ডেস্ক রিপোর্ট : মামুন বিন আবদুল মান্নান। ময়মনসিংহের এই যুবক জীবিকার তাগিদে পাড়ি দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। সামান্য বেতনের চাকরি দিয়ে শুরু করেছিলেন পেশা জীবন। এরপর মালয়েশিয়ার বুকে তৈরি করেন অনন্য নজির। একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়ে গড়েন লিমিটেড কোম্পানি। শুধু বিত্তবৈভব নয়, মানবিক কাজেও স্থাপন করেন দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশী অসহায় অবৈধ শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান। তাদের চাকরি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন।
অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করেন। অসুস্থ শ্রমিকদের দেন চিকিৎসা সহায়তা। নিহত শ্রমিকদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আহত শ্রমিকদের ইন্স্যুরেন্সের অর্থ আদায়ে দেন সহায়তা। শ্রমিকদের বিনোদনের জন্য আয়োজন করেন বিভিন্ন খেলাধুলার টুর্নামেন্ট। বার্ষিক ফিস্টেরও আয়োজন করেন তিনি। মালয়েশিয়ার বুকে গড়েন এক চিলতে বাংলাদেশ। মানবিক গুণাবলীতে অনন্য এই যুবকের জন্ম ময়মনসিংহের নান্দাইলের উত্তর বানাইল গ্রামে ১৯৭৬ সালে। তবে অভাব অনটনের মধ্যেই বেড়ে উঠেন। শিক্ষক পিতা পিতা আবদুল মান্নান ছিলেন সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি সচেতন। উত্তর বানাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আঠারোবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসি এবং কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জীবিকার তাগিদে ৯৪ সালে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। প্রথমে ৩১২ রিঙ্গিত বেতনে কাজ নেন গ্রেট ওমিট টেকনোলজিতে। কিন্তু অল্প বেতনে চাকরি করে পোষায়নি তার। যা বেতন পেতেন তা দিয়ে থাকা-খাওয়াতে সব শেষ হয়ে যেত। তাই কিছুদিন পর বাধ্য হয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেন। তার মাথায় ঘুরপাক খায় নিজে কিছু করার। সেই থেকে পরিকল্পনা করেন। এরপর আইডিডি ফোনকলের ব্যবসা শুরু করেন। ওই ব্যবসার পুঁজি ছিল মাত্র ১০ হাজার রিঙ্গিত। একটি দোকান ভাড়া নিয়ে পাঁচটি মোবাইল ফোন দিয়ে আন্তর্জাতিক এই ফোনকলের ব্যবসা শুরু করেন। মিনিটের হিসেবের ওই ব্যবসার কিছুদিনের মধ্যে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। মুনাফাও বেশ ভাল হয়। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের প্রবাসীরা তার প্রতিষ্ঠানে এসে ভিড় করতো। ব্যবসার ভাল গুডয়েল তৈরি হয়ে যায়। বেশ কিছু টাকা পুঁজিও হয়ে যায়। কিছুদিন পর ব্যবসার পরিধি বাড়ান। শুরু করেন ‘মিনি মার্কেট’ ব্যবসা। বাংলাদেশী প্রবাসীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্য তিনি সাপ্লাই দিতেন। এই ব্যবসায় তার আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এদিকে ব্যবসার পাশাপাশি মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। আর ব্যবসা করতে গিয়ে পরিচয় হয় মালয়েশিয়ান তরুণী ব্যবসায়ী মাস পুষ্পাওয়াতি বিনতি হাজী সেলিমের সঙ্গে। অল্পদিনের পরিচয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ান। শুরু করেন জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা। পাশাপাশি এ্যাগ্রু ফার্ম ও কনস্ট্রাকশন ব্যবসা। প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাল বেতনে কাজ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১১ সালে শুরু করেন অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকদের বৈধ করার প্রক্রিয়া। যেসব বাংলাদেশী অবৈধভাবে কিংবা সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল অথবা দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছিল তাদের বৈধ করেন। শুধু তাই নয় যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় বাধ্য হয়ে দেশে ফিরতে হতো তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ দিয়ে দিতেন। এমনকি যেসব শ্রমিক অসহায় হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তাদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অসহায় বাংলাদেশী এসব শ্রমিকদের লিগ্যালাইজেশনের কাজটি তিনি করতেন বিনাপয়সায়। তবে অনেকে আবার বেতন পেয়ে তার টাকা শোধও করে দিতেন। অল্পদিনে মানবিক মামুনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে কুয়ালালামপুরসহ আশপাশের এলাকায়।
অসহায় শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোয় সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে যান। তবে সবচেয়ে বড় মানবিক যে কাজটি তিনি করেন সেটি হলো মালয়েশিয়ায় কোন বাংলাদেশী শ্রমিক মারা গেলে দ্রুত তার লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এমনকি সব খরচ বহন করার পাশাপাশি ওই শ্রমিকের পাওনা-দাওনাও কোম্পানির কাছ থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। কোন শ্রমিক দুর্ঘটনায় অঙ্গহানির শিকার হলে ওই কোম্পানির কাছ থেকে ইনসুরেন্সের পাওনা আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কোন বাংলাদেশী শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে তার নিজ খরচে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কন্যাদায়গ্রস্ত কোন শ্রমিক পিতা তার কাছে গেলে তিনিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, শ্রমিকদের চিত্রবিনোদনের ব্যবস্থা করেন তিনি। কিছুদিন পরপর বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন। শ্রমিকদের জন্য বার্ষিক ফিস্টের আয়োজন করেন। এক দশকে প্রায় পাঁচ হাজার অসহায় শ্রমিককে তিনি পুনর্বাসন করেছেন। তার এই মানবিক কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেন স্ত্রী। তরুণ এই ব্যবসায়ী একইভাবে তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তার নিজ এলাকা নান্দাইলেও। এলাকায় কোন দরিদ্র মানুষ তার কাছে গেলে তাদের নিরাশ করেন না। ওই এলাকায় প্রতিটি মসজিদ-মন্দিরেও রয়েছে তার সহায়তার ছোঁয়া। সে কারণে এলাকায়ও তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সহায়তার পাওয়ার পর দরিদ্র মানুষদের মুখের চওড়া হাসি দেখলেই মানসিক শান্তি পান মামুন।
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় এমএম গ্রুপ নামে একটি কোম্পানি রয়েছে। তার কোম্পানির এমএম এক্সিলেন্ট এমএসডিএনবিএইচডি, এমএম মাল্টি মিডিয়া এসডিএনবিএইচডি, এমএম সুইট হলিডে এসডিএনবিএইচডি, শাহমাস করপোরেশন এসডিএনবিএইচডি, শাহমাস হোল্ডিং এসডিএনবিএইচডি পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার এগ্রো ফার্মে প্রায় তিন হাজার গরু-ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে গরু আমদানি করেন। মালয়েশিয়ার বাজারে মাংস যোগানে বড় ভূমিকা রাখছেন তিনি। বাংলাদেশেও এমএম এক্সিলেন্ট বিডি লিমিটেড নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের প্রসেসিংয়ের কাজ করেন।
সম্প্রতি মামুন আলোচনায় আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা আসাদুজ্জামান পংপং-এর বিরুদ্ধে মামলা করে। বিবিসি সহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম তাকে নিয়ে সংবাদ প্রচার করে।
আপনার মন্তব্য লিখুন