পুব-দক্ষিণ আকাশে মেঘের ঘনঘটা, শা শা শব্দে ধুলো মিশ্রিত বাতাসের তোড় যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত ধরাকূল। ভেঙে চুরমার করবে গ্রামের পর গ্রাম।পড়ন্ত বিকালবেলা প্রকৃতির এ রূপ মূর্তিমান খুব একটা যে অমূলক নয়,অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রকৃতির এ আচরণ তবু অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়। খুবই নিরব নিভৃতে কপালের ভাঁজ কুঁচকিয়ে অস্ফুটভাবে কতগুলো ভয়ার্ত মুখের আহাজারি, নিমিষে শেষ সুখ টুকু কেড়ে নেবার ভয়ে।
এ আহাজারি রোজ চলে রোজ দেখা যায় বাংলার মানচিত্রে তবু ভদ্রকুলে নয় অভদ্রকুলে। মহুর্তের মাঝেই কালো মেঘে পুরোটা আকাশ ঢেকে গেল,অন্ধকার নেমে এলো চারিদিক। বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে, গাছপালা গুলো রীতিমতো ভয়ে প্রকম্পিত দুলছে।কি অসহায় লাগছে? সবে গাছ নেতিয়ে আসা কচি আম গুলোর সেকি আত্নচিৎকার, শূন্যে মিলিয়ে যায় দূর বহুদূর। এ চিৎকার কি নিদারুণ কি নিষ্ঠুর এ নির্যাতন তবু এটা নিয়মেই চলে।
প্রাচীন থেকে প্রাচ্যে, প্রাচ্যে থেকে আধুনিক সভ্যতা এ যে এমন করে চলতেই থাকবে। ঘরে ঘরে ঘর থেকে মায়েদের আহাজারি শোনা যায়, ছোট্ট বোনটার সেকি কলজে ফাটা চিৎকার, কি পাথর সম শেল বিঁধে আমার কচি হৃদয়ে? বাতাসের সাথে বৃষ্টির পাল্লা তার ও সাথে আমাদের পাল্লা চলে বেশ ঘটা করে। আরও এগিয়ে যাওয়ার কার আগে কে কত পাবে? চৌর্যবৃত্তি মনোবাসনা তবু এ ছেলেদের কে কি নির্মম আনন্দে উদ্বেলিত করে।
কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে,কেন হবে না এটাও তো নিয়মের মধ্যেই পড়ে। এ প্রতিবন্ধকতা এ বয়সেই এমন করে জয় করবার খেলা, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কি তর তর করে উপরের দিকে ধাবিত হবার দুঃসাহস? ভয়ডর হীন আমরা একদল ভবিষ্যৎ এর স্বৈরশাসক। নিষ্পেষিত,নিপীড়িত ধনী গরিবের ভেদাভেদ ছিনিয়ে নাও, ছিনিয়ে নিতে হয়, না হলে কৌশলে কৌশলী হও; তবু হয় বাঁচো না হয় বাঁচাও নিজের অস্তিত্বকে।
ঝড়ের গতি সর্বোচ্চ থেকে সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে। অতিক্রম করি আমরাও।বিদ্যুৎ চমকায়,চমকে চমকিত চৌকস পৃথিবী। আলোর ঝলকানি চোখে মুখে আঘাত হানে আমাদের।কয়েক কোঁচা আম চুরি করার কি অভিপ্রায়ের হেয়ালিপনা? প্রতিযোগিতায় তবু হার নেই, আমরা গুটিকতক ছেলে হার মানতে জানিনা। তবু এ রাজ্যে চলে চুরির মহোৎসব। চলছে চলবে, চলুক এভাবে! আমাদের ছোট্ট মাথায় এ মহান ভাবনার উদয় কি হবেনা? কেন নয় প্রকৃতির নিয়মে ওটাও সম্পন্ন হবে কোন এক এমন বৈশাখীর ঝড়ে। মোটে সাত টি আম পাড়তে পেড়েছি আমি।
এটা নিয়েই আমি বাড়িতে আসলাম। এক মাত্র থাকবার ঘরটার অর্ধেক নেই দেখে আমার মুখ খানা কেমন পাংশুটে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগের আনন্দমাখা হাসি মুখ এমন করে নিভে গেল।যেন তেল শেষ হয়ে যাওয়া কোন প্রদিপের শিখা। ভেজা শরীরে কাঁপতে কাঁপতে আম গুলো উঠোনে রাখলাম। আমাকে দেখা মাত্রই মা লাঠি নিয়ে মারতে এলো । অবস্থা বেগতিক দেখে আমিও দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।
বৃষ্টি হচ্ছে সমানতালে। ভাঙা দেউরি ঘরটায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা বিড় বিড় করে বলতে লাগল। এবার জ্বর নিশ্চিত ধরবে,তোরে কে বলেছে ভিজতে, টাকা নেই পয়সা নেই ঘরে খাবার চাল নেই… ইত্যাদি… ইত্যাদি… মায়ের কথাটাই সত্যি হল। রাত বাড়ার সাথে সাথে আমার বেশ জ্বর এলো। মা একটা ছেড়া কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে আমার চারপাশ। মা তার ছেঁড়া আচলের টুকরোতে পানি ভিজিয়ে আমার কপালে লাগিয়ে দিল। বেশ আরাম অনুভব হতে লাগল আমার। রাত টাও বেড়ে চলছে। কাঁথার ভিতর থেকে মুখ খানা বের করে মায়ের উদ্দেশ্য বলতে লাগলাম “মা খিদা লাগছে”
মায়ের কোন রুপ সাড়া না পেয়ে আমি আবার বলে উঠলাম ” মা খিদা লাগছে” ওমা মা মাগো কই গেলেন? ও মা… আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, যে আজ ঘরে খাবার নেই। বাজার সদাই সব বাজারে, বাবা আজ কয়েক দিন বাড়িতে নেই কোন একটা কাজে গেছে। তবে বড় ভাই নিশ্চয় চাল ডাল নিয়ে আসবে এই ভেবে আমার মুখ খানা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যদিও খিদা টা বেড়েই চলছে।
সকালে একটু পান্তা খেয়েছি, দুপুরে পেটে কিছুই পড়েনি,আম চুরি করার সময় একটা পাঁকা আম খাওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর বাবা আসল তাও শুণ্য হাতে, ঘরে কিছু নাই শুনে মায়ের সাথে সেকি রাগা রাগি। মায়ের বাপের বাড়ী তুলে গালাগাল দিতে দিতে বাবাও শুতে চলে গেল। মা ও বাবার কথার উত্তর দিতে লাগল।বাবা সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে এসে মাকে মারা শুরু করল।আমিও কাঁদতে শুরু করলাম। ঘর ভেঙেছে তার টেনশন, ঘরে খাবার নেই তার টেনশন। আর কত? কিরে বৃষ্টিতে তুই আবার ভিজেছিস রে হারামজাদা আরও ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বাবা আমাকেও গালাগাল দিতে লাগল।
আমার কষ্টে বুক ফেটে যেতে লাগল। গালি শুনে আমার যতটা না খারাপ লাগল তার থেকে দ্বিগুণ খারাপ লাগল মাকে মারতে দেখে।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। হঠাৎ বড়ভাই এর একটা হাত আমার মাথায় অনুভূত হতেই জেগে উঠলাম। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বড় ভাই বলে উঠল,”ভাই উঠ। এই দেখ পাঁচ টাকার মুড়ি আনছি খাবি না।ভাইয়ের আদরমাখা স্পর্শ পেয়ে আমিও বলে ঊঠলাম “জ্বী ভাই খাব” । বলা মাত্রই আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
কাল বৈশাখী ঝড়ের মতই এ কান্না। আমার মাথাটা বুকের ভিতর জড়িয়ে বড় ভাই বলতে লাগল ভাই কাঁদিস না। এই দিন একদিন থাকবেনারে। বাবা মা ভাই তিনজনেই আমার কান্না দেখে হতবাক হয়ে গেল। অতঃপর সবাই মুড়ি খেয়ে শুতে গেলাম। আমার পাশে বড় ভাই। বড় ভাইয়ের মতই কেমন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল ভাই ঘুমা, কাল যে তোর পরীক্ষা আছে ।ভাঙা বেড়ার ফাক দিয়ে অবিরত বাতাস আমার ছোট্ট মুখটায় অবিরত ঝাপটা দিয়েই যাচ্ছে।
#নিচু তলার উকিল
আপনার মন্তব্য লিখুন