রঙের জীবন

দূষিত রক্ত || মানজারুল ইসলাম দুলাল

বাবু কাঁন্দিস কেন বিকাল হইলে গঞ্জে গিয়া সদাই কিনে দিবো। সে কথা শুনিয়া কান্নার আওয়াজ ক্রমাগত বাড়তে লাগিলো।শিশু মায়ের কন্ঠ শুনিলে নীরব হইয়া যায়, এ কথা সত্য বলে মানিতে হইবে। মায়ের কোলই হইল শিশুর নিন্দ্রা যাপনের সঠিক স্থান তাই যত কান্নাই করুক না কেন মায়ের স্পর্শ পাইলে, সে নীরব হইয়ে যায়। হালিমা বেগম হইল রহিমের অর্ধাঙ্গী, আর শিশু বাবু কে নিয়ে তাদের পরিবার।

রহিম একজন বংশগত ভাবে কৃষক পরিবারের ছেলে শুধু কৃষক বলিলে ভুল হইবে সাথে কৃষক জমিদারবাড়ি বলিতে হইবে। লেখাপড়া বেশি করতে পারেনি বলিলে ভুল হইবে। সে নিজের ইচ্ছায় ত্যাগ করিয়াছে তবে নিজের নাম আর ঠিকানা লিখতে পারে বলেই গর্ব। বানান করে বড় বড় অক্ষর থাকিলে পড়িতে পারে। রহিমেরর বাবা শরিফউদ্দিন, গ্রামের লোকেরা মাতব্বর বলিয়া ডাকে কারণ সমাজের বিচার আচারে তার বড় মুখ আছে। রহিম ছিল তার তৃতীয় নম্বর সন্তান বড় ভাই আর একটি বোন আছে। শরিফউদ্দিনের অনেক জমিজমা ছিল, এই সম্পত্তি বড় ছেলে হেলাল আর জেসমিন এর লেখা পড়া করাতে অনেক জমি বিক্রি করে দিয়াছে। আর যা ছিল তা নিজেই আবাদ করিতেন। বড় ছেলে হেলাল এখন ম্যাজিস্ট্রেট আর জেসমিন আরা ব্যাংকার।

রহিম লেখাপড়ায় বেশি ভাল ছিল না বলিয়া তাকে বাড়িতে কাজের জন্যই রাখা হইয়াছে। তাই সে বাড়িতে থাকিয়া জমিজমা দেখা শোনার ভার নিয়াছে। এভাবে দিন ভালোই চলিতেছে। শরিফউদ্দিন চিন্তা করিল যে আমি আর কত দিন বাঁচিয়া থাকিবো, বয়সের কারণে আমার নানা বিধি সমস্যা লাগিয়ে থাকে। মরার আগে অন্তত রহিমের বিয়েটা করিয়ে দিয়ে যাই আর বড় দুই জনে তো ভাল চাকুরী করে তারা চলিতে পারিবে, রহিমকে একটু বেশি জমি দিয়ে গেলেই বাকি জীবনটা ভাল ভাবে কাটাইতে পারিবে। রহিমের পাত্রী দেখা শুরু হইয়া গেল, পাশের গ্রামের আব্বাস উদ্দিনের মেয়ে হালিমা।লেখাপড়া বলতে ভাল কুরআন পড়িতে পারে, নামাজ পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত, পর্দাশীল,রান্না করিতে পারে।সুন্দরী তো বটেই। রহিম দেখিতে গেল তার নববধুকে। সে দর্শন করিল তাহার চোক্ষু দুটি কে তার পর দেখিল মধু মিশ্রিত চঞ্চু। কেশ তাহার যেন বনলতার মত।তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া বিয়েতে মত প্রকাশ করিল।।।। 
আমি তাহারে আনিবো ঘরে যে আলোকিত করিবে আমার ঘরটাকে।

বাবার মৃত্যু পর।

বড় ভাই আর বোন এসে জমিজমা ভাগ করে দিয়ে চলে গেল। রহিম অনেক সুখেই নতুন বউকে নিয়ে দিনমান চলিতে লাগিল। বউ এর আদর ভালবাসার কোন কমতি নেই।রান্না তে বেশ ভাল। রহিম জমি চাষ করে যে অর্থ আসে তা দিয়ে তার সংসার ভাল ভাবেই চলে যায়। অভাব তাকে আঘাত করিতে পারে না। 

অনেক দিন পর তার বাল্যকালের বন্ধু কাসেম এর সাথে বাজারে দেখা হল, অনেক খোশগল্প হল। কাসেম বলল চল বন্ধু আজ তাস খেলতে যাই কত দিন হলো খেলি না। রহিম বলল চল, জুয়া পাড়া নামে একটা গ্রাম আছে সেখানে গিয়ে তারা প্রতিদিন জুয়া খেলিতে লাগিল। একদিন লাভ হলেও তা দশ দিন লোকসানের কাতারে পরিণত হইত।
আর যেই দিন লাভ হইত সেই দিন গঞ্জে এসে খাওয়া দাওযার ধুম চেপে যাইত। এভাবেই চলছে দিনমান, বিকাল হলেই হাজির হত জুয়া আর মদের আবগারিতে। কখনো কখনো সকালে যায় রাতে বাসায় ফিরিয়া আসে আবার কখনো রাত কাটিয়ে দিন আবার হয় রাত এই হল জুয়ারু দের নেশা ।নেশা ধরিয়া গেল, মানুষ যে অভ্যাসের দাস তাহা সে প্রমানিত করিলো।we make first our habits than habits make us.jhon dryden.প্রথমে আমরা অভ্যাস গড়ে তুলি পরে অভ্যাসই আমাদের গড়ে তুলে।

তাহার ক্রমাগত জমির পরিমাণ কমতে লাগিলো, বিক্রয়ের পরিমাণ বাড়তি হওয়ার কারণেই। । জুয়া খেলা প্রতিদিন চলতে লাগলো সাথে নেশা তো আছেই। জুয়ায় হেরে গিয়ে জমি বিক্রি করা শুরু করিলো। কাঁচা টাকা হাতে আসলে মানুষের মন সর্বদা প্রফুল্ল থাকে।নতুন কিছু ভাবিয়ে তুলিতে নিজেকে ব্যস্ত করিয়া তুলে। অর্থ যেমন সুখকে প্রভাবিত করে আবার দুঃখকেও কাছে টানিয়া আনে আবার চরিত্র কে কলুষিত করিয়া তুলে। যিনি সম্পদ গড়েন তিনি বলিতে পারেন সম্পদের কি মুল্য। 

এই ভাবেই জমি বিক্রি করিয়া জুয়া আর নেশার খাতে ব্যয় করে। এই দিকে হালিমা সহজ সরল বলে কোন কিছু জানতেই পারে না।শেষ অংশের খেলা তবুও হেরে গেল দুচোখ লাল হতে লাগিলো দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পেতে লাগিলো কি করবে কিভাবে চলবে বাকিটা জীবন ।নিজেকে আজ ছোট মনে করিয়া, হতাশার চাদর নিয়ে নিলয়ের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল।বাড়িতে এসেই বুঝিতে লাগিল, কত সুন্দর ছিল আমার জীবন গড়ার চাবি কাটি আজ অন্যের হয়ে গেল। চল আজ তোমাদের বাড়িতে যাইবো, হালিমা তো অনেক খুশি বাপের বাড়িতে যাইবে, কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে বাড়িঘর সহ বিক্রি করিয়া জুয়া খেলে নিঃস্ব হয়ে তোমাদের বাড়িতে আসিয়াছে।

যাক বউ কে শ্বশুর বাড়ি রেখে আবার সে জুয়া পাড়া হাজির কিন্তু টাকা নেই কি করবে চিন্তা করতে লাগিলো দুই বন্ধু, কি করা যায় এখন। দু জনেই ফিরে এলো জুয়া পাড়া থেকে।

টাকার নেশা তাদের মাথা থেকে এখনো যায়নি, টাকা না হলে তারা জুয়া খেলিতে পারিবে না আর যে টাকা তারা লজ দিয়েছে সেই টাকা তারা কিভাবে তুলে আনিবে। 

বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলো যে তার ছেলে হয়েছে কিন্তু কি করবে, কিভাবে তার বউ কে বলিবে যে জমি বাড়ি সকল কিছু বিক্রি করিয়া আমি জুয়া খেলে হেরে গিয়াছি। ছেলের জন্মতে তাকে পুলকিত করেনি।দুচোখ মিলিয়ে তাকিয়ে দেখেনি, দেখতে কেমন হইছে সেটাও বলিতে পারিবে না। এই দূষিত রক্ত নিয়ে আমি কখনো তাকে স্পর্শ করিব না।আমার রক্ত দূষিত আমি নিজেই দূষিত। সকাল হলেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলিয়া গেলো।কোথায় যাবে কি করবে কিছু বলেনি হালিমাকে।

শেষ বচন তাহার এই ভাবেই প্রকাশিত হল। হে ভাই খেলিস না জুয়া, করিস না লোভ, নিঃস্ব করে দিবে হ্নদয়টাকে।ভিখারীতে পরিণত করিবে তবু ও ছাড়িতে পারবেনা এই মরণ নেশা।
কলিজাতে হবে ঘা যদি করিস লোভ।
আমি যে পাপী তাই হয়েছি লোভী,আর মৃত্যু হল একটুকরো ঘা তেই। ফিরে নাহি আসিবো হে প্রিয়া আমি যে রক্তে দূষিত হয়েছি।

দু দিন পর, রহিম কে বিভিন্ন জায়গাতে
খুজে কোথাও পাওয়া গেল না।
হালিমা হতবাগ কি হল তার, কোথায় গেল। সবাই ব্যস্ত রহিমকে খুজতে কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।
কিছু দিন পর হালিমা জানিতে পারিলো বাড়িঘর জমি সব বিক্রি করিয়া সে জুয়া খেলিয়াছে। হালিমার এই কিছু দিন পর হালিমা জানিতে পারিলো বাড়িঘর জমি সব বিক্রি করিয়া সে জুয়া খেলিয়াছে। হালিমার এই গুলোতে কোন মাথা ব্যাথা নেই। যে হারিয়ে গেছে তাকেই খোজ আর যে জিনিস কখনো ফিরে পাবেনা সেটা নিয়ে সময় নষ্ট করা এক ধরণের বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।মানুষ বেঁচে থাকিলে কত কিছু আবির্ভাব করিবে, কত সৃষ্টির অবদানে ভূষিত হবে। শুধু বারবার আল্লাহ কাছে প্রার্থনা করে বলে হে আল্লাহ তুমি তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাই না শুধু রহিম কে ফিরিয়ে দাও।

রহিমার বচন:

কি অভিমানে চলে গেলে
নতুন চাঁদ কে না দেখিয়ে।
তোমার বাবু এখন বড় হয়েছে
তোমাকে বারবার ডাকছে।।

রাজিবপুর,কুড়িগ্রাম