রঙের জীবন

সেরা গল্প : নুরবানু || ইমাম হোসাইন

নুরবানু

✍ ইমাম হোসাইন

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে নজির মিয়া ভালবেসে বিয়ে করেছিলো নুর বানুকে। অনেক ধুমধাম করে তাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়। তখন ছিলো  গরম কাল, কিন্তু তাদের বিয়ের সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। একটানা সাত দিন বৃষ্টি ছিলো!

 

বাসর রাতে নুর বানু একলা রুমের মধ্যে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর নজির মিয়া রুমে প্রবেশ করেছে। নুর বানু তার স্বামীকে সালাম করে খাটের উপর বসে আছে। দুইজন দুইজনের দিকে এক পলকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে।।

 

প্রথমে তাদের বিয়েতে কেউ রাজি ছিলো না,কারণ নুর বানু দেখতে কালো। তার বাবা একজন দিন মজুর। তাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিলো।

নজির মিয়া দেখতে খুব সুন্দর। তার বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং নামকরা একজন চেয়ারম্যান। তাদের কোন কিছুর অভাব ছিলো না।।

 

নজির মিয়া একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে প্রায় এক মাস থাকার পর একটু সুস্থ হয়। ডাক্তার বলেছে, নজির মিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেন কোন কাজ করা না হয়। ডাক্তারের কথা শুনে নজির মিয়ার বাবা বিয়েতে রাজি হয়েছিলো।

 

হঠাৎ বিকট শব্দ করে বজ্রপাত শুরু হলো, নুর বানু একটু ভয় পেয়ে নজির মিয়ার হাত ধরলো। সেইদিন বাসর রাতে নজির মিয়া তার স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলো, জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে তার পাশে থাকবে। কোনদিন তার মনে কষ্ট দিবেনা।।

জীবনের চল্লিশটা বছর কিভাবে পার হয়ে গেলো কেউ টের পেলো না। চোখ বন্ধ করলে নজির মিয়ার মনের আঙ্গিনায় ভেসে উঠে অতীতের সব স্মৃতি!!

 

আজ তিন দিন ধরে নুর বানু হাসপাতালে, বয়সের কারণে অনেক রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। নুর বানু অনেক শুকিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার মুখের হাসি। হাসপাতালের তিন তলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালায় দিয়ে এক পলকে তাকিয়ে আছে নজির মিয়া।।

 

বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, একটু একটু ঠান্ডা বাতাস। বৃষ্টির সময় নুর বানু চায়ের সাথে চাউল ভাজা খেতে খুব পছন্দ করতো, আর লুডু খেলার প্রতি ছিলো প্রবল নেশা। নজির মিয়ার খুব মন চাচ্ছে, নুর বানুর সাথে লুডু খেলতে, আর চায়ের সাথে চাউল ভাজা খেতে!!

নজির মিয়া অনেক রাত ঘুমাতে পারেনি, বারান্দায় এক কোণায় শুয়ে আছে। বার বার মনে পড়ছে, নুর বানুকে নিয়ে অতীতের অনেক স্মৃতি।।

 

হঠাৎ নার্স এসেছে নজির মিয়ার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে নার্স বললো, আপনার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। আপনি একটু তার পাশে থাকেন।।

নজির মিয়ার বেডের পাশে বসে নুর বানুর দিকে তাকিয়ে আছে, নুর বানু ইশারায় একটু বুকে নেওয়ার জন্য বললো। অনেক শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নজির মিয়া বলতেছে, কিছু হবে না। তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। নুর বানুর কোন সাড়া শব্দ নেই। নজির মিয়ার বুকের মধ্যে খুব আরামে ঘুমাচ্ছে নুর বানু। শত চেষ্টার পর ও আর ঘুম থেকে জাগাতে পারেনি। নুর বানু চলে গেছে না ফেরার দেশে!

 

নজির মিয়া চিরকুটটি পড়ার জন্য হাতে নিলো, অনেক সুন্দর করে নুর বানু লিখেছে, আজ আমাদের ৪০ তম বিবাহ বার্ষিক। প্রত্যেক বার কত আনন্দ করে দিনটা পালন করি। আমি জানি, তুমি এই দিনে গরম ভাতের সাথে শুটকি ভর্তা, আর ডাল খেতে খুব ভালোবাস। কিন্তু আমি আজ পারলাম না, আমাকে মাফ করে দিও। আমি না ফেরা দেশে চলে গেছি, তুমি চাইলে রোজ আমার সাথে দেখা করতে পারো। প্রতিদিন সকালবেলা আমাকে একটু দেখতে আসিও। ভালো থেকো, নিজের প্রতি যত্ন নিও!

নুর বানু মারা গেছে আজ তিন দিন। নজির মিয়ার জীবনে অনেক বার কালবৈশাখী ঝড় এসেছিলো। তখন নুর বানুকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে কোন মতে সামলে নিয়েছিলো। তারা দুইজনে মিলে খুব সুন্দর করে, তাদের সংসারটা সাজিয়েছিলো। নুর বানুর হঠাৎ মৃত্যুতে নজির মিয়ার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো, কিছু খোঁজে পাচ্ছে না আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্য!

এই তিন দিন নজির মিয়া কিছু খায়নি, একটু ভালো করে ঘুমাইনি। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ছে। অথচ নজির মিয়া একবেলা ভাত না খেলে নুর বানু দুই বেলা ভাত খেতো না। নজির মিয়া আগে না ঘুমালে নুর বানু ঘুমাতো না!!

 

এই তিন দিনে বাড়ির পরিবেশটা কেমন অগোছালো হয়ে গেলে। বাড়ির চারপাশে শুকনো পাতা পড়ে আছে, নুর বানু প্রতিদিন দুইবার উঠান ঝাড়ু দিতো। বাগান করা ছিলো, নুর বানুর শখ। পুকুর পাড়ের লাউ গাছটা শুকিয়ে মৃত প্রায়। অথচ সাত দিন আগে লাউ গাছটা কত সজিব ছিলো!

আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে, নুর বানু তার বাপের বাড়ি থেকে ছোট্র একটা কুকুরের বাচ্ছা এনেছিলো। আদর করে কুকুরের বাচ্ছাটাকে লালী বলে ডাকতো। আম গাছের নিচে লালী বসে আছে, সেই ও তিন দিন ধরে কিছু খায়নি। লালীর চোখের কোনায় থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। নুর বানু হঠাৎ চলে যাওয়াতে লালী অনেক কষ্ট পেয়েছে, লালীর নিরবতাই একমাত্র প্রমাণ!!

 

নজির মিয়া ১৫ বার কবরস্থানে গিয়ে নুর বানুর সাথে দেখা করেছে। নুর বানু আমাকে মাফ করে দিও, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম সারা জীবন তোমার সাথে থাকবো, কিন্তু তুমি বড় অভিমানী। আমার উপর রাগ করে, আমাকে একা ফেলে তুমি খুব আরামে ঘুমাচ্ছে। ভয় পেয়েও না, আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে আসছি, তোমাকে ছাড়া যে আমি একেবারে অচল। শ্রাবনের বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে নজির মিয়ার চোখ থেকে। তার কেউ নেই, চোখের পানি মুছে দেওয়ার জন্য!!

 

রাত দশটা, নজির মিয়া জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাহিরে দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে, আজ চাঁদের আলোয় নজির মিয়ার ঘরটা আলোকিত হয়ে গেছে। নুর বানু চাঁদনী রাতে পুকুর পাড়ে নজির মিয়ার কোলে মাথা রেখে কবিতা বলতো। আজ নজির মিয়ার খুব মন চাচ্ছে, নুর বানুর কবিতা শুনতে!!

টেবিলের উপর পড়ে আছে, নুর বানুর ডায়েরি। নুর বানুর হাতের লেখা খুব সুন্দর। প্রতিদিন সেই ডায়েরিতে লিখতো। নুর বানু একদিন বলেছিলো, যেদিন আমি থাকবো না,সেইদিন ডায়েরি টা ধরবে। এর আগে কোনদিন ডায়েরি টা ধরার চেষ্টা করবেনা।।

 

আজ নুর বানু নেই, ডায়েরিটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে তার পুরা দেহটা কেঁপে উঠলো। ডায়েরির প্রথম পাতায় লিখা আছে………..

যদি কখনো রাতের আকাশে চাঁদের সাথে একটা তারা মিটিমিটি করে জ্বলে, মনে করবে সেইটা আমি, তোমার অপেক্ষায় বসে আছি!

যদি কখনো দক্ষিণা বাতাস জানালা দিয়ে প্রবেশ করে, মনে করবে সেইটা আমি। তোমাকে স্পর্শ করার জন্য বাতাস হয়ে এসেছি।।

 

যদি কখনো নিশি রাতে কোন নিশাচর প্রাণী বেদনার শীষ দেয়, মনে করবে সেইটা আমি তোমার অপেক্ষায় যন্ত্রণায় ছটফট করছি!!

ডায়রির শেষ পাতার লেখা গুলো দেখে, নজির মিয়া পাথর হয়ে গেলো। তিন কালারের কলম দিয়ে তিনটা বাক্য লিখা ছিলো!

লাল কলম দিয়ে লেখা, আমি তোমার জীবন রাঙ্গাতে পারিনি!!

 

নীল কলম দিয়ে লেখা, নীল হলো বেদনার প্রতীক। আমি তোমার জীবনটা নীল দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছি। আই এম সরি!

কালো কলম দিয়ে লেখা, আমি তোমার জীবনটাকে অন্ধকারে রেখে স্বার্থপরের মতো একা চলে আসছি! আমাকে মাফ করে দিও!!

 

নজির মিয়া চল্লিশ বছর পর, আজ বিছনায় একা শুয়ে আছে। বিছানায় দুইটা বালিশ। একটাতে নজির মিয়া শুয়ে আছে অন্যটা ফাঁকা। নুর বানু প্রতি রাতে খুব সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু চোখের পাতা এক হচ্ছে না। চাপা আর্তনাদ, আর পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে নজির মিয়া আজ দিশেহারা।।