গল্প শোনাচ্ছে তার নাম রফিক। বয়স ত্রিশের মত।
রোমান্টিক কবিতা লিখে মেয়ের বাবার হাতে মার খাবার ঘটনাটি অত্যন্ত বীভৎস। রফিকের শরীর জুড়ে গভীর ক্ষতচিহ্ন। ঠোঁট কেটে ফুলে আছে। বামচোখের পাতা ফুলে চোখটা বন্ধ করে রেখেছে।
রফিকের মার খাবার ইতিহাস আমাকে মুগ্ধ করতে পারছে না। তবুও বাধ্য হয়ে গল্প শুনতে হচ্ছে। আমার বন্ধু ডাক্তার মিলটন মিলেনিয়ামের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান। রহস্যের প্রতি আমার অসীম আগ্রহ দেখে আমাকে মোটামুটি পাজকোলা করে তুলে এনেছে।
রফিকের সাথে আলাপের পাঁচমিনিটের মাথায় বোঝা গেল, মার খেয়ে আইসিইউতে আসার ব্যাপারটায় কোন রহস্য নেই। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘আজ আসি। আপনার চিকিৎসা চলছে।’
‘গল্প শুনবেন না?’
‘না। আপনার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘হোক। আপনি বসুন প্লিজ।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘সিগারেট খেতে হবে। আইসিইউতে সিগারেট খাবার নিয়ম নেই। আমি পরে আসছি।’
রফিককে বিছানায় রেখে আমি আইসিইউ থেকে বের হলাম। সিগারেটের ব্যাপারটা নিতান্তই অজুহাত। রহস্যহীন স্থানে কালক্ষেপণ করবার যৌক্তিকতা নেই।

আইসিইউ এর কাঁচের দেয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে রফিকের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার আগ্রহ বিরক্তিতে রূপ নিয়েছে। মানুষ হবার নানান যন্ত্রণা আছে। অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হলে সেটা পুষে রাখা যায় না। আরেকজনের উপর ঢেলে দিতে হয়। আমি অপেক্ষা করছি বন্ধুবর মিলটনের জন্য। বিরক্তির একটা অংশ তার উপর উগড়ে দিয়ে প্রস্থান করব।
হাসপাতালের ক্লিনার আমার পাশে নিঃশব্দে চলে এসেছে। তার গলায় আইডি কার্ড। কার্ডে স্পষ্ট বাংলায় লেখা- হাশমত।
হাশমত গলা মোটা করে বলল,
‘হাসপাতালের ভেতর সিগারেট খান ক্যান?’
‘সিগারেট খাচ্ছিনাতো।’
‘মুখে কী?’
‘মুখে সিগারেট। কিন্তু সিগারেটে আগুন নেই।’
‘একই কথা। সিগারেট ফেলে দেন। নইলে চলে যান।’
‘আচ্ছা।’
‘যান না ক্যান?’
‘হাশমত সাহেব, ছয় নম্বর বেডের ছেলেটাকে চেনেন?’
‘না।’
‘ছেলেটা কাঁদছে। দেখুন। ছেলেটার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। এল.ই.ডির আলোয় সেই পানি চকচক করছে।’
আবেগীয় কথাবার্তা হাশমতকে বিভ্রান্ত করতে পারল না। সে একবারো কাঁচের দেয়ালের ওপাশে তাকায়নি। তার দৃষ্টির পুরোটা আমার আগুনহীন সিগারেটে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে।
‘যান না ক্যান?’
‘যাব না।’
‘তাইলে সিগারেট ফেলেন।’
আমি সিগারেট ফেললাম। জ্বলন্ত সিগারেটের মত পা দিয়ে ডলে নেভানোর অভিনয় করলাম। হাশমত এখনো বিরক্তিমুখে তাকিয়ে আছে। বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে আইসিইউতে ঢুকে পড়লাম।

‘আপনার গল্প বলুন।’
‘আপনি বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। আবার আসলেন কেন?’
‘গল্প শুনতে।’
‘আমার ধারণা আপনি আর আসবেন না। গলায় ব্যাথা পাচ্ছি কথা বলতে।’
‘চেষ্টা করুন অল্পকথায় বলা যায় কী না। সেদিনের ঘটনাটা বলুন।’
রফিক অতিকষ্টে অস্পষ্ট স্বরে ঘটনার বিবরণ শুরু করল।
‘তার নাম শিলা।
খনিজ শিলার মত শক্তটক্ত না। নরম স্বভাবের মেয়ে। অল্পতেi আনন্দিত হয়। অল্পতেই মন খারাপ করে। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। আমি একাউন্টিং এর ম্যাথ শিখাই।
গর্ধব শ্রেণির ছাত্রী। আপনি ডাক্তার মানুষ। যদি শিলার আইকিউ মেপে দেখতেন নির্ঘাত একটা মৃগেল মাঝের আইকিউ এর চেয়ে বেশি মার্ক দিতে পারতেন না।
পড়ানোর সময় সে কখনো মুখ তোলে না। আমি প্রশ্ন করলে জবাব টবাব দেয় না। দুই তিনবার প্রশ্ন করলে হ্যা-হু বলে।
একটা সময় আমি নিজেই বিব্রত হয়ে যাই। মাঝেমাঝে তার চোখমুখ দেখে আমি অবাক হই। লজ্জায় লাল হয়ে দেশি টমেটোর মত হয়ে থাকে। আমার মনে হয়, আমি যৌনউত্তেজক গল্পটল্প করছি। এত লজ্জার কী আছে?
আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এই মেয়েটাকে আমি আর পড়াব না। আর্থিক ব্যাপারে আমি হতদরিদ্র লেভেলের। টিউশনীর পুরো টাকাটা আমার অন্ধ মায়ের জন্য গ্রামে পাঠাতে হয়। তবুও টিউশনী ছেড়ে দেবার পরিকল্পণা করলাম।
একদিন শিলা মুখ তুলে বলল,
‘আপনি নাকি কবিতা লেখেন?’
আমি অল্পস্বল্প লেখালেখি করি। বেশিরভাগ অখাদ্যশ্রেণির কবিতা। সকল বাঙ্গালি পুরুষ জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময় রোমান্টিক কবিতা লেখে। সবার মতোই আমারো ভেতরে প্রেম আছে। তীব্র অভাবের করুণ গল্প আছে। নিজের অপূর্ণ ভাবগুলোকে কলমের কালিতে শব্দ বানাতে আমারো ভালো লাগে। আমি শিলার কথার জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
‘কথা বলছেন না কেন? আপনি কবিতা লেখেন?’
‘হ্যা।’
‘কয়টা লিখেছেন?’
‘হিশেব করিনি।’
‘রোমান্টিক কবিতা?’
‘হু।’
‘আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখবেন?’
‘কেন?’
শিলা জবাব দিল না। তার চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। প্রথমবার আমি তার জন্য খানিকটা মায়া বোধ করলাম।

এরপর আর কোনোদিন শিলার সাথে কবিতা নিয়ে কথা হয়নি। সে একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি এই মাস শেষে আর আসবেন না?’
‘কেন?’
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি আর আসবেন না।’
‘পড়ায় মনোযোগ দাও।’
শিলা পড়ায় মনোযোগ দিল। সে আর আগের মত ‘হ্যা’ ‘হু’ করে না। চুপচাপ বসে থাকে। মাঝেমাঝে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি চোখ নামিয়ে ফেলি। শিলা চোখ নামায় না। ব্যাপারটা জটিলতর হয়ে গেল।’
গল্পের এই পর্যায়ে আমি রফিককে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘জটিলতর মানে?’
‘জটিলতর মানে আমিও চুপচাপ বসে থাকি। সময় শেষ হলে হলে ফিরে আসি।’
‘আচ্ছা! গল্প শেষ করুন।’
রফিকের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কাশি আসছে। ইন্টার্নাল ব্লিডিং হয়েছে। ত্বকের বিভিন্ন অংশ আঘাতের চিহ্ন। কালশিরা (Bruise) পড়ে আছে। বাইরের আঘাত দেখেই ধারণা করা যায় ভেতরের অবস্থা অতীব ভয়াবহ।
‘শেষের দিন সিদ্ধান্ত নিলাম আর পড়াতে যাব না।’
‘কেন শেষেরদিন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন?’
‘এমনিতেই। যেতে ইচ্ছে করছিল না। শরীর খারাপ।’
‘শেষ পর্যন্ত যাননি?’
‘গিয়েছি। দীর্ঘদিন পড়িয়েছি। খারাপও লাগছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল আমার পরণের শার্ট সেদিন ঘেমে গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছিল।’
শিলা দেরী করে পড়তে আসল।
প্রথমবার মনে হল সে অনিচ্ছাবশত পড়তে বসেছে। আমি বললাম,
‘দেরি করলে কেন?’
‘এমনি।’
‘বসো।’
শিলা বসতে চাচ্ছিল না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, সে ভয় পাচ্ছে। প্রবল ভয়। কেন ভয় পাচ্ছে জানা নেই। সে বসে বলল,
‘একটা কবিতা লিখেছি।’
‘ভেরি গুড স্যার।’
‘দেখবেন?’
‘না।’
‘কবিতা লিখেছি আমাকে নিয়ে।’
‘নিজেকে নিয়ে কবিতা লেখা ভালো।’
‘পড়ুন না একবার।’
আমি হাত বাড়িয়ে একটা সাদা কাগজ নিলাম। সেখানে গোটাগোটা শব্দে দূর্বল শ্রেণিরকবিতা লেখা।

…তোমার নখের ডগায় বিষের চাষ বন্ধ করো
নখগুলো বরং হোক চামুচের মত
সযতনে আমাকে ভালোবাসা তুলে দিবে।

কবিতার নিচে কবির নাম দেখে আমি বিস্মিত হলাম। সেখানে লেখা- রফিক।
‘কেন?’
‘জিজ্ঞাসা করলাম। শিলা একরাশ লজ্জা নিয়ে জবাব দিল- আপনি আমাকে কবিতা লেখেন না। তাই আমিই আমার জন্য কবিতা লিখেছি। ভেবে নিয়েছি এটা লিখেছেন আপনি।’
‘কেন ভেবে নিয়েছ?’
শিলা জবাব দিল না। আমাকে চমকে দিয়ে বলল,
‘আপনি প্লিজ নিয়মিত আসবেন।’
‘কেন আসব?’
‘জানি না।’
ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল?
‘কী ঘটনা?’
‘শিলার বাবা এসে ঘরে ঢুকল। আমার মাকে নিয়ে একটা গালি দিয়ে আমাকে কষে লাথি দিল। আমি চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লাম।
শিলার বাবা পেছনে তার ভাই এবং চাচা চলে আসল। এরপর কী হল আমার স্পষ্ট মনে নেই। শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম, ঘরের কোনায় শিলা ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড ভয়ে কাঁপছে।’
‘আপনার গল্প শেষ?’
‘না।’
‘বাকীটা বলুন। চেষ্টা করবেন দ্রুত শেষ করতে।’

রফিক বলল,
‘আমাকে মেরে সম্ভবত রাস্তায় ফেলে গেল। সেখান থেকে আইসিইউতে কে ভর্তি করল আমি জানি না। দীর্ঘ সাতদিন পর আমার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল।’
‘কী ব্যাপার?’
‘জ্ঞানহীন থাকার সময় আমি বুঝতে পারতাম কেউ একজন আমার হাত ধরে বসে আছে। কে বসে আছে জানা নেই। গাঢ় অন্ধকারে আমি হাচড়েপাচড়ে বেড়াই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি। কেউ আমাকে জাগিয়ে দাও। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার হাত ধরে থাকা মানুষটাকে আমি দেখতে চাই।
কিন্তু কেউ জাগিয়ে দেয় না। অন্ধকারে কেউ একজন আমাকে ফিসফিস করে বলে- আমি পাশে আছি স্যার।’
‘কে?’
‘স্যার, আমি শিলা।’
‘শিলা তুমি আমার কপালে হাত রাখো। আমি কপালে শিলার হাতের অস্তিত্ব অনুভব করি। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?’
‘না। খুব স্বাভাবিক। মানুষ অসহায় হলে, অজ্ঞান থাকলে অবচেতন মনে একটা খুঁটি খোঁজে। যেটা ধরে নিজেকে স্থির রাখা যায়। খুঁটির জন্য আপনি শিলাকে তৈরি করে নিয়েছেন।’
‘অন্য কেউ তো হতে পারত?’
‘পারত। কিন্তু ঢাকায় আপনি একা। দারিদ্র্যতা এবং সঙ্গীহীনতা ব্যাপারটা আমার মস্তিষ্কে খোঁদাই হয়ে গেছে। আপনি একজন মানুষের সহায়তা চেয়েছেন। তাই হয়তো কাছাকাছি কাউকে তৈরি করে নিয়েছেন।’
‘আমার মা নিজেও তো হতে পারত।’
‘পারত। কিন্তু হিউম্যান ব্রেন অধিকাংশ সময় রক্তের সম্পর্কহীন বাইরের মানুষের প্রতি তীব্র আকর্ষণ দেখায়। মা মারা গেলে, বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিলেও মেনে নেই। কিন্তু প্রেমিকার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারি না। বাবা-মার মৃত্যু শোক কাটালেও প্রেমিকার শোক সহজে কাঁটাতে পারি না। এরপর কী হল?’
এরপরের ঘটনা অদ্ভুত। নিকষ অন্ধকারে শিলা আমাকে বলল-
‘আমার হাত ধরুন তো।’
‘কেন?’
‘আপনাকে জাগাব ধাক্কা দিয়ে।’
আমি শিলার ধরলাম। সে আমাকে ধাক্কা দিল। সাথেসাথে জ্ঞান ফিরে আসল।’
‘তারপর?’
‘চোখখুলে আমি শিলাকে প্রথমবার এত কাছাকাছি দেখলাম। সে আমার হাত ধরে বেডের পাশে বসে আছে। ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক ছিল যে আমি চোখ খুলে শিলাকে বললাম- পানি দাও। বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। শিলা পানি দিল। তার আচরণ অত্যন্ত স্বাভাবিক। এবার বলুন, এটার ব্যাখ্যা কী?’
‘ব্যাখ্যা খুব সহজ। অবচেতন মন আবছাভাবে বাইরের শব্দ শুনতে পায়। আপনি অজ্ঞান থাকা অবস্থায় শিলার গলার স্বর শুনতে পেতেন।’
‘কিন্তু শিলা কীভাবে আমার সাথে মনের কথা বুঝে ফেলে জবাব দিত?’
‘মনের কথা বুঝে জবাব দিত না। আপনার মনের কথাগুলো যেমন আপনার নিজে তৈরি করা। জবাবগুলোও নিজে তৈরি করা।’
রফিক আমার ব্যাখ্যা ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। কিছুটা জোর করে তার নিজের মতো করে জবাব শুনতে চাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তোমার রহস্য কী এখানেই শেষ?’
‘না।’
‘এরপর কী ঘটল?’
‘শিলা প্রতিদিন আসে। সারাদিন আমার হাত ধরে বসে থাকে। এরপর বিকেলে চলে যায়। এ সময়টা আমরা গল্পগুজব করে কাটাই। শিলার আচরণ দেখে মনে হত না, আমি তার টিউটর ছিলাম। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মত। আপনি বিশ্বাস করবেন না, গত সপ্তাহে সে কী করেছে।
‘কী করেছে?’
‘তার হাত কেঁটে আমার নাম লিখেছে। ব্লেড দিয়ে স্পষ্ট ইংরেজি বর্ণে লেখা- RAFIQ।
‘এরপর?’
‘আমি বললাম, কিউ ‘Q’ বর্ণটি তো ঠিক হয়নি। ‘ও’ এর মত লাগছে। আবার কাঁটতে হবে।’
‘এরপর কী হল?’
‘শিলা আমার উপর অভিমান করল। অভিমানের মাত্রা এত বেশি যে দুইদিন থেকে সে আসছে না।’
‘আপনার গল্প শেষ?’
‘জ্বি।’
‘আমাকে গল্প বলার কারণ কী?’
রফিক অতি কষ্টে বলল,
‘আমার ধারণা আমি মারা যাব।’
‘এমন ধারণা কেন হল?’
‘জানি না। শিলা দুইদিন আগে আমাকে বলল- আমি আপনার নামে আমাকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছি। আমি দেখতে চাইলাম। দেখাল না। শুধু বলল-যেদিন একবারে চলে আসবেন, সেদিন দেখাব।’
‘একবারে চলা আসা বলতে মৃত্যুর কথা বলেছে?’
‘আমার তাই ধারণা।’
‘আপনার ধারণায় গন্ডগোল আছে। আপনি অসুস্থ। অসুস্থতা মানুষের মস্তিষ্কের উপর চাপ দেয়। তাকে ভুলভালভাবে ভাবায়। আপনি সুস্থ হবেন।’
‘একটা কাজ করতে পারবেন?’
‘কী?’
‘আমার ধারণা আপনার ব্যাখ্যা সঠিক। শিলা বলে কেউ আমার কাছে আসত না। আপনি কি তার সাথে একবার দেখা করে আমার কথা বলতে পারবেন?’
‘কী কথা?’
‘আমি তার লেখা বাকী কবিতাগুলো পড়তে চাই।’
আমি বললাম,
‘আপনি অন্য কাউকে বলে খবর পাঠান। চাইলে আমি লোকের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’
রফিক বলল,
‘লাগবে না। ধন্যবাদ।’
রফিক চোখ বন্ধ করে আছে। কথা বলছে না। শ্বাস বড়বড় নিচ্ছে। ঘুমিয়ে গেল শ্বাস গভীর ও দীর্ঘ হয়ে যায়।

আইসিইউ থেকে বের হয়ে রিসিপশনে গেলাম। রিসিপশনিস্ট মেয়েটা আমাকে দেখে চমৎকার হাসি দিয়ে বলল,
‘May I help you, Sir?’
‘আপনাদের ভিজিটর লিস্টে আমার নাম লেখা হয়নি।’
রিসিপশনিস্ট ভিজিটর লিস্ট বের করল। আমি নাম লেখার আগে দ্রুত কয়েকটা পাতা উল্টালাম। ছয় নম্বর বেডের ভিজিটর হিশেবে নাম লেখা- SHILA.
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল- একটানা আসার পর শেষ দুইদিন আসেনি।


ধানমন্ডির সাতাশ নম্বর রোডের গলির মাথায় গোলাপী রঙ্গের দোতলা বাড়িতে লোকারণ্য। নানান ধরণের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। জটলা হয়ে বসে গল্পগুজব করছে। বাড়ির ভেতর থেকে আগরবাতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
একটা ছোট ধরণের জটলার মাঝখানে একজন মধ্যবয়স্ক লোক চেয়ারে বসে আছেন। চুপচাপ। পাশের মানুষজন ফিসফিস করে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। প্রথম দর্শনে ধারণা করা যায়, বাড়িতে কেউ মারা গেছে। চেয়ারের ভদ্রলোক তার পিতা।
আমি জটলা ঠেলে এগিয়ে এসে বললাম,
‘আমি প্রফেসর নাজিব। সাইকিয়াট্রিস্ট। আপনার সাথে পাঁচমিনিট কথা বলব।’
‘কী ব্যাপারে?’
‘এখানে বলা যাবে না।’
ভদ্রলোক খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দোতলায় একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি চললাম পিছুপিছু।
‘আপনি শিলার বাবা?’
‘জ্বি।’
‘এই ঘরটা শিলার ঘর?’
‘হ্যা।’
শিলার ঘরের সরঞ্জাম আর দশটা মেয়ের ঘরের মতোই। রঙ্গিন। পড়ার টেবিল, আলনা সবকিছু গোছগাছ করা। টেবিলে বইখাতা। কোন আউটবই কিংবা সখের জিনিস নেই।
আউটবই বা শখের জিনিসের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করে- শিলা বাধ্য হয়ে কিংবা বাবা মাকে ভয় পেত। তাকে সবটা সময় বইখাতা খুলে পড়তে হয়েছে। ডায়েরি কিংবা ছোটখাটো ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের মধ্যে কিছু নেই। ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মানুষরা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখে। অতি পরিচিত সখের জিনিসপত্র না থাকায় ধারণা করা যায় শিলা তার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো কারো সাথে আলোচনা করত না। তার বন্ধু নেই।
আমি শিলার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘রফিক আপনার মেয়েকে পড়াত?’
ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। সেখানে স্পষ্ট বিরক্তি ও রাগ। একই সাথে দুটো অনুভূতি চেহারায় ফুটিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। কেউ রাগী স্বভাবের হলে একটা সময় তার চোখেমুখে রাগের চিহ্ন স্পষ্টভাবে বসে যায়। ইনিও সেই গোত্রের।
‘শিলার সাথে কথা বলা যাবে?’
‘না।’
‘কেন?’
‘দুইদিন আগে সুইসাইড করেছে।’
কারো কন্যা সুইসাইড করলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কথা বলতে হয়। মানুষের মস্তিষ্ক তখনই কোন সুরে আলোড়িত হয় যখন মস্তিষ্কের পছন্দের নির্ধারিত কম্পাংকে সাথে তাল মিলিয়ে সুর বাজতে থাকে। আমি তাল মেলানো সুর কিংবা ভদ্রলোকের সমান ব্যাথায় ব্যথিত হবার ভান না করে বললাম,
‘রফিককে মারধোর করার পর আপনিই হাসপাতালে ভর্তি করেছেন, তাই তো?’
‘কেন এমন মনে হল?’
‘রফিক দরিদ্র মানুষ। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হবার সামর্থ তার নেই। সরকারি হাসপাতালে গেলে পুলিশ কেসের ব্যাপার থাকে। আপনি ঝামেলায় যেতে চাননি। রফিকের আঘাত গুরুতর। যেকোন মুহুর্তে মারাও যেতে পারে। তাই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আপনি রাগী হলেও ভালো মানুষ। কেউ আপনার আঘাতে মারা যাক চাননি। তাই ভর্তি করেছেন। বিস্তর টাকা পয়সাও আপনিই দিচ্ছেন।’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না।
‘আপনার কী আরেকজন মেয়ে আছে?’
‘না।’
‘আমার ধারণা রফিকের খোঁজখবর নিতে কেউ একজন প্রায়ই যেত। রফিক তাকে শিলা ভেবে কথা বলত। অসুস্থ মানুষরা অনেক কিছুই আকড়ে ধরে ভালো থাকতে চায়।’
শিলার বাবা কথার জবাব দিলেন না। প্রচন্ড রাগী মানুষরা অল্প শব্দ ব্যবহার করে বাক্য তৈরি করেন।
‘একটা সেন্সিটিভ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব?’
‘করুন।’
‘শিলার হাতে কী ব্লেড দিয়ে কোন নাম লেখা ছিল?’
শিলার বাবা জবাব দিলেন না। চুপচাপ উঠে নিচে নেমে গেলেন।


‘রফিক সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘শিলার লেখা কবিতাটা আরেকবার বলুন তো।’
রফিক আবৃতি করার মত করে বলল,
‘তোমার নখের ডগায় বিষের চাষ বন্ধ করো
নখগুলো বরং হোক চামুচের মত
সযতনে আমাকে ভালোবাসা তুলে দিবে।
‘কবিতাটি কী আপনার লেখা?’
‘না।’
‘এই কবিতা যদি শিলা লিখে থাকে, তাহলে আপনার মুখস্ত থাকার কথা নয়।’
‘আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।’
‘ভালো হলেও একবার কবিতা পাঠের পর কেউ কারো হাতে এমন বীভৎস মার খাবার পর স্মরণ রাখতে পারবে না। এরমাঝে আপনি এক সপ্তাহ জ্ঞানহীন ছিলেন। অন্তত কোন শব্দে বা বাক্যে এদিক-ওদিক হবার কথা। আপনি আমাকে দুইবার একই কবিতা বলেছেন। একটা শব্দও কমবেশি হয়নি। আমি ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। আমার স্মৃতিশক্তিও ভালো।’
রফিক চোখ সরু করে তাকানোর চেষ্টা করল।
‘আপনি স্মরণ রেখেছেন কারণ কবিতাটা আপনার নিজের লেখা। যেদিন শিলাকে দিয়েছেন তার অনেক আগেই লেখা। দীর্ঘদিন নিজের কাছে রাখায় কবিতাটা আপনার মুখস্ত হয়ে গেছে। তাই এত ঝড়ের পরেও স্মরণ আছে। ঠিক বলেছি?’
‘জ্বি।’
‘শিলার হাতের নখ কী অনেক বড় ছিল?’
‘জ্বি।’
‘আপনি কী কখনো তার হাত ধরার চেষ্টা করেছিলেন?’
‘কেন?’
‘আপনার শরীরে ব্লান্ট ট্রমা। কিন্তু ডানহাতের কব্জির কাছে শার্প কাটিং ইনজুরি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে (Discrete)। কেউ লাথিঘুষি মারলে এমনভাবে কাঁটে না। হতে পারে কেউ আপনার হাতে খামচি মেরেছে। তার নখের কারণে আপনার কব্জির কাছে অনেকগুলো দাগ হয়েছে।’
‘হতে পারে।’
‘আপনি কী পড়ানোর সময় প্রেমের কথাবার্তার চেষ্টা করতেন?’
‘না।’
‘শিলা কেন আপনার প্রশ্নের উত্তর দিত না?’
‘পড়ালেখায় দুর্বল ছিল।’
‘দূর্বল ছিল না। আমি শিলার শোবারঘরে গিয়েছিলাম। দেয়ালে তার ছবি। স্কুল কলেজে ভালো পারফরমেন্সের সার্টিফিকেট লেমিনেশন করে ঝুলিয়ে রাখা। হতে পারে আপনার কথা সে নিতে পারত না। তাই চুলচাপ থাকত। মাঝেমাঝে আপনার কথা এত বেশি সীমা অতিক্রম করত, সে লজ্জা পেত। লজ্জা পেলেও তার বাবাকে কেন জানায়নি জানেন?’
‘না।’
‘শিলা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। তার বাবাও প্রচন্ড রাগি মানুষ। রাগী মানুষদের বাচ্চাকাচ্চারা বাবাদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলে। আপনার লাগাতার অসহনীয় কথাবার্তা সে নীরবে সহ্য করত। চাইলেও বাবাকে বলতে পারত না।’
‘না বললে তার বাবা কীভাবে জানল?’
‘এটা ভালো প্রশ্ন। আপনি বলেছেন- শেষদিন আপনার পড়াতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। এর কারণ হতে পারে আগেরদিন আপনি তার হাতে বা গায়ে হাত দিয়েছেন। সে আকস্মিক ব্যাপারটায় হতভম্ভ হয়ে যায়। হিউম্যান নিজেকে রক্ষা করতে নানান ধরণের রিফ্লেক্স দেখায়। এতাও তেমন। রিফ্লেক্সের কারণে নখ দিয়ে আঁচড়ে দেয়। আপনি যেতে চাননি কারণ আপনার মনে হয়েছিল শিলার বাবা ব্যাপারটা জেনে যাবে। ভয় পেলে মানুষের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। ঘেমে যায়। আপনার এজন্যই ঘাম হচ্ছিল। ঘামে শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে যাচ্ছিল। এরপরেও কেন গেলেন? সম্ভবত বেতন পাননি। বেতনটা আপনার খুব জরুরি দরকার। আপনি বলেছেন এই বেতনের উপর আপনার অন্ধ মার সংসার চলে যায়। একটা ব্যাপার জানতে চান?’
‘কী?’
‘মেয়েটা আপনাকে মারধোর করবার পুরো ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে দেখবার পর প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে, লজ্জা পেয়েছে। ইন্ট্রোভার্ট মানুষরা যখন লজ্জা আর অপমানের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় তখন ভুলভাল সিদ্ধান্ত নেয়। শিলা আত্মহত্যা করেছে।’
শিলার আত্মহত্যার ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিকভাবে বলা হল যে রফিক চোখ বন্ধ করল। নিশ্চুপ হয়ে গেল।
‘রফিক?’
‘বলুন।’
‘শিলা মৃত্যুর আগে তার হাত কেঁটে আপনার নাম লিখেছিল। আপনার হ্যালুসিনেশনের এই অংশটা মিলে গেছে।’
রফিক জবাব দিল না। আমি উঠে পড়লাম। রফিকের ঝড়-জীবনে মৃদ্যু রহস্যের সমাধান হয়েছে।
রফিক বিড়বিড় করে বলল,
‘আমার রহস্যের আসল অংশটা আপনাকে বলা হয়নি।’
‘কোন অংশ?’
‘শিলা দু’দিন আগে আসার সময় ভ্যানিটিব্যাগে একটা ব্লেড নিয়ে আসে। শুকনো রক্তমাখা। আমাকে বলল- এই ব্লেডে আমি আপনার নাম লিখেছি। নিন, আপনিও লিখুন।’
‘আপনি লিখেছেন?’
‘না। আমার হাত ভাঙ্গা। আমি লিখতে পারব না। শিলা নিজেই আমার শরীরের তার নাম লিখেছে। সমস্যা হল নামটা আমার হাতে লেখেনি। আমার পীঠে লিখেছে। লেখার পর বলল, আমি আপনার খুব কাছাকাছি রইলাম। কিন্তু আমাকে দেখতে পাবেন না। আপনি কী পীঠে শিলার নামটা দেখবেন?’
‘না।’
‘কেন?’
‘একটি কাল্পনিক চরিত্র কারো শরীর কেটে নাম লিখেছে এটা আমি বিশ্বাস করি না।’
‘আমাকে একটু বাঁকা হতে সাহায্য করুন। দেখলেই বিশ্বাস হবে।’
‘না। আমি আজন্ম লজিকে ভর করে চলা মানুষ। আপনাকে সামান্য সরালেই দেখা যাবে সেখানে কিছু নেই।’
‘আপনি নিশ্চিত?’
‘হ্যা। আপনার শরীরের অনেকক্ষত চিহ্ন। পীঠের ক্ষতটা হয়তো বেশি জ্বালাপোড়া করছে। হ্যালুসিনেশনে আপনি ভাবছেন, সেখানে ব্লেড দিয়ে একজন মৃত ও কাল্পনিক তরুণী তার নাম লিখে চলে গেছে।’
‘লজিকে নিশ্চয়তা বলে কিছু আছে?’
‘নেই। কিন্তু লজিকের প্যাটার্ন আছে। এরা প্যাটার্নের বাইরে কিছু করে না। আর কিছু বলতে চান?’
‘না।’
রফিক চোখ বন্ধ করল। তার চোখেমুখে অপাঠ্য অনুভূতি। আমি অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় নামলাম।

পরিশিষ্টঃ
রফিকের সাথে দেখা হবার পরদিন গভীররাতে মিলেনিয়ামের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ও আমার বন্ধু ডাক্তার মিলটন ফোন করল।
‘ঘুমাচ্ছিস?’
‘না।’
‘একটু আসবি?’
‘কেন?’
রফিক নামের ছেলেটা মারা গেছে। তার কেউ নেই। বাসার ঠিকানাও নেই। যে ভদ্রলোক ভর্তি করেছে তিনিও আসছেন না। কী করব?’
‘ওয়ারিশ না থাকলে তোরা কী করিস?’
‘আঞ্জুমানে মফিদুল কল করি।ওরা লাশ নিয়ে চলে যায়। কিন্তু…।’
মিল্টন চুপ করে আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আর কিছু বলবি?’
মিলটন বলল,
‘রফিক নামে ছেলেটার পীঠে ব্লেড দিয়ে কেটে একটা নাম লেখা। কে করল বোঝা যাচ্ছে না। সেখানে একটা নাম। নামটা হল……’

মিলটন কথা শেষ করতে পারল না। আমি তার আগেই ফোন রেখে দিলাম।
.
.

© ডা. রাজীব হোসাইন সরকার