রঙের জীবন

দ্বিতীয় সত্তা – ৩য় পর্ব || অরণ্য ইমতিয়াজ

পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ খারাপ, শুধু আমি ভালো, আমার মতো ভালো আর কেউ নেই। আপনি ভালোভাবে খেয়াল করে দেখবেন সবাই এভাবেই প্রকাশিত হয় নিজ নিজ সমাজে। হ্যাঁ আমার মতো কিছু মানুষ থাকে যারা চাইলেও বলতে পারে না আমি ভালো, সমাজের সেই স্তরে যে আমরা চলতেই পারি না। আমি তো মানুষ খুন করি, আমি নিজেকে ভালো বলি কি করে বলুন তো!!! আমাকে দেখে সবাই ভয় পায়, দূর থেকেই সালাম দেয়, যেন পাছে আবার আমি রেগে না যাই তার উপর। হ্যাঁ আমি খারাপ, আর আমি আমার খারাপটাই প্রকাশ করি সবার কাছে, অভিনয় করে বলি না আমি ভালো, মিশতে যাই না আপনাদের সেই ভালোমন্দের সমাজে। আমি তো অস্ত্র দিয়ে খুন করি, কিন্তু আপনাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা প্রত্যক্ষভাবে খুন না করলেও পরোক্ষভাবে মানুষ খুন করে যায় একের পর এক। তাদের কিন্তু কেউ খুনি বলে না।

তারা আবার সমাজের সিংহাসনে বসে রাজত্ব করে চলেন। সেলিম ভাইকে তো চিনতেন আপনি, ওই যে গত বছর মারা গেল হঠাত করেই। কেউ তাকে খুন করেনি, একদম স্বাভাবিক মৃত্যু। আপনারা তাই জানেন কিন্তু আসলেই কি স্বাভাবিক ছিল তার মৃত্যু?? আপনি কি জানেন? আসলে আপনি না কেউ জানেনা তার যে জমিটা বিক্রি করেছিল আসলে সে ওইটা বিক্রিই করেনি। তার থেকে জোর করে নিয়ে নেয়া হয়েছে। কাউকে সে বলতেও পারেনি, কাউকে যে বলবে সেই সাহসটাই তো ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল তার কাছে থেকে।এই যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারেনি, নীরব যন্ত্রণায় তিলে তিলে সে মারা যায়। সমাজের উঁচুঁ আসনে আসীন সমাজপতিরা এমন কতো মৃত্যুর কারণ কেউ কি হিসেব রাখে নাকি জানতে চায় বলুন তো ভাই???

কি সব বলছি শুনুন তারপর কি হলো, ওরে মেরে ফেলার পর থেকেই কেমন যেন একটা হতাশা গ্রাস করে আমাকে। প্রায় দুতিন মাস আমি ঘর থেকে বের হইনা,কিছু ভাবতে পারিনা,কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করে না। যে আমি একদিন নেশা না করে থাকতে পারতাম না সেই আমি ওইসব ছুঁয়েই দেখতাম না। ঘর থেকেই বের হতাম না যে,বারবার শুধু ওর অবিশ্বাস ভরা চোখ দুটো দেখতে পেতাম। ওর ডাক শুনতে পেতাম আমি, মনে হতো আমার সাথেই ও আছে সর্বক্ষণ। ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করি। মনে মনে স্বিদ্ধান্ত নেই জীবনে আর কাউকে মারবো না। মানুষ জনের সাথে মেশা কমিয়ে দেই। বেশীরভাগ সময় একা একাই কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু আবার নেশা শুরু করি, ওরে ভুলে থাকার জন্যই মূলত আবার নেশাটা ধরি। কিন্তু মজার বিষয় কি জানেন, মানুষ বলে নেশা করলে সব ভুলে থাকা যায়, আসলে কিন্তু তা না। যতক্ষণ আপনি নেশা করবেন ততোক্ষণ ঠিক আছে কিন্তু যখন আপনি নেশায় চূড় হবেন মানে মাতাল মতো হবেন তখন আপনার কষ্টের অতীত সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজ করতে থাকবে। যতক্ষণ না আপনি ঘুমাতে পারবেন ততোক্ষণ সেই অতীত আপনাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে। নেশা করলে ভুলে থাকা যায় বলতে, নেশা করলে আপনি না চাইলেও ঘুমিয়ে পড়বেন। আর যতক্ষণ মড়ার মতো ঘুমাবেন ততোক্ষণ আপনি শান্তিতে থাকবেন।

মানুষ ভাবে একরকম আর হয় একরকম। সবকিছুই নিখুঁত হয়েছিল তাই জানতাম। আমি আমার মতোই চলতে থাকলাম। সবকিছুর থেকে দূরে একা একা। প্রায় দুবছর পরে হঠাত একদিন আলতাফ আসে আমার কাছে। সেও আমাদের এলাকাতেই থাকে কিন্তু এই দুবছর যেমন কারো সাথে মিশিনি, ওর সাথেও না। জরুরী কথা আছে বলে বাইরে নিয়ে যায় ও আমাকে। কারো সাথে না মিশলেও জানতাম কে কেমন আছে। ওর অবস্থা তখন বেশ খারাপ চলছিল। যখন ও আমাকে বাইরে সবার থেকে দূরে নিয়ে যায় তখন আমার মনে হয়েছিল হয়তো টাকা ধার চাইবে। টাকা চাইলে আমি দিতামও ওকে। ও টাকাই চায় আমাকে কিন্তু যে কারণে চায় তা শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।
এখানে কেউ নেই এখন বল কি হয়েছে?
দোস্ত আসলে ব্যাবসায় খুব লস খাচ্ছিরে, আমাকে কিছু টাকা দিতে হবে তোর,
কত টাকা?
পাঁচ লাখ।
আমি হেসে উঠি আরে পাগল আমি এতো টাকা তোকে কি করে দিবো? চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার হলে না হয় কথা ছিল।
কিন্তু তোকে যে দিতেই হবে।
এমন ভাবে বলছিস যেন মনে হচ্ছে তুই আমার কাছে টাকা পাস আর সেটা চাচ্ছিস তুই?
মনে কর তাই, দোস্ত দুবছর আগে সেই রাতে কি হয়েছিল সেটা আর মনে করতে চাই না, টাকাটা দিয়ে দে জীবনের তরে ভুলে যাবো।
আমি জীবনে এতো অবাক হইনি সেদিন ওর ওই কথা শুনে যতোটা হয়েছিলাম। বলার মতো কোনও কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন।পরেরদিন দেখা করবো বলে চলে আসি আমি।
মনের ভেতর একটা কথাই শুধু শুনতে পেলাম, ভালো হতে চাইলাম কিন্তু ভালো হতে পারলাম না।

ভাই পৃথিবীতে নিখুঁত বলে আসলে কিছু নেই। আর অপরাধ সে তো কখনোই নিখুঁত হয়না। একটা কথা কি জানেন, মানুষ মৃত্যু থেকে বাঁচতে চায়, পালিয়ে বেড়ায় সবসময়, কিন্তু মানুষ এটা বুঝেনা মৃত্যু থেকে বাঁচার কোনও উপায় নেই। যত যাই করুক না কেন সময় হলে মৃত্যু হানা দিবেই তার জীবনে। মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানুষ যে প্রতিনিয়ত মৃত্যুকেই কাছে ডাকে এটা তারা বুঝতেই পারেনা। মানুষ এই অমোঘ নিয়তি থেকে কখনোই মুক্তি পাবে না কিন্তু হাজার চেষ্টা করে বেড়ায় মুক্তি পাওয়ার আবার একটু চেষ্টা করলেই সহজ সুন্দর জীবন গড়তে পারে, কিন্তু তা তারা কখনোই করেনা। এখানে আপনি বলতে পারেন তাহলে আপনি চেষ্টা করেননি কেন? ভাই আমি কিন্তু আমার জীবন সুন্দর করে গড়ে নিয়েছিলাম ওই দু বছরে কিন্তু আবার যে এই পথে আসি তা কিন্তু আমি ইচ্ছে করে আসিনি। আমার নিজেকে বাঁচানোর জন্যই আসতে হয়েছে। আস্তে আস্তে সব জানবেন আপনি।

কাল রাতে আসতে বলে আমি তো বাসায় চলে আসলাম, মাথার ভেতরে সারাক্ষণ চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই ভাবনার ইতি টানতে পারছিলাম না। টাকা যে দিবো না এটা তো প্রথমেই স্থির করেছিলাম। ওই মুহুর্তে আমার কাছে ওই পরিমাণ টাকা ছিল না, আর একবার দিলে যে পরেরবার আবার চাইবে না এর কোনও বিশ্বাস নেই। আসলে চিন্তা করছিলাম খুনটা করবো কি করে? ও যে আমার সাথে নির্জন কোথাও যাবে না এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম কিন্তু প্রকাশ্যে কি করে কাজটা করবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। ভেবে ভেবে কোনও পথ পাচ্ছিলাম না, আসলে পাইনি বলাটা ভুল হবে, একটা পেয়েছি কিন্তু তা করবো কিনা আর করাটা ঠিক হবে কিনা তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। গভীর রাত অব্দি ভেবেও যখন কোনও পথ বের করতে পারলাম না নিরুপায় হয়ে সেই স্বিদ্ধান্তটাই নিলাম যা আমি কখনোই নিতে চাইনি।

পরদিন সন্ধ্যাবেলায় বাজারের চায়ের দোকানে আমি অপেক্ষা করছি ওর আসার। একটু পরেই ও চলে আসে।
কিরে চা খাবি তো?
ভাই আরেকটা চা
বন্ধু টাকাটা এনেছিস তো
আরে আসলি মাত্র চা খা, বসে একটু গল্প করি, তোর সব ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।
তুই যা বলছিস ব্যাবস্থা না করে উপায় আছে আমার!!!
তুই আমাকে ভুল বুঝিস না, আসলে তোর সাথে আমি এমনটা করতে চাইনি কিন্তু এখন আমার এমন অবস্থা যে আমার আর কোনও পথ খোলা ছিল না। খুব বেশী দরকার হয়ে পড়েছিল টাকার।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার পিঠে ভারী কিছুর আঘাতে সামনের দিকে উল্টে পড়ি আমি। হঠাৎ এমন আচমকা হামলাতে হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকে ও, উঠে যে দৌড় দিতে হবে সেটাও ভুলে যায়। এদিকে চারপাঁচজন ক্রমাগত পেটাতে থাকে আমাকে এর মাঝেই কেউ একজন বলে উঠে এই ওরেও ধর। ও আর পালানোর সুযোগটা পায় না। ওদের আসা আর যাওয়ার মাঝে হয়তো দুমিনিট সময়ও অতিক্রম হয়না। কোনওক্রমে মাথা তুলে দেখতে পাই আমার বন্ধুটি রাস্তায় উপর হয়ে পড়ে আছে। আমি জানি ও আর উঠবে না। ওরা চলে যাওয়ার পরই বাজারের সব মানুষ এসে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমাদের সমাজের মানুষগুলি কতো ভীতূ সেটা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। মাত্র চার পাঁচজন মানুষ যদি অস্ত্র নিয়ে বের হয় পাঁচশো মানুষ লেজ গুটিয়ে পালায়।কিন্তু একটু সাহস করে যদি দশজন মানুষ এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের মতো সম্রাটের জন্ম কখনোই হতো না। আমি তো দুদিনেই ছাড়া পেয়ে যাই হাতে পায়ে কিছু ব্যান্ডেজ নিয়ে। ও চলে যায় সেখানে যেখানে আমি পাঠাতে চেয়েছি। কিছু অজ্ঞাত ব্যাক্তির নামে খুনের মামলা করে পুলিশ। অবশ্যই আমি সকল সন্দেহের বাইরে ছিলাম।

যেদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় আসি সেদিন বিকেলেই একটা ফোন আসে। এবার প্রতিদান দেয়ার পালা আমার। আমার জীবনের চতুর্থ খুন যা করতে হবে কালকেই। শুরু হয় আমার জীবনের কন্ট্রাক্ট কিলিং মিশন।

(চলবে)