রঙের জীবন

বাউণ্ডুলে হিমু ।। মোঃ আবির হোসাইন রুবেল

আমি এখন জেলে আছি। অনেকক্ষণ ধরেই ময়ূরাক্ষী নদীটাকে বের করতে চাচ্ছি,কিন্তু কিছুতেই পারছিনা। বের করতে পারলে জেলে থাকা প্রতিটা ঘন্টা আমার কাছে একসেকেন্ড এর সমান মনে হতো। অবশ্য তাতে আমার খারাপ লাগছেনা। এখানে সব কিছুই আমার ভালো লাগছে। লিকলিকে সেন্ট্রি,ওসির নাকের উপর গোপাল ভাঁড়ের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো বিশাল গোঁফ,সবার চোখের মুখে সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততার ছাপ খুব মজা নিয়ে উপভোগ করছি আমি। মশাগুলো আমার চারপাশে বিরক্তিকরভাবে উড়াউড়ি করছে। যদিও মশাগুলোর উপর আমি একটুও বিরক্ত নয়। কারণ আপাতত ওদের সাথে কথা বলেই সময় কাটাতে হবে। তাছাড়া যেসব জিনিস সবার কাছে অপ্রিয়-বিরক্তিকর সেসব জিনিস ই আমার কাছে পরম চাওয়া।

একটু পর ওসি আসিফ ইকবাল আমার কাছে আসলেন। নাম অবশ্য ওসি সাহেবের নেমপ্লেট দেখে জেনে নিয়েছি। একটা চেয়ারে বসে আছি আমি। সামনে ছোট একটা টেবিল। মাথার উপর ১০০ওয়াটের একটা বাল্ব ঝুলছে। ওসি আসিফ ইকবাল কয়েকবার আমার চারপাশে ঘুরে তারপর টেবিলের উপর বসে পড়লেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন,
~ বল খুনটা তুই ই করেছিস।
~ আমি খুন করতে যাবো কেনো? আমিতো ওখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। কার লাশ পড়ে আছে কোথায় আমি ওসব খেয়াল করিনি।
~ এখন হাতটা পেরেক দিয়ে টেবিলের সাথে গেঁথে দিলেই সত্যি কথাটা বের হয়ে যাবে।
~হাহাহা! হাসালেন ওসি সাহেব। আপনি পেরেক দিয়ে গেঁথে দিবেন আমার হাত টেবিলের সাথে? কিন্তু আপনিতো সেটা পারবেন না। কারন,রক্ত আপনি ভীষণ ভয় পান। আর আপনার বউ ও প্রায় আপনাকে এই কথাটা বলে। অবশ্য আপনি সেটা করলেও আমার খারাপ লাগতো না। বীভৎস অভীজ্ঞতার মাঝে একধরনের মাদকতা আছে।
ওসি সাহেব হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে বের হয়ে গিয়ে নিজের চেয়ায়ে বসলেন। বুঝলাম আমার অন্ধকারে ছোঁড়া ঢিলটা ঠিকঠাক লেগে গেছে। কপাল থেকে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছচেন ওসি সাহেব। তারমানে আমি যা বলছি সব মিলে গেছে। মানুষগুলোকে এরকম একটা অনাকাঙ্খীত চিচ্যুয়েশনে ফেলতে আমার খুব ভালো লাগে। মিনিট পঁয়ত্রিশ পর ওসি সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি হাসতে হাসতে ওসি সাহেবের সামনে বসতে বসতে বললাম,”ভাবী তাহলে বেড়াতে গেছে স্যার?” আসিফ ইকবালের কপালের ভাঁজটা এবার দ্বিগুন হয়ে গেলো। তারপর একটু ঝুকে আমার সামনে এসে বললেন,”আপনি কি জাদু জানেন হিমু সাহেব?” বাহ্! ওসির মুখে নিজের নামের শেষে সাহেব শব্দটা শুনতে ভালোই লাগছে। তারপর মুখে শুকনো হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে বললাম,”একটু চা হবে ওসি সাহেব? সাথে রসগোল্লা। চায়ে রসগোল্লা চুবিয়ে খাওয়া আমার খুব প্রিয়। খেতে খেতেই না হয় বলি সব?”

একটুপর চা আসল। সাথে রসগোল্লাও। আমি খাচ্ছি আর ওসি সাহেব হা করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে যেনো এলিয়েনকে খেতে দেখতেছেন। আমি তোয়াক্কা না করে বললাম,শুনেন ওসি সাহেব, আমি জানি আপনি বাইরের খাবার নিতান্ত বাধ্য না হলে খান না। কিন্তু আজ খেয়েছেন। নিশ্চয় ভাবী বাড়ি নেই। তাই আজ আর বাড়ি থেকেও খাবার আনতে পারেন নি রাতের জন্য! “পুরোটা ঠিকঠাক হলোনা। কারণ আমার বউ বেড়াতে যায়নি। একেবারে পরপারেই পাড়ি জমিয়েছে লাস্ট সানডে তে। হুম,আমার বউ ও জানতো আমি রক্ত ভীষণ ভয় পাই। তারচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে আমার বউ ও চা দিয়ে রসগোল্লা খেতে খুব পছন্দ করতো। তাই বলে ভাববেন না এসব কিছুর জন্য আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আসলে জ্বালানিমন্ত্রী কল দিয়েছিলো। যদিও তিনি নিজ ইচ্ছেয় কল দেন নি। উনার ছেলে জাফরের জোরাজুরিতে কল দিয়েছেন। জাফর কিভাবে যেনো জেনেছিল আপনি এই থানায় বন্দী আছেন। কথা শুনে বুঝলাম উনি আপনার উপর বেজায় রেগে। অবশ্য রেগে থাকবেন ই না বা কেনো? আপনি যে একবার জাফরকে নিয়ে গলা পর্যন্ত গর্ত করে জোৎস্না দেখার মতো অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়েছেন সেটা তিনি ভুলেন নি আজ ও।

ওসি থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা ধরলাম। আজ আকাশে মেঘে ঢাকা। তাই বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু হঠাৎ একটা মাঝবয়সী কণ্ঠে আমার নাম শুনে থমকে দাঁড়ালাম। “হিমু! আপনি হিমু না? আপনাকে অনেক খুঁজেছি পাইনি। অথচ আজ কতো সহজে পেয়ে গেলাম।” আমার মনে পড়ে গেলো,আরও প্রায় একবছর আগে লোকটা তার পাঁচ বয়সী ছেলেকে দাঁড় করিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিলেন। ছেলেটা হঠাৎ ই রাস্তার মাঝখানে চলে যায়। আমি দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে আসি। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছিল ছেলেটি। “হুম,আমি হিমু। তো কেমন আছেন? আপনার ছেলে কেমন আছে?” “সে ভালোই আছে। আচ্ছা আপনাকে কোনো হেল্প করতে পারি? পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। আমার নিজের দু’টো ফ্যাক্টরি আছে। টাকা পয়সা লাগলে বলবেন। এই নিন আমার কার্ড!” ” আচ্ছা আপনি একটা চাকুরি দিতে পারবেন? মোটামুটি মানের হলেই হবে। আমার জন্য না। আমার ফ্রেন্ড জহিরের জন্য!” “সেটা আর এমন কি? কাল ই আসুন না। অনেক পোস্ট ই খালি আছে!”

ভদ্রলোক থেকে বিদায় নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। না! আর ঘরে যাওয়া চলবেনা। জহিরের বাসায় যাওয়া যাক একবার। কিন্তু জহিরের বাসায় গিয়ে লাভ হলোনা। ওর বাসায় তালা দেয়া। তাই রুম্পার বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। রুম্পা জহিরের লাভার। যদিও এখন রাতের বয়স প্রায় ১টা। কিন্তু হিমু হওয়ার এই একটা সুবিধা। যখন-তখন কারো বাড়িতে গিয়ে উপস্তিত হওয়া যায়। গিয়ে রুম্পাকে পেলাম। জহিরের চাকুরির একটা ব্যাবস্থা হয়েছে শুনেই রুম্পার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রুম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রুপার কথা মনে হয়ে গেলো। রুপাকে দেখতে যাওয়া হয়না অনেকদিন। রুপাকে এখন কল দিলে নির্ঘাত ওর বাবা ধরবে। তারপর আমি বলবো,”হ্যালো এটা কি ফায়ারসার্ভিস?” কিন্তু লাভ হবেনা। রুপার বাবা আমাকে ঠিক চিনে ফেলবে। তারপর চিৎকার চেঁচামছি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে। নাহ্! থাক এতো রাতে কারো ঘুম নষ্ট করার ইচ্ছে হচ্ছেনা আজকে। তারচেয়ে ফুফুর বাড়ি যাই,সেটাই ভালো হবে।

ফুফু আমাকে দেখেই চলে যেতে বললেন। এই শীতের কালে এরকম ন্যাড়া টাইপের চুলের কাটিং নাকি তার পছন্দ হয়নি। ফুফার মতো তার ও দৃঢ় বিশ্বাস তাদের একমাত্র ছেলে বাদল আমাকে দেখলেই সেও নিশ্চিত এরকম চুলের কাটিং দিবে। বাদল আবার মহা ভক্ত। কিন্তু আমি যাওয়ার আগেই বাদল এসে হাজির। আমাকে দেখেতো ও মহাখুশী। “আর এ হিমু ভাই কখন এলেন? বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো? ভিতরে আসুন না প্লিজ?” না থাক আজ আর কাজ নেই। আজ বরং আসি। ফুফার সাথে আরেকদিন এসে দেখা করে যাবো। বাইরে এসে দেখি ভরা জোৎস্না আকাশের বুকে। সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ থাকায় জোৎস্না চোখে পড়েনি। রুপাকে কল দিতেই হবে। এরকম চাঁদনী রাতে রুপাকে কল না দিলে রাত টা মনে হচ্ছে পূর্ণতা পাবেনা। মনু মিয়ার দোকান সারা রাত খোলা থাকে। সেখান থেকেই কল দেয়া যাক।

“হ্যালো রুপা! কেমন আছো? ঘুমাওনি তুমি? আমিতো ভাবি ই নি কল টা তুমি ই রিসিভ করবে। শুনো আমি আসতেছি। তুমি গাড় নীল শাড়ীটা পরে এসে বারান্দায় দাঁড়াও!” কল কেটে দিয়ে মনু মিয়ার হাতে ৫টাকা গুঁজে দিয়ে হাঁটা ধরলাম। হাঁটছি আমি। কিন্তু জানি আমি রুপাদের বাসার সামনে যাবোনা। রুপাও জানে আমি যাবনা। তবুও সে ওর গাঢ় নীল শাড়ীটা পরবে। চুলে চুপচুপ করে তেল দিবে। দু’হাতে বারান্দার গ্রিল আঁকড়ে ধরে দাঁড়াবে। আর আমি হাঁটতেই থাকবো। যদিও এই হাঁটার উদ্দেশ্যে বা শেষ কোনোটাই আমার জানা নেই!