সাহিত্য বার্তা

নূরুদ্দিনের বাড়ির টুকরো কথকতা

নকিব ফিরোজ

ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে আসা ঝিলের একপাশে নূরুদ্দিনে বেঢপ দোতলা বাড়িটার উপর নিচ মিলিয়ে আট রুম আর তার পাশে লম্বা ব্যরাকের মত টিনশেডে মুখোমুখি দুই সারিতে দশ বাই দশ গোটা দশেক রুম, একটি গণ রান্নাঘর ও একটি গণ বাথরুম। বিল্ডিংএর রুমগুলোতে এনজিওর স্কুলের মাস্টারনী, বিদ্যুৎ অফিসের পিয়ন, মুদি দোকান ও জর্দা কারখানার কর্মচারি পরিবারসহ থাকে এক দুই রুম ভাড়া নিয়ে। পাশের টিনশেডটিতে মাঝখানে চার ফিট এক চিলতে স্পেসের মুখোমুখি দশ বাই দশ ঘরগুলোতে বহুবিচিত্র শ্রমজীবী শ্রেণির এক দল বাসিন্দাদের মধ্যে বাসের ব্যাচেলর ড্রাইভার, স্বামী পরিত্যাক্তা গার্মেন্টস কর্মী, ঢাকাইয়া কুট্টির দ্বিতীয় স্ত্রী, রঙমিস্ত্রি, ফেরিঅলা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বয়স্ক দারোয়ান আছেন একজন। সবাই এক রুম নিয়ে থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দারোয়ান স্ত্রীসহ দুজন হলেও দুটি রুম, নিয়ে সে থাকে, যার একটি ঘণ্টা হিসেবে ভাড়ায় খাটায়ে ভাসমান পতিতাদের কাছে।

বাড়িঅলা নূরুদ্দিন সপরিবারে গেন্ডারিয়ায় থাকলেও এ বাড়ির নিচতলায় একটা রুম রেখেছে নিজে ব্যবহারের জন্য। সেখানে তিনি যখন তখন এসে বাংলা মদ পান করে নানা কায়দায় কব্জা করা মেয়ে মানুষ নিয়ে কিছুটা সময় কাটান।
নূরুদ্দিনের রুমের পাশের রুমে থাকে নূরুদ্দিনের বিশেষ অনুগত ও তার ফাইফরমাসখাটা মোটাসোটা গতরের এক চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া মাহির মা। একাই সে থাকে। মাঝে মধ্যে আধা ভদ্রলোক ধরনের মধ্যবয়স্ক একটি লোক এসে রাত কাটিয়ে সকালে আবার চলে যায়। এ ছাড়া নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দেওয়া অল্পবয়সী একটি মেয়েও মাঝে মাঝে আসে যে নাকি তার আগের ঘরের সন্তান। নূরুদ্দিনের ফাইফরমাস খেটে, তার জন্য মেয়ে মানুষ জোগাড় করে দিয়ে ভাল বকশিস যেমন পায় তেমনি আবার নূরুদ্দিনের অনুপস্থিতিতে ভাড়াটিয়াদের উপর হম্বিতম্বি খবদারিটাও চালায় দাপটের সাথে।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও ভাল পরিবেশের জন্য পুরোনো শহরে ভদ্র মানুষের আবাসিক এলাকা গেন্ডারিয়ায় ফ্লাট বাড়িতে নূরুদ্দিনের পরিবার থাকে। কেননা নতুন গড়ে ওঠা এসব এলাকা এখনো ভদ্রলোকের বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
স্বল্প শিক্ষিত নূরুদ্দিনের চলাফেরায় অভদ্র বেপরোয়া ভাব না থাকলেও কাঁচা টাকার দৌলতে নতুন ঘর-বাড়ি করে যে জীবন সে পেয়েছে তাকে মউজ করে উপভোগ করতে যতটুকু যা করতে হয় তাতে লজ্জা নেই তার।
বুড়িগঙ্গার ওপারে বড় হয়ে ওঠা নূরুদ্দিনের বাবার ইট-বালুর ছোটখাট ব্যবসার হাল ধরে কাঁচা টাকা আয় করে জীবনের চাওয়া-পাওয়া যেটুকু তার সবই পূরণ করেছে। তার ব্যবসার প্রসার, ছেলেমেয়ে, সুন্দরী স্ত্রী, দেখলে মনে হয় সে ভাগ্যবানই বটে এবং কোন কিছু নিয়ে তার আফসোসও হয়ত তেমন নেই কিন্তু কী একটা অভাব যেন তার সুগঠিত দেহটির সাথে মানানসই ফর্সা মুখটাকে বিষণœ করে রাখে।
স্বাধীন দেশের রাজধানী হয়ে ওঠায় ঢাকা শহর তার সংকীর্ণ খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসছে। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্ত নতুন কর্মযজ্ঞে চঞ্চল কিন্তু লক্ষ্যহীন নৈরাজ্যিক, গ্রামীণ উদ্বাস্তু ও বেকার মানুষের ভিড়ে কোলাহলময় নতুন এক শহর, যেখানে নেই কোন নিয়ম, সবাই শুধু ছুটছে, ছুটছে। এ শহরে যাদের শিকড় নেই তারা অধিকাংশই সস্তায় শ্রম বেচে দু’বেলা খেতে পেয়ে দু’টুকরো কাপড় পেয়ে, কোথাও একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় পেয়েই পরিতৃপ্ত; অন্যসব বঞ্চনার হিসেব করার সময় কোথায় তাদের?
নূরুদ্দিনের বাড়ির উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা বাইশ-তেইশ বছর বয়সী মাসু পুরানো ঢাকার খুচরা ব্যবসায়ী চল্লিশোর্ধ জসীম মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী যে তার বছর চারেকের একটি ছেলে আর কলা বিক্রেতা ফেরিঅলা বুড়ো বাবাকে নিয়ে থাকে। সাদা লুঙি ও সাদা সার্ট পরিহিতি চিকনচাকন কালোমত মাসুর স্বামী সপ্তাহে এক-আধবার রাত কাটাতে যখন এখানে আসে মাসুর বাবা তখন দোতলার উন্মুক্ত ছাদে বা অন্য কোথাও গিয়ে রাত কাটায়।
মাসুর পাশের রুমে পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়সী দুই বাস ড্রাইভার থাকে যারা শুধু ঘুমোনোর জন্য বাসায় আসে; যদিও তাদের চোখে ঘুম সহজে আসে না বলে দুজনেই যথেচ্ছ পরিমাণ ঘুমের বড়ি যেমন খায় তেমনি গাঁজার নেশাও করে। প্রায়সই দেখা যায় দুজনার চোখ ঢুলুঢুলু, ঘুমে কী নেশায় তা ঠিক বোঝা না গেলেও তাদের জীবন যে গভীর সংকটগ্রস্ত, সে খবর তাদের মুখের ম্লান হাসিতে ঢাকা পড়ে না।
ওদের পরে পাশাপাশি দু’রুম নিয়ে থাকা ইস্কান্দার মিয়া, পার্শ্ববর্তী পানি উন্নয়ন বোর্ড কলোনির দারোয়ান, পাকা চুল ও লম্বা পাকা দাড়িতে যাকে সত্তুরোর্ধ বলে মনে হয়, যদিও তত বয়স তার নয়। বাহ্যিক অবয়বে দেখতে শুনতে নিরীহ মনে হলেও সে যে অত নিরীহ নয় সেটা সহজে বোঝা যায় না। বাতরসে ভারি তার স্ত্রীও বয়সের তুলনায় বার্ধক্য আক্রান্ত এবং গৃহকর্মে অপারগ বলে মেয়ের ঘরের এক নাতিকে কাছে রাখে। যদিও তাদের মেয়ের সংখ্যা কত তা ঠিকভাবে কেউই বলতে পারবে না। কারণ প্রতিদিনই তাদের ঘরে নতুন নতুন মেয়ে জামাই আসে; সকাল-বিকাল যখন-তখন। তখন ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘরে কপাট পড়লে জানানো হয়, ঘরে মেয়ে জামাই আছে। তবে এ বাড়ির পুরোনো বাসিন্দারা কেউ কেউ জানে যে, দু’শো টাকার বিনিময়ে এক ঘণ্টার জন্য রুমটা ভাড়া দেয়া হয়েছে খদ্দেরসহ আসা দেহপসারিনীদের কাছে। এদের জোগাড় করে নিয়ে আসে হাসিখুশি মুখের পরহেজগার ছুরতের ইস্কান্দার মিয়া স্বয়ং।
বিপরীত দিকের ঘরগুলোর প্রান্তে দু’টো চুলোয় আট গৃহস্থের রান্নার কাজ সারতে হয়। তাই কে আগে কে পরে রান্না করে তা নিয়ে প্রায়শই এর সাথে ওর ঝগড়া লেগে গেলে রান্নাঘরের দেয়ালে জানালায় লেগে থাকা তেল চিটচিটে ময়লার মত সহজে তা ছাড়ে না। রান্নাঘরের পাশের রুমে স্বামী পরিত্যক্তা দুই মেয়ের মা পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়স্ক হালকা পাতলা গড়নের ফাতিমা নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে পাপড়িকে নিয়ে গার্মেন্টসের কাজে গেলে ছোট মেয়ে সোহেলি পার্শ্ববর্তী প্রাইমারি স্কুলে যায়। পড়ে ক্লাস ফাইভে। দুপুরে স্কুল ছুটি হলে একা একাই বাসায় থাকে রাতে মা ও বোন না ফেরা পর্যন্ত। তখন ড্রাইভার হাফিজ ওকে বিস্কিট চকোলেট খেতে দিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে গোপনে আদর করার চেষ্টা করে। ফাতেমার বড় মেয়েটা কাজে যেতে চায় না, চায় স্কুলে যেতে। কিন্তু ফাতেমার একার আয়ে তিন জনের খাওয়া পরা ঘর ভাড়া চলে না বলে মেয়েটাকেও কাজে ঢুকিয়েছে। তাদের এ জীবন-যুদ্ধ কঠিন হলেও নিছক খেয়েপরে বেঁচে থাকার আনন্দে প্রত্যয়দীপ্ত মুখে পুষ্টিহীনতার ছাপ ছাড়া কোন কষ্ট কিংবা অনুশোচনা ধরা পড়ে না। তার পাশের রুমে এক পা খাটো, খুড়িয়ে চলা রঙ মিস্ত্রি দেলোয়ার তার বউ ও দুটি বাচ্চা নিয়ে অনেক দিন ধরেই থাকে এখানে। সবার সাথে সে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তর্ক করতে পছন্দ করে বলে কেউ কেউ বিদ্রুপাত্মকভাবে তাকে নেতাজী বলে সম্বোধন করলেও তা হজম করে রাজনৈতিক আলাপ শুরু করে। বিশেষ করে কাজ থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর ঘরের গুমোট গরম সইতে না পেরে গায়ে গামছা জড়িয়ে বাইরের উন্মুক্ত উঠানে সেফটি ট্যাংকের উপরে জলচৌকি পেতে আয়েশ করে বসলে টুল-মড়া নিয়ে আরো দু’একজন এসে কাছে বসে। শ্রোতা পেয়ে তার বাগ্মীতা বেড়ে গেলেও তার কথাবার্তা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বাগাড়ম্বরপ্রিয় নেতাদের কথারই প্রতিধ্বনি। দ্রব্যমূল্য ও ধর্মীয় আলোচনায় তা সীমিত থাকলেও কারো কারো প্রশ্নের মুখে পড়ে কখনো কখনো বেশ একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
নূরুদ্দিনের এ বাড়িতে প্রতিদিন নাটকের মত ঘটনা ঘটেই চলে।

২.
আজ সকাল এগারোটার দিকে নূরুদ্দিন আসে। এসেই বাড়ির কথিত দারোয়ন, রোগেশোকে আকাল-বৃদ্ধ ছোটখাট রোগাপাতলা আফিয়ার বাপ, যাকে নূরুদ্দিন তার বাড়ির সীমানার ভিতর দেয়াল ঘেঁষে একখানা ছাপড়া তুলে থাকতে দিয়েছে ফাইফরমাস খাটার বিনিময়ে, তাকে টাকা দিয়ে মেথরপট্টিতে পাঠায় বাংলা মদ আনার জন্য। তারপর চোখকানা মাহির মাকে ডেকে নিচু কণ্ঠে কী যেন আলাপ করে বিছানায় উঠে বালিশ ঠেস দিয়ে রিল্যাক্স মুডে আরামে বসে।
তার খাটের পাশে নীলচে ফুল ছাপা অয়েলক্লথ বিছানো টেবিলের উপর প্লেট প্লাস খাবারের বক্স ও টুকিটাকি এটাসেটা রাখা। সেখান থেকে এশট্রেটা নিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে আয়েশি টান দিয়ে চোখ মুদে কী যেন ভাবে। পুরান ঢাকার খুচরা ব্যবসায়ীর দ্বিতীয় স্ত্রী মাসুর তিন মাসের ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে। বুড়ো বাপটার চিকিৎসা করতে গিয়ে খরচ হয়ে গেছে ঘর ভাড়ার টাকা। মাসুর ঘরভাড়া পরিশোধে বিলম্বের সুযোগে চোখকানা মাহির মা ইতিমধ্যেই নূরুদ্দিনকে একটু খুশি করার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। নূরুদ্দিনও সেটা জানে।
ছিপছিপে একহারা গড়নের বাইশতেইশ বছর বয়সী মাসুর উপর নূরুদ্দিনের নজর আছে আগে থেকেই। কিন্তু মেয়েটা তাকে দেখলে সব সময় এড়িয়ে যায়। চোখের দৃষ্টিতে তার প্রতি একটু যেন অবজ্ঞাও দেখেছে নূরুদ্দিন। তাতে ভিতরে ভিতরে নূরুদ্দিনের আঁতে ঘা লেগেছে কখনো কখনো। তার কী মেয়েমানুষের অভাব আছে? ডাকলে এখনি এসে পড়বে কয়েকটা। আর ঐ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বুড়ো দারোয়ান তো আছেই, বললেই হাজির করবে কয়েকটা এনে। কিন্তু নূরুদ্দিনের তেমন পছন্দ না ঐ বেশ্যাগুলোকে। একমাত্র নীলু নামের মেয়েটা যে যাত্রা-নাটকে অভিনয় করে, বলে পরিচয় দেয়, ঐ মেয়েটা একটু ভাল। তার শরীরটাও ভালো। আর তার সাথে ড্রিংকও করে। কিন্তু মেয়েটা যে কোথায় কোথায় থাকে তার হদিশ পাওয়া ভার। মাঝে মধ্যে টাকা পয়সার গুরুতর ঠেকায় পড়লে গদীতে এসে হাজির হয়। তখন দু’একদিন পাওয়া যায় তাকে। টাকা আর মদ খাওয়ার লোভে সে আসে। তারপর আবার কোথায় হারিয়ে যায় কে জানে। বাড়ি তার বিক্রমপুরের দিকে। নিজেকে পরিচয় দেয় অভিনেত্রী বলে। বড় ভাল, আরাম দেয়ার মত মেয়ে নীলু। এছাড়া আর যা পাওয়া যায় তা একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। সেদিক দিয়ে মাসু মেয়েটাকে ভালই লাগে। চেহারাটা মিষ্টি আর পরিচ্ছন্ন। তবে ওর এড়িয়ে চলা ভাবটা ভালো লাগে না নূরুদ্দিনের। আর যা হোক সম্মত না হলে নূরুদ্দিন কাউকে বাধ্য করে না। এইটুকু সে মেনে চলে।
মাসু তার ঘরে চৌকিতে বসে বছর তিনেক বয়সী ছেলেটাকে বাটিতে ভাত চটকে খাওয়াচ্ছিল। তখন চোখকানা মাহির মা তার মোটা শরীরটা নিয়ে দরজা জুড়ে দাঁড়ায় এসে।
–কিরে মাসু, ঘরভাড়া দিতিস না?
চোখেমুখে তার বিরক্তি ও ক্ষোভ। যদিও সে ভাল করেই জানে, মাসুর হাতে কোন টাকাপয়সা নেই। স্বামীটা ওকে যে টাকা দেয় তাতে কোনমতে ছেলেটাকে নিয়ে শাকপাতা খেয়ে দিনকটা কাটাতে পারে সে। আর প্রায় অচল বুড়ো বাপটা তার সামান্য ক’টাকার পুঁজি খাটিয়ে কাছের আড়ত থেকে কম দামে পঁচাধচা কিছু কলা এনে ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে আশেপাশে ফেরি করে। চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা রোজগার করতো। কিন্তু টাইফয়েড হয়ে মাসতিনেক ধরে যে বিছানায় পড়েছে আর উঠতে পারে না। ব্যবসার পুঁজি যা ছিল তা গেছে ফুৎকারে। তারপর মাসুর হাতে যা ছিল তাও গেছে। উপরন্তু এরওর কাছে বেশ কিছু টাকা ধারও করেছে মাসু। বাসাভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাসের। তার আপন বলতে আছে আর এক বোন যে পরের বাসায় ঝি-এর কাজ করে। থাকে জুরাইনের দিকে রেল লাইনের বস্তিতে। ক’দিন হলো বুড়ো বাপকে সেখানে পাঠিয়েছে মাসু। কেন না তার হাতে একটা টাকাও নেই যে অসুস্থ বাপটাকে দু’বেলা ঠিকমত খাওয়াবে। মাসুই বরাবর নিজের কাছে রেখেছে নিজের নিরাপত্তার জন্য। নিরাপত্তা বলতে, কোন প্রলোভন প্ররোচনায় পড়ে সে নিজে যাতে নষ্ট না হয়, যেন কোন খারাপ পথে পা না বাড়ায়, এজন্যই তাকে কাছে রাখা। কারণ তার একটা বোন এভাবে খারাপ পথে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে। এখনো সে নিখোঁজ। সেই ভয়ে বাবাকে কাছে রাখে সে।
মাহির মার কথার কোন উত্তর দেয় না মাসু। ছেলেটার মুখে ভাত টিপে দেয়।
–কিরে, কতা কস না ক্যান? ট্যাহা দিবার পারবি?
মাহির মা চোখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে। মাসুর চোখ ছলছল করে। কতদিন পর্যন্ত নিজে প্রায় না খেয়েই দিন কাটাচ্ছে। গত শুক্রবার স্বামী এলে তার কাছে আবদার করে কয়েকটা টাকা চেয়ে রেখেছিল। তা দিয়ে কোন মতে চলছে। বাড়িভাড়া তিন মাসে আঠারোশ টাকা বাকি পড়েছে। এত টাকা সে কী করে পরিশোধ করবে এখন?
–হুন, তরে আমি ভালো বুদ্ধি দেই–মাহির মা বলে, বাড়িঅলার লগে কতা ক, হের কাছে যাইয়া বয়, কী কয় হুন।
মাসু মুখ তুলে তাকায় মাহির মা’র দিকে।
মাহির মা তাকে ভালোইবাসে। দু’চার টাকা ধার উদ্ধারও দেয়। এখনো মাহির মা তার কাছে শ’দেড়ক টাকা পাওনা আছে। মাহির মা এখন কী বোঝাতে চায় তার জানা আছে। খোলামেলাভাবে একাধিকবার সে তা বলেছে তাকে।
ভাড়া দিতে না পারলে ঘর ছাড়তে হবে। ঘর ছেড়ে কোথায় যাবে সে? বাবার বাড়ি বলতে তো তার কিছু নেই। বাবাই তো তার আশ্রিত। বাবার মুখে শুনেছে মেঘনার তীরে কোথায় যেন তাদের বাড়ি ছিল। বাবার প্রথম বয়সেই সে বাড়ি গিলে খেয়েছে মেঘনা। আর পুরানো ঢাকায় স্বামীর ঘর কোথায় তাও সে জানে না। স্বামী তাকে বলেছে, সেখানে সে কোনদিন যেতে পারবে না। স্বামী তাকে মাসে পনেরশ টাকা দেয়। তার সাথে সম্পর্ক ঐ পর্যন্তই। এর বাইরে সে মরে গেলেও কোন টাকাপয়সা পাবে না। এবার আগেই ফয়সালা করা আছে। তাহলে এখন সে কী করবে?
বেশ ক’দিন থেকেই মাহির মা তাকে বলছে, বাড়িঅলাকে খুশি করলে ভাড়া এখন না দিলেও চলবে। চাই কি বাড়িঅলার ভালো লাগলে ভাড়াটা মাফও পেয়ে যেতে পারে। মাসুর মন তাতে সায় দেয় না।
স্বপ্ন ছিল একটা বিয়ে হবে। কিন্তু বুড়ো বাপ কোথা থেকে ধরে এনে পুরান ঢাকাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো। তখন শুনেছিলো, পুরান ঢাকায় তার বাড়ি আছে, বড় ব্যবসা আছে। এখন জানা গেছে ওসব মিথ্যে কথা। তার আছে ছোট একটা সাইকেল পার্টসের দোকান। আর কামরাঙির চরের দিকে ভাড়া বাসায় থাকে প্রথম স্ত্রী ও তা চার সন্তান নিয়ে।
মাহির মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে মাসু চুপ করে থাকায় আশান্বিত হয় মাহির মা। কারণ এর আগে যতবার সে মাসুকে এমন কথা বলেছে মাসু রেগেমেগে তাকে গালাগালি করেছে। মাহির মা তাই চুপচাপ ছেলেটার ভাত খাওয়ানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। মাসুকে যদি সে বাড়িঅলার কাছে নিয়ে দিতে পারে তাতে তার লাভ আছে। বাড়িঅলার কাছ থেকে দু’একশো বকশিশ মিলবে নিশ্চিত। আর মাসুও আপাতত চাপমুক্ত হলে সে খুশিই হয়।
ছেলেটাকে ভাত খাওয়ানো শেষ হয়েছে। মাসু শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলেটার মুখ মুছিয়ে দেয়। মাহির মা তখন ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, আইসো বাপ, আমাগো ঘরে চলো, আপুর লগে খেলবা…
হাসিভরা মুখে ছেলেটাকে কোলে নেয় সে। মাসুকে উদ্দেশ্য করে বলে, অরে আমার ঘরে রাইখা আসি, বুঝছোস।
বলে সে আর দাঁড়ায় না। ছেলেটাকে সোহাগী গলায় কী বলতে বলতে সে চলে যায় নিজের ঘরের দিকে।
মাসু চুপ করে বসে থাকে বিছানার পাশে। বুকের ভিতর দম বন্ধ হওয়া একটা চাপ অনুভব করে সে। মাথাটা যেন কাজ করছে না। কিছুই ভাবতে পারছে না।।
রান্নাঘরের দিকে রঙ মিস্ত্রির বউ আর বাস ড্রাইভার হাফিজ কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দারোয়ানের ঘণ্টাঠিকা ভাড়া দেয়া ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতরে ‘মেয়ে-জামাই’ আছে। রান্নাঘর থেকে হাসতে হাসতে বাস ড্রাইভার হাফিজ মাসুর ঘরের সামনে এসে মাসুকে দেখে বলে, আফা, বইন-দুলাভাইয়ের দামারকে তো ঘরে টিকবার পারতাছি না।
ড্রাইভারদের রুমের পাশেই দারোয়ানের মেয়ে জামাইয়ের ঘর। সেখানে পুরোনো চৌকিতে দু’জনার নড়াচড়ায় ক্যাচরম্যাচর শব্দ হয়। এ নিয়ে প্রায়শই ওরা হাসাহাসি করে। অন্যদিন হলে মাসুও হয়ত কিছু বলতো। কিন্তু আজ সে চুপ। তার মুখ ব্যাজার দেখে নেশায় লাল হয়ে ওঠা চোখ জোড়ায় একটু বিস্ময় ফুটিয়ে মাসুকে বলে, কী অইলো, মন খারাপ নি?
হ, যাও।
মাসু প্রায় ধমকে ওঠে তাকে।
ওরে বাবারে কী অইলো আবার!
বলে সে সরে যায়।
তখন মাহির মা ফিরে এসে ঘরে ঢোকে। তার একটি মাত্র চোখের দৃষ্টিতে কৌতুক নাকি বিদ্রুপ বুঝে ওঠা দায়। মাসুর সামনে এসে পুরুষালি ঢঙে বলে, ওঠ, চল।
মাসু মাথা নিচু করে থাকে।
ওই ছেরি, অত দেমাক ক্যা তর? তরে যে ডাকছে বাড়িঅলায়, এইডাই তো বেশি! আমারে কইলে তো অহনই কাপড় তুলইলা দিতাম। ওঠ, ল আমার লগে। মাসুর হাত ধরে তাকে টেনে উঠায় মাহির মা। তারপর একটু চাপাস্বরে আবার বলে, খালি তো হুগনা কাইল্যা বেডারডা দেখছোস। আইজ দেহিস বাড়িঅলা কেমন ধাক্কাডা দেয়। যদি মজা না পাস আমারে কইস। মাহির মা মাসুকে যেন একটু লোভও দেখাতে চায়। হাত ধরে টেনে মাসুকে বাইরে আসে সে।
দে, তালার চাবি দে, ঘর লাগাইয়া দেই।
মাসু যন্ত্রের মত তার পরনের শস্তা চেক শাড়ির আঁচল বাঁধা চাবিটা এগিয়ে দেয়। মাহির মা ঘরে তালা লাগায়। তারপর গলা নামিয়ে বলে, আমার পিছেপিছে আয়, কেউ বুঝবো না।
বলে সে সামনে হেঁটে যায়। মাসুও ধীর পায়ে তার পিছে পিছে গিয়ে বাড়িঅলার রুমে ঢোকে।
বাংলা মদের চড়া নেশায় চোখ লাল হয়ে ওঠা নূরুদ্দিন ওদের দেখে দাঁত বের করে হাসি দেয়। তারপর বিছানার পাশের দিকে একটু সরে এসে মাসুর দিকে তাকিয়ে বলে, বহ এইখানে।
চোখের ইশারায় বিছানার পাশটা দেখায় সে। তারপর আবার বলে, মাসু, তোমারে আমি কতো ভাল জানি, তুমি বুঝো? ভাড়া বাকি পড়ছে তো কি অইছে? আমি তোমারে কুনো চাপ দিছি? মাহির মায়ে তুমার অসুবিধার কথা তো আমারে কইছে। আমি কইছি, এইডা কুনো ব্যাপার না, অয় যেদিন পারবো দিবো। আহো, এইহানে বহো। বলে হাত দিয়ে সে বিছানায় তার পাশের জায়গাটা দেখায়।
যা, বয় গিয়া ওইখানে।
মাহির মা মাসুকে ঠেলে দেয় বিছানার দিকে। মাসু মুখ নিচু করে বিছানার পাশে বসে।
বাড়িঅলা মাহির মার দিকে তাকিয়ে বলে, দরজাডা তুমি টাইনা দিয়া যাইও।
মাহির মা খুশি মনে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। দরজার পাল্লা টেনে দিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগানোর হ্যাসবলের দণ্ডটি আংটায় ঢুকিয়ে ভাল করে বন্ধ করে দেয় দরোজাটা। তারপর নূরুদ্দীনের ঘরের ভিতর আটকা পড়ে মাসুর কেমন অনুভূতি হয়েছিলো তা আর জানা যায় না…।