জীবনের গল্প রঙের জীবন

দেশ স্বাধীন হলো তবুও যুদ্ধ শেষ হলো না সহযোদ্ধা রওশন আরার

শেষ রাত হতে আরোও কিছুক্ষণ বাকি আছে। একটু পরেই ফজরের আজান দেবার সময় হবে। অন্য কোন সময় হলে হয়তো এলাকার প্রত্যেকটি বড় বড় মসজিদের মাইক থেকে এক নাগারে আজানের সুর শুনতে পেতাম কিন্তু সেরকম আর হয় না তখন। হবে কিভাবে? মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, শান্তিতে এক মুহুর্ত ঘুমাতে পারে না কোন মানুষ। সব সময় নিজের জীবনের হুমকিতে থাকে আবালবৃদ্ধবনিতা। কখন জানি পাকিস্তানী খানেরা আসে তারপর বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়ে, গুলি করে জীবনটাই না শেষ করে ওরা!

দেশে যুদ্ধ চলাকালীন এমন এক রাতে হাজী সাহেব বাড়িতে থাকে না। তখন তার বড় ছেলে তিনজন যার যার মতো আত্নীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে পালিয়ে আছে আর ছোট দুই ছেলে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তায়। ওরা অনেক ছোট তাই হয়তো এমন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। এত বড় বাড়ি তার উপর তেমন কোন পুরুষ মানুষ নেই। একটু আগেই মুক্তিবাহিনীর একটা দল বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে কোন এক অপারেশন করার জন্যে। আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধারা আসে রাতে কিছু সময়ের জন্যে থাকে, রান্না বান্না করে, মিটিং করে তারপর দলে দলে ভাগ হয়ে কোথায় জানি চলে যায়। এই খবর রাজাকাররা খানেদের কাছে পৌছে দিয়েছে। তাই ভয়ে ভয়ে থাকি কখন যে খানেরা আসে আর কি যে হয়!

নানা কিছু ভাবতে থাকি বিছানায় নির্ঘুম শুয়ে থেকে আর অপেক্ষা করি ভোরের আলোর। এরই মাঝে কানে আসে ধুপ থাপ বুটের আওয়াজ। রাস্তায় পাওয়া আওয়াজ ধীরে ধীরে বাহির বাটিতে এসেছে। বুঝতে বাকি থাকে না খানেরা এসেছে। আমি এক মুহুর্ত দেরী না করে ছুটে যাই ছোট দুই ছেলে যে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো সেই ঘরে। যত দ্রুত পারি ছেলেদের ডেকে তুলে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে ওদের পাঠিয়ে দেই নিরাপদ আশ্রয়ে। তারপর নিজে আশ্রয় নেবার জন্যে দৌড় দেই পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, খানেরা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আমি আর ওদের ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারি নাই। দৌড়াতে দৌড়াতে টের পাই আমার কোমরের ডান পাশে প্রথমে একটা আঘাতের পরে বাম পাশে আরো একটা। আমি মাটিতে পরে যাই। এক খান রাইফেলের বাট আমার দিকে করে বার বার জিজ্ঞেস করছিলো “মুক্তি কাহা”, “চেয়ারম্যান সাহাব কাহা”? আমি কোন উত্তর দেই নাই। জানি না সেই রাগেই কি না। ওই খান আমার ডান পায়ে গুলি করে সরাসরি। সারা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে, আমি জ্ঞান হারাই সেদিনের মতো।

গল্পের মতো মনে হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাস্তব এবং প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর একটি এটি। এমন অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন প্রায় সত্তর বছরের এক বৃদ্ধা, নাম তার রওশন আরা বেগম। খামসামা উপজেলার আংগার পাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আকবর আলী শাহ এর দ্বিতীয় স্ত্রী ইনি। স্বামীর কড়া নির্দেশ ছিলো যেসব মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে এসে আশ্রয় চাইবে নির্দ্বিধায় যেন তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। দেশের প্রতি ভালোবাসা আর স্বামীর আদেশ মানতে গিয়ে নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে সাময়িক ভাবে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দেখ-ভাল করেছেন রওশন আরা বেগম। যার ফলস্বরুপ হারিয়েছেন ডান পা! সেদিন গুলি লাগার পর আলাদা আলাদা সময়ে তার ডান পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে দুই বার।

কোমরের নিচে থেকে যতটুকু রাখা সম্ভব সেটুকু রেখে কেটে ফেলা হয় সম্পূর্ণ ডান পা। রওশন এর জীবনে নেমে আসে আরেক যুদ্ধ এ যুদ্ধের নাম বেচে থাকার যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোদ্ধা হিসেবে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধের অবসান হলে তাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে নিজের শরীরের বিরুদ্ধে। স্বামী মারা যাবার পরে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে আরোও অনেক কিছুর সাথেই, যেগুলো নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না।

তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো জীবনের এ পর্যায়ে এসে আপনার কোন চাওয়া আছে কি কারোও কাছে? উত্তরে অভিমানের সুরে তিনি বলেছেন, “আমি আর কি চাইবো? জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে এই দেশ বা দেশের সরকারের থেকে এখন পর্যন্ত কোন স্বীকৃতি আমি পাইনি। অনেকেই এসে এসে দেখে যায়, আমার যে পা আমি হারিয়েছি সেই পা না থাকার ছবি তুলে নিয়ে যায় এপাশ-ওপাশ থেকে! কিন্তু পরে আর কোন খবর আসে না তাদের থেকে। আমি অপেক্ষায় থাকি আমার স্বীকৃতির, অন্তত সেটা সহযোদ্ধা হিসেবেও হোক। মরার আগে যেন এটা আমি দেখে যেতে পারি।”

কথা বলার ধরনে বুঝতে পারি চাপা একটা ক্ষোভ আছে তার মনে। পরের প্রশ্ন করি আর্থিক কোন টানাপোড়েন আছে কি না তার জীবনে? প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকেন রওশন আরা বেগম। তারপর বলেন, আমার সব পক্ষের ছেলেরাই আমাকে অনেক ভালোবাসে, সন্মান কর। ওরা ওদের সাধ্যমত আমাকে সব কিছু দেবার চেষ্টা করে। আমি অন্য কোন যায়গা থেকে কিভাবে তাহলে পয়সা-করি চাইবো? আমার পরিবার এই অঞ্চলের প্রভাবশালী পরিবার সে অনুযায়ী আমি কোন অর্থ সহযোগীতা কারোও কাছে চাইতে পারি না। এতে আমার পরিবারের নাম খারাপ হবে, না কি বলো?

পর পর দুটো প্রশ্ন ছুরে দেন তিনি আমাকে। এই প্রশ্ন গুলোর অন্য মানে খুঁজে ধরা দেয় মনে। সেদিকে আর আলাপ আগানো হয় না। কথায় কথায় জানা যায়, বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার আশায় খানসামা মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর কমান্ডারদের অফিসে তিনি আবেদন জানিয়েছেন। সে অনেকদিন হয়। এই তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন খানসামা মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মোখলেসুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে রওশন আরার যে অবদান সেটাতে হয়তো তিনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাবেন। তবে সহযোদ্ধা হিসেবে তার স্বীকৃতি পাওয়াটা এখন সময়ের দাবী। তার অভিমান-অভিযোগ বার বার ইংগিত করায় আর্থিক দৈন্যতার যা মুখে বলতে পারেন না তিনি। বড় কোন স্বীকৃতি না হউক, তার বলতে না পারা আর্থিক সমস্যার সমাধান না হউক? সামনের বিজয় দিবসে এই মহিয়সী নারী কি উপজেলা পর্যায় থেকে একটা সন্মাননাও পেতে পারেন না? মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে খাইয়ে, পড়িয়ে যে সহযোগীতা করেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেটার বিনিময়ে? নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে পাক হানাদারদের সাথে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন রওশন আরা পা হারিয়ে সেই যুদ্ধ তাকে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে? দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলো না রওশন আরাদের।

আশিক মুন্নাকে সাথে নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন নাজমুল হাসান সাগর।