অণুগল্প

অনিমেষ আর নেই || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

অনিমেষ ভীষণ প্রাণ চঞ্চল আর আবেগ প্রবণ। ওর অনেক ছেলেমানুষী আছে। সারাদিন মোবইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। নেট সার্ফিং করতে ও ভীষণ ভালোবাসে। ও খুব ভালো গান গায়,কবিতা লেখে। অবশ্য ও আদৌ কোন কবি নয়। তবুও লেখে ,কেউ পড়ুক আর না পড়ুক।
কেউ like বা comment না দিলেও কিছু যায় আসে না।
অনিমেষ ভীষণ চিন্তাশীল মানুষ,ওর কবিতায় যেমন থাকে সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ,তেমনি থাকে প্রকৃতি, গাছগাছালি,পাখি,নদী আর প্রেম।
অনিমেষের কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে “নন্দিনী”। প্রায় প্রতিটি প্রেমের কবিতায় নন্দিনীর সমুজ্জ্বল উপস্থিতি। অনেকেই প্রশ্ন করে কে এই “নন্দিনী”? থাক না কিছু গোপন। সব না জানাই ভালো
অনিমেষের একটা নিজস্বতা ছিল।
সেটা ওর সিগনেচার বলা যেতে পারে। ভীষণ ছেলেমানুষী আর অভিমানী ছিল। ও হঠাৎ হঠাৎই মোটর সাইকেল নিয়ে ফুল স্পিডে অনেক দূর চলে যেত। দূরের কোন মাঠে বা কোন জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকতো। অনেকবার এই একলা জঙ্গলে বসে থাকার জন্য ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। ও কিন্তু
ওসব খুব একটা আমল দিত না।
ভীষণ স্টাইলিস্ট আর আমুদে স্বভাবের ছিল অনিমেষ।খুব দামী দামী জিন্সের প্যান্ট,নামি ব্র্যান্ডের টি শার্ট ,জামা,স্পোর্টস সু ওর খুব পছন্দের। গলায় সোনার চেইন,আঙ্গুলে গোটাচার আঁটি
এই সব নিয়ে ও একটা সজীব মানুষ।
অনিমেষ খুব একটা বেরুতো না।
ও সারাদিন তিনটে দামী মোবাইল নিয়ে নেট ঘাঁটতো।ফেসবুকে কবিতা লিখত, চ্যাটিং করত। একদম বাচ্চা ছেলের মতো। ও তো গান শেখেইনি,কিন্তু খুব ভালো গান গাইতো। কারাওকে চালিয়ে গান গেয়ে ফেসবুকে,হোয়াটসআ্যপে পোস্ট করত। কে শুনলো ,কে শুনলো না এ সব নিয়ে ওর কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। ওর গান গাওয়াতেই আনন্দ।
হঠাৎই ওর কবিতার লাইন থেকে উঠে আসে তার কবিতার নারী। সে ভীষণ খুশি হয়।তার কল্পনা,ভাবনার এমন বাস্তব রূপ দেখে সে অবাক হয়ে যায়।
অনিমেষ মাঝে মাঝেই খুব বিষন্ন হয়ে যেত। অথচ ওর বিষন্নতার কোন কারন ছিল না। এটা ইদানিং খুব হচ্ছিল। ও প্রায়ই খেত না, জিঞ্জেস করলেই বলত “ভুলে গিয়েছিলাম”! ডাইনিং টেবিলে সব রাখা থাকতো কিন্তু ও কোনদিনও সময় মতো খেতো না।
অনিমেষ কয়েক মাস আগে একটা কবিতা লেখে।কবিতাটার নাম ছিল –” হাইওয়ে”। ওই কবিতাটা পড়ে যারা ওকে ভালোবাসে তারা সবাই বলেছিল ওরকম কবিতা লেখা ঠিক হয় নি।
কিন্তু কয়েকমাসের ব্যবধানে যে সেটা বাস্তবে ঘটে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি। অনিমেষ কি বুঝতে পেরেছিল?
অনিমেষ আর নেই। ও হাইওয়েতে
বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
ওর এত কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ ,গান
সব ফেসবুকের অন্তরালে তরঙ্গে তরঙ্গে ঘুরে বেড়াবে। কেউ শুনবে না কোনদিন। ওতো কোন কবি ছিল না। ওর কোন ছাপার অক্ষরে বই নেই –ওতো ফেসবুকের কবি ছিল।
ওর ওই কবিতাটি এখানে দিলাম।
কেমন করে কেউ নিজের মৃত্যু এমন করে বর্ণনা করতে পারে।
অনিমেষ আর নেই ,কিন্তু ওর লেখাটা রয়েগেছে।

#হাইওয়ে#

হাইওয়ের পাশে যদি পড়ে থাকি
অঢেল রক্ত আর নীল নীল মাছি
ভাঙ্গাচোরা বাইকের টুকরো
এধার ওধার -ভেঙে যাওয়া
হেড লাইটের কাঁচ
চিনির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে
কেউ চিনবেনা-বে-ওয়ারিশ লাশ
মৃত কুকুরের মতো পড়ে আছি
চার পাশে কৌতুহলীদের ভিড়
কিছু “আহা উহু” “আহা রে”
এই সব শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে
আমি সব দেখতে পাচ্ছি
একটা লোক আমার সোনার চেন
খুলে নিলো, পার্স, আংটি সব নিয়ে
চলে গেল।
আমি চিৎকার করে মানা করলাম
আমি লোকটার পিছনে
দৌড়ুতে শুরু করলাম
আমি লোকটাকে ধরে ফেললাম
আশ্চর্য্য ! লোকটা কিছু অনুভবই করল না
আমি ওকে থাপ্পড় মারলাম
আমি চিৎকার করে গাল দিলাম
সে কিছুই শুনতেই পেল না।
আমার শরীরে কোন ওজন নেই
আমি আবার আমার বাইকের কাছে
ফিরে এলাম
হঠাৎ পুলিশের গাড়ি এসে আমার মতো
যে এ্যাকসিডেণ্টে মারা গেছে
তাকে নীল প্লাস্টিকে মুড়ে নিয়ে চলে গেল
আমিও গেলাম পুলিশের গাড়িতে
আমাকে কেউ দেখতে পেল না
আমি বার বার বললাম
“আমার সব নিয়ে নিয়েছে একটা লোক
আমার সোনার চেন,পার্স ,আমার আঁটি
সব ! সব নিয়েছে”।
কেউ আমার কথা শুনতে পেলো না ।
আমার মনে হল–আমি বাড়ী ফিরে যাবো
আমি বাড়ী ফিরে এলাম —
অথচ আমায় কেউ দেখতে পেল না।
আমি খুব জোর দিয়ে ডাকলাম -“নীলা
নীইইইইলা———আমি ফিরে এসেছি”
নীলা আমাকে দেখতেই পেল না
আমার কোন অস্তিত্বই নেই
তবে কি আমি মারা গেছি ?
হঠাৎ আমার খুব ভয় হলো
হঠাৎ আমার খুব কষ্ট হলো
হঠাৎ আমার খুব কান্না পেলো
হঠাৎ আমার জীবন ফিরে পেতে
ইচ্ছে হলো ।
নীলার কাছে এখনও খবরটা আসেনি
নীলা এখনও জানেনা
হঠাৎ দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন
কিন্তু বাবা তো নেই
উনি তো মারা গেছেন
চল্লিশ বছর আগে !
আমি বাবাকে প্রণাম করলাম
বললাম–“পিতা নো হোসি ”
আমি মা কে দেখতে চাইলাম
মা নেই ।
বাবা কেমন ঈশ্বরের মতো বললেন –
“বাসাংসি জির্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃন্হাতি নরোহপরাণিি
তথা শরীরাণি বিহায় জির্নান্যানি সংযাতি
নবানি দেহী॥
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে
নীলা কি থাকতে পারবে ?
আমি নীলাকে জড়িয়ে ধরে
কাঁদতে চাইলাম–
হায় ! এ অভাগা শেষ হলো রাজ পথে
রাজার মতো
“ওই মহা সিন্ধুর ওপার হতে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে
বলে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা
হেথা নাইকো মৃত্যু নাইকো জরা”…..
———————————————-
অনিমেষ নেই -ওর লেখাটা আছে
অনিমেষ নেই-ওর ভালোবাসাটা রয়ে যাবে তোমাদের বুকে।
অনিমেষ নেই
সে আর জাগবে না কোনদিন
কোনদিন আর ……….

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত