জীবনের গল্প

জীবনের শত রঙ || রুমানা হক

গাজীপুর থেকে নিউমার্কেট গামী ভিআইপি বাস, নীলের কাঁধে মাথা রেখে খুব কষ্টে বসে আছে চারু, পেটে ৮ মাসের বাচ্চাটাকে নিয়ে চেকআপে যাওয়ার জন্য। মার বাসায় ছিলো গত ২ দিন, সেখান থেকে পরিচিত ডাক্তারকে দেখিয়ে বাসায় যাবে। প্রায় ২ ঘন্টা যাবত একি যায়গাতেই আটকে আছে, বাস একসুতো এগুচ্ছে না।
এই ঠান্ডা আর বৃষ্টিস্নাত আবহাওয়ার মধ্যে দরদর করে ঘামছে। নীল ছেলেটা শাড়ীর আঁচল দিয়ে একটু পরপরই মুছে দিচ্ছে।

১ সিট পরেই হাবীবুর রহমানকে দেখলাম খুব উশখুশ করছে, পাশে বসা ৯-১০ বছরের ছেলেটা সম্ভবত তার ছেলে, কথা শুনে যা বুঝলাম- তার টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন, উপায় পাচ্ছে না।
বলাকা বাস, নাফিসার ভয়ার্ত চোখমুখ!
এমবিএ’র কোন সেমিস্টারে পড়ে, আজ কোন এক কোর্সের ফাইনাল। বাসা টঙ্গী হলেও এমনিতে পান্হপথ যেতে ম্যাক্সিমাম আড়াই ঘন্টা সময় লাগে, সো ৪ টায় বের হলেই আরামে যাওয়া যায়। ৭ টায় এক্সাম অথচ ৬ টা বাজে এখনো সে এয়ারপোর্টরোড, কল দিয়ে কান্না কান্না গলায় সম্ভবত স্যারকে কনভেন্স করার চেষ্টা করছে।
তেতুলিয়ায় এখন উঠলাম, এক যুবককে কাঁদতে দেখা যাচ্ছে, একি!!
ছেলে মানুষ সবার সামনে এভাবে কাঁদে?
একটা চাকরীর খুব দরকার তার, অনেক চেষ্টার পর এক বন্ধু একটা ইন্টার্ভিউর ব্যবস্থা করেছে মিরপুরে, স্যর নাকি অফিসের শেষ টাইমে সময় দিতে পারবে।

আগেভাগেই বের হয়েছিল মিশু কিন্তু কে জানতো যে এমন হবে।
বন্ধু কল দিয়ে বললো, বস বলেছে- বিকেলে যে ইন্টার্ভিউ দিতে আসতে পারে না, সে সকালে সময়মত অফিসে এটেন্ড করবে কিভাবে? সো ক্যান্ডিডেট রিজেক্টেড।
এটা শোনার পরেই চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেনি।
আহ্!!! একটা এ্যাম্বুলেন্স সেই কখন থেকে কুইকুই করে যাচ্ছে। এর মধ্যে বয়স্ক মিজানুর সাহেব বুক চেপে যায় যায় অবস্থা, স্ত্রী আর মেয়ে সমানে কেঁদে চলেছে। তার ছেলে অনি দৌড়ে একবার সার্জেনের কাছে যাচ্ছে আবার এ্যাম্বুলেন্সের কাছে আসছে চিৎকার করতে করতে। সার্জনকে জাস্ট ২ মিনিটের জন্য রোড ক্লিয়ারের অনুরোধ করছে। সার্জনের আর কি দোষ কি, ডিউটি পালন করছে। পুরা রাস্তা জ্যাম কতটুকুই আর ক্লিয়ার করবে।

লোকটির নাকি মেজর হার্টএটাক হয়েছে, মিরপুর হার্টফাউন্ডেশনে রেফার করা হয়েছে ইমিডিয়েট।
আহারে, মনে হয় বেচারা বাঁচবে না।
এদিকে জামান সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, ক্লায়েন্টরা অপেক্ষা করছে, এরপর একটা টেন্ডার জমা দিতে হবে আজই লাস্টডেট।
মনে হয় না আজ আর গাজীপুর যেতে পারবে রাতের আগে। তিনি ভালো মানুষ সততার সাথেই এতোদূর এসেছে। ঠিকমত সরকারকে ট্যাক্স আর কর্মচারীদের বেতন দেয়।
কি আর করবে, প্রাইভেটকারে বসে বসে পএিকা পড়ছে।
মাহফুজের ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি, সন্ধ্যায় অপারেশন অথচ সে এখনো খিলখেত। বাইক নিয়েও কোন দিক দিয়েই বের হতে পারছে না, এমন চিপায় পড়েছে। ঐ তো দুঃচিন্তায় তার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে।
আরো কত জনেরই না গল্প আছে….
কজনের কথা বলবো?
অনেকই বিপদে পড়ে, অথচ এই প্রধান রাজপথ গুলো এমন বেহাল দশায়!
এখন রাত ১২:১৪ মিনিট।
এখনো ট্রাফিক লেগেই আছে, প্রায় ৯ ঘন্টা হতে চললো…