অণুগল্প

মাহিনের সু’পথে ফেরা || রুহুল আমিন রাকিব

মাহিন নামটা কত সুন্দর! তাইনা?
নাম সুন্দর হলে হবে কি!
মাহিন কিন্তু একটুও ভালো ছেলে নয়।
মাহিনের বাড়ি ,কামাল খামার, আমবাড়ি নামের গ্রামে।
মাহিনের কাজ সব সময় সবার সাথে দুষ্টমি করা।
হোক না সে বয়সে বড় আর ছোট কোন বাদ বিচার নেই সবাই কে অসম্মান করতেই যেন সব থেকে বেশি ভালোবাসে মাহিন।
আর পড়-লেখার ধারেও যায় না,কখনো স্কুলের মাঠেও ঠিক মতো পা দেয়নি মাহিন।
গাঁয়ের সব ছেলেরা মাহিনের কাছ থেকে সব সময় দূরে-দূরে থাকে।
অন্য ছেলেদের মা,বাবা কখন’ই ওদের ছেলে কে মাহিনের সাথে মিশতে দেয়না।
আর মাহিনকে নিয়ে প্রতিদিন একটার পর একটা অপমানের লজ্জায় পড়তে হয় মাহিনের মা,বাবা’কে।
এমন কোন দিন নেই যে মাহিনের নামে নালিশ করে না গাঁয়ের লোকেরা।
গ্রামে কোন কিছু চুরি হয়ে গেলেই হয়,
সব দোষ আর সন্দেহের তীর এসে পড়ে মাহিনের উপর।
চুরি না করেও কত জনের হাতে যে চড় থাপ্পর সহ্য করতে হয়েছে মাহিন কে,এর যেন কোন শেষ নেই,
নেই এই প্রশ্নর উত্তরও।
এই’তো কিছু দিন আগেও পাশের বাড়ির হাঁস চুরির অপরাধে মাহিনকে সন্দেহ করা হলো এর পরে মাহিনকে ধরে ইচ্ছা মতো উত্তম মধ্যম দেওয়া হলো,গাঁয়ের সবার সামনে।
যদিও চিৎকার করে সেদিন অশ্রু শিক্ত নয়নে বলে ছিলো আমি চুরি করি নাই,এই হাঁস চুরির বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
তবে কে শুনে তার কথা!
মাহিনের প্রতি মাহিনের বাবা মায়েরও ঘৃণা হয়,
রোজ কত বকা আর মা’ইর যে খায় বাবার হাতের এর পরেও একটুও ভালোর পথে আসেনা মাহিন।
মাহিনের প্রিয় একটি নেশা হলো পাখির বাসা খুঁজে বের করা
আর নীরহ পাখিদের ফাঁদ পেতে শিকার করা।
বক পাখি,ঘুঘু পাখি,শালিক পাখি,টিয়ে পাখি এদের বাসা খুঁজে বের করে,ওদের বাসার ডিম পাড়া থেকে শুরু করে বাচ্চা ফুটানো পর্যন্ত সব খোঁজ খবর রাখে মাহিন,
ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলেই হলো
ছানা গুলো একটু বড় হতে না হতে,সুযোগ বুঝে মাহিন গাছ বেয়ে তা পেড়ে নিয়ে আসতো।
আর বাজারে নিয়ে বাচ্চা গুলো বিক্রি করে দিতো নয়তো মেরে ফেলতো।
কত পাখির ছানা যে এভাবে মাহিন ধরে আনে, এর কোন শেষ নেই।
ওই গাঁয়ের মানুষ মাহিনের ব্যবহারে একদম অতিষ্ট হয়ে পরছে মাহিনের প্রতি।
শুধু কি মাহিনের প্রতি?
মাহিনের জন্য তার বাবাও গাঁয়ে সমাজে মুখ দেখাতে লজ্জা করে,
গাঁয়ের কোন সমাজ-মূলক কাজে মুখ খুলে কোন কথা বলাতো দূরে থাক,মাহিনের বাবাকে কেউ সমাজের কোন কাজে ঠিক মতো ডাকেও না।
যদিও মাহিনের বাবা একদম সহজ সরল আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন।
গাঁয়ের সবাই মাহিনের বাবা কে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জানে,তবে ছেলের এমন ব্যবহারের জন্য কেউ এখন আর তেমন একটা মান দেয়না মাহিনের বাবা’কে।
ছেলের জন্য কত দোয়া করে
মাহিনের মা,আল্লাহর কাছে। তবে একটুও পরিবর্তন নেই মাহিনের।
সেদিন রাতের ঘটনা,
সেদিন দিনে অনেক গুলো পাখি ধরছে মাহিন,ইয়া বড় বড় ঠোঁট আর বেশ সুন্দর দেখতে পাখি গুলো।
পাখি গুলো ধরে অনেক খুশি মাহিন,কারন আজ বাজারে পাখি গুলো বিক্রি হলে অনেক টাকা আয় করবে মাহিন।
যদিও পাখি গুলোর নাম সঠিক জানা নেই মাহিনের,
তবে এই পাখি গুলো যে শীতের অতিথি পাখি,এই কথা বেশ ভালো করেই জানে মাহিন।
কারন প্রতি শীতের মৌসুম আসলে এমন নাম না জানা অনেক রঙ বে রঙের অতিথি পাখি ঝাকে ঝাকে উড়ে আসে আমাদের দেশে।
যখন ওদের দেশে প্রচন্ড রকম শীত পড়ে
পাখি গুলো তখন অনেকটা অসহায় হয়ে পরে।
নিজের জীবন বাঁচাতে পাড়ি জমায় লাল সবুজের এই প্রিয় বাঙলা দেশে।
আর মাহিন ওদের দূর্বলতাকে পুঁজি করে রোজ ফাঁদে আটকে ফেলে।
পাখি গুলো বাজারে বিক্রি করে হাসি খুশি মন নিয়ে বাড়িতে এসে রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে,
পরের দিন পাখি ধরার পরিকল্পনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছে মাহিন।
হঠাৎ মাহিনের ঘুম ভাঙে শরীরে প্রচন্ড রকম ব্যথা আর জ্বর নিয়ে, পানির পিপাশাও খুব পেয়ে বসেছে মাহিন কে।
তবে বিচানা থেকে একটুও উঠে দাঁড়াবার শক্তি যেন নেই মাহিনের শরীর জুড়ে,
অনেক চেষ্টার পরেও দাঁড়াতে পারলো না মাহিন।
শেষে মাহিনের চিৎকার শুনে পাশের রুম থেকে ঘুম-ঘুম চোখে উঠে আসে মাহিনের মা,
এর পর মাহিন সব ঘটনা খুলে বলে তার মায়ের কাছে।
সেদিন রাতটা অনেক কষ্ট করে কাটিয়ে দিল মাহিন,
সকাল বেলা ডাক্তার ডাকা হলো
বাড়িতে
ডাক্তার মাহিন কে দেখে বললেন মাহিনের কালো জ্বর হয়েছে,
এটা অনেক খারাপ জ্বর তাড়াতাড়ি করে মাহিন কে হাসপাতালে নিতে বললেন ডাক্তার।
এর পরে মাহিন’কে কুড়িগ্রাম সেবা-ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো।
আজ তিন দিন হলো,জ্বর যেন কিছুতে থামছে না মাহিনের।
আজ যেন একটু বেশি অসুস্থ মাহিন, শরীর একদম কালো হয়ে গেছে দূর থেকে দেখে যে কেউ ভয়ে আতকে উঠবে মাহিনের মুখ দেখে।
একটুও ঘুমাতে পারছে না মাহিন
চোখের পাতা বন্ধ করলে মাহিন দেখতে পায় তার সামনে ছোট বড় অনেক গুলো পাখি চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে আছে,
মনে হচ্ছে এই বুঝি সবাই মিলে মাহিনকে খেয়ে ফেলবে।
আর পাখি গুলো যেন মাহিনের খুব পরিচিত,
যে পাখি গুলো রোজ ফাঁদ পেতে শিকার করতো।
এই দৃশ্যে দেখে ভয়ে আতকে উঠে মাহিন
ভয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকায়,
আর মায়ের কাছে বলে মা-মা দেখ এই যে পাখি গুলো আমাকে ধরতে আসছে।
মাহিনের কথা শুনে,শান্তনা দিয়ে মাহিনের মা বলে
কি বলছো এই সব আবল-তাবল কথা?
হাসপাতালে আবার পাখি আসবে কোথা থেকে!
তুমি ঘুমাওতো এই সব কথা বাদ দিয়ে,
সব সময় পাখির খবর রাখতে রাখতে তোমার মাথাটা গেছে একে বারে।
সেদিন রাতে ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমাতে যায় মাহিন
হঠাৎ করে মাহিন স্বপ্নে দেখে ছোট বড় ওই পাখি গুলো মাহিনের কাছে এসে বলতেছে এই যে মাহিন তুমি আমাদের সবাই কে মেরে ফেলছ,
তুমি আমাদের ফাঁদ পেতে ধরে এনে বাজারে বিক্রি করেছ।
তুমি কি কখনো জানতে চেয়েছো আমাদের নীড়ে আমাদের বাবা মা ,ভাই বোন,আর আমাদের ছোট-ছোট ছানা দের কষ্টের কথা?
আমাদের ধরার কারনে,বাসায় আমাদের ছোট ছানা গুলো দিনের পর দিন না খেয়ে মারা গেছে।
তুমি একবার চিন্তা করে দেখ,
তোমার বাবা মায়ের মুখ পানে তাকিয়ে দেখতো ওরা কত কষ্ট পাচ্ছে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়াতে।
এই যে মাহিন প্রতিটা বাবা মায়ে এমন কষ্ট পায়,ছেলে মেয়ের কিছু হয়ে গেলে।
আজ থেকে তুমি শপথ করো আর কোন দিন কারো ক্ষতি করবে না,পাখির ছানা ধরবে না
বাবা মা আর বড় দের সম্মান করবে,ছোট দের আর বন্ধুদের ভালো বাসবে,রোজ স্কুলে যাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে।
তুমি যদি আমাদের কথা রাখ তবে তোমার এই রোগ থেকে আল্লাহ্ তোমাকে মুক্ত করবে ,
নয়তো তোমার মৃত্যু হবে।
ভালো থাক মাহিন ভালো থাক,
স্বপ্ন শেষ হতে না হতেই ঘুম ভেঙে গেল মাহিনের,এর পরে চিৎকার করে বাবা মায়ের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো,আর শপথ করলো আজকের পর থেকে আর কোন খারাপ কাজ করবে না মাহিন,পাখির ছানাও ধরবে না।
আর কখনো খারাপ আচরনও করবে না কারো সাথে।
আজকের পর থেকে বাবা মায়ের সব কথা মন দিয়ে শুনবে আর রোজ স্কুলে যাবে
সময় মতো নিয়মিত নামাজও পড়বে মাহিন।
মাহিনের কথা শুনে অনেক খুশি হলো মাহিনের বাবা মা।
দেখতে দেখতে মাহিনের শরীর প্রায় সুস্থ হয়ে গেল
যদিও ডাক্তার বলছে আরো কিছুদিন রেষ্টে থাকতে হবে মাহিন কে,
তবে হাসপাতাল থেকে চাইলে এখন চলে যেতে পারে মাহিন।
আজ সোমবার হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরছে মাহিন,
মাহিন এখন থেকে আর খারাপ কাজ করবে না এই কথা অনেক আগে থেকে জানতো মাহিনের গাঁয়ের বন্ধুরা।
তাই সবাই অপেক্ষায় বসে আছে মাহিনদের বাড়ির পাশে পুকুর পারে
দেখতে দেখতে রিক্সা এসে দাঁড়াল মাহিনদের পুকুর পারে
এবার রিক্সা থেকে নামার পালা,
একে একে মাহিনের সব বন্ধুরা এসে দাঁড়াল মাহিনের পাশে ।
এর পর মাহিন কে সবাই মাঝ খানে নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এক সুরে সবাই বলে উঠলো
শুভ হোক মাহিন তোমার নতুন জীবনের পথ চলা।
আর সেদিনের পর থেকে কামাল খামার, আমবাড়ি গ্রামে কেউ পাখি ধরে না,
কেউ কোন খারাপ কাজ করতে পারে না।
এখন রোজ সকালে ওই গ্রামে সবার ঘুম ভাঙে মাহিনের মিষ্টি কণ্ঠে ফজরের আযান শুনে
আর পাখিদের কিচির-মিচির শব্দের সুর শুনে।

সফিপুর,গাজীপুর