অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। দলটির শীর্ষ নেতারা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর জামায়াত এখন জীবন্মৃত দল। এই ধারণা থেকে জামায়াতকে এখন কোন কোন রাজনৈতিক দল ও নেতা বাংলাদেশের জন্য আর বিপজ্জনক মনে করেন না। এতবার দাবি তোলা সত্ত্বেও বিএনপি যে এখনও জামায়াতের গলগ্রহ হয়ে আছে কোন কোন নেতা তাকেও গুরুত্ব দেন না।
এটাকে গুরুত্ব দিলে ড. কামাল হোসেনের মতো সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং আসম আবদুর রবের মতো মুক্তিযুদ্ধের একজন যুবনেতা জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ বিএনপিকে নিয়ে তথাকথিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে পারতেন না। এখন দেখা যাচ্ছে বিএনপির সাবেক নেতা এবং বর্তমানে লিবারেল পার্টির প্রধান কর্নেল (অব.) অলিও বর্তমান জামায়াতের চরিত্র বদল সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিয়ে নিজের নবগঠিত ঐক্যফ্রন্টে তাদের টানতে চাচ্ছেন।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভগ্নদশা দেখার পরও কর্নেল অলি আবার একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন অথবা গঠন করতে যাচ্ছেন। কথায় বলে ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।’ কর্নেল অলির নতুন ঐক্যফ্রন্ট গঠনও অনেকটা তদ্রুপ। প্রকাশ্যে বিএনপিকে এবং অপ্রকাশ্যে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে যেখানে বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা পায়ের তলায় মাটি পাননি, সেখানে কর্নেল অলির মতো এক হাফ নেতা কি করবেন?
তাছাড়া তার ঐক্যফ্রন্ট বা যুক্তফ্রন্টের বিশেষত্ব বা নতুনত্বইবা কি? এই ফ্রন্টে বিএনপি সম্ভবত থাকবে। জামায়াতকেও রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন কর্নেল অলি। আর থাকবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধিকাংশ শরিক দলই। হয় তো থাকবেন না ড. কামাল হোসেন। এবার তিনি ডাঃ বদরুদ্দোজার মতো পরিত্যক্ত হবেন। তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এটা নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢোকানো ছাড়া আর কিছুই হবে না।
যা হোক, এ প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি ঢাকার আরেকটি দৈনিকে বিশদ আলোচনা করেছি। এখন জামায়াত প্রসঙ্গে আসি। কর্নেল অলি বলেছেন, ‘বর্তমান জামায়াত আর অতীতের জামায়াত এক নয়।’ অর্থাৎ অতীতের জামায়াত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের গণহত্যার দোসর। বর্তমান জামায়াত তা নয়। তারা ধোয়া তুলসিপাতা হয়ে গেছে।
কর্নেল অলি নিজেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাজনৈতিক জীবনে ঢোকার পর মূলত জামায়াতীদের চক্রান্তে বিএনপি ছাড়তে বাধ্য হন। বিএনপির প্রতি তার আনুগত্য এখনও আছে। তা থাকুক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু অঘটন-ঘটিয়সী দল জামায়াতকে তিনি কি করে তুলসিপাতার সার্টিফিকেট দেন তা বিস্ময়কর! তার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার এই মতিভ্রম কি করে ঘটে?
সাপ বার বার খোলস পাল্টায়, কিন্তু স্বভাব ও চরিত্র পাল্টায় না। একথা জামায়াতের মতো ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলোর জন্য খুবই সত্য। প্রতিবেশী ভারতে আমরা কি দেখি? উগ্র ধর্মান্ধ দল হিন্দু মহাসভা গান্ধী হত্যাকা-ে জড়িত হওয়ার পর ভারতে নিষিদ্ধ হয়। এই হিন্দু মহাসভাই বার বার খোলস পাল্টে বর্তমান বিজেপিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু তার চরিত্র পাল্টেছে কি? ৭২ বছরের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে পদদলিত করে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতা দখল রোখা গেছে কি?
ভারতকে তথাকথিক রামরাজ্যে পরিণত করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়গুলো নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। সাভারকরের মতো হিন্দু মহাসভার এক নেতার ছবি জাতির পিতা মহাত্মাগান্ধীর ছবির পাশে টানানো হয়েছে। গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে জাতীয় বীর আখ্যা দিয়ে সম্মান জানানো হচ্ছে। যে জহরলাল নেহরুকে বলা হয় আধুনিক ভারতের স্রষ্টা, তার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী নেতা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে গুজরাটে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত রাস্তাঘাট, শহরের নাম পাল্টে দেয়া হচ্ছে।
বর্তমান বিজেপির কার্যকলাপ দেখে কি মনে হবে অতীতের কিছুমাত্র পার্থক্য ঘটেছে? বাংলাদেশেও জামায়াতের চরিত্রে ও রাজনীতিতে আমরা কি দেখি? স্বাধীনতা যুদ্ধের তারা শত্রুতা করেছে। গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। ভারতে হিন্দু মহাসভার মতো বাংলাদেশে তারা নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সামরিক ডিক্টেটর জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ওঠে যায়। তারা স্বাধীন বাংলাদেশে চরিত্র বদল করে রাজনীতিতে নামেনি। ৩০ লাখ বাঙালী নর-নারী হত্যা এবং ৪ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি এবং অন্তত কয়েক হাজারকে নির্যাতন ও হত্যার বর্বরতায় অংশগ্রহণের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি।
তাদের রাজনীতি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর নিরন্তর এই স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার আদর্শগুলো হত্যার জন্য সন্ত্রাস ও হত্যার পথ অনুসরণ করা। জাতির পিতা নিহত হওয়ার পর জামায়াত নেতা গোলাম আযম প্রকাশ্যে উল্লাস প্রকাশ করেন। সউদি অর্থ এবং পাকিস্তানের সামরিক ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সহায়তায় জামায়ত ধর্মীয় রাজনীতির নামে যা করেছে তা ভয়াবহ সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। তাদের একাত্তরের ভূমিকার চাইতে তা কম নৃশংস নয়।
জামায়াত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত বদলাতে চেয়েছে। রাজপথে স্লোগান দিয়েছে, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ বাংলাভাইদের মতো নিষ্ঠুর সন্ত্রাসী এবং অসংখ্য সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল। একদিনে তারা দেশের ৬৩ স্থানে হামলা চালিয়েছিল। মসজিদ মাদ্রাসাগুলো দখল করে সেগুলোকে জিহাদিস্ট নামের সন্ত্রাসীদের রিক্রুট ও ট্রেনিং দানের গোপন আড্ডা বানিয়েছিল। মুক্তচিন্তার তরুণ ব্লগার হত্যা, বিদেশী নাগরিক হত্যাও ছিল তাদের কাজ। শেখ হাসিনা কঠোর হাতে তাদের দমন না করলে বাংলাদেশ এখন হতো আরেক মৃত্যু উপত্যকা।
কর্নেল অলি অতীতের জামায়াতের সঙ্গে বর্তমানের জামায়াতের পার্থক্য কোথায় দেখলেন আমি জানি না। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে অতীতের জামায়াতের চাইতে বর্তমানের জামায়াত আরও ভয়ঙ্কর। অতীতের জামায়াতের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল শুধু উপমহাদেশে। এখন জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিস্তার ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে তার যোগাযোগ।
তার অর্থের অভাব নেই। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্যের বিরাট নেটওয়ার্ক মুসলিম দেশগুলোজুড়ে। এসব দেশের মিডিয়াতেও তাদের বিরাট প্রভাব বিস্তৃত। ব্রিটেনে ও আমেরিকায় ধর্মপ্রচারের আড়ালে জামায়াতী প্রোগা-া চালানোর অসংখ্য প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। দু’চারজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দিয়ে এই দলকে সাময়িকভাবে কাবু করা যাবে, স্থায়ীভাবে কাবু করা যাবে না।
বাংলাদেশে ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেয়ার ফলে জামায়াত সাময়িকভাবে কাবু হয়েছে, বিলুপ্ত হয়নি। তারা এখন আন্ডার গ্রাউন্ডে নিজেদের শক্তি সংহত করছে। বিএনপি নেতারা তা জানেন। তাই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে চাচ্ছেন না। ত্যাগ করার ভান করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিন্ন করেননি। আওয়ামী লীগের ভেতরেও জামায়াতীদের বিপুল অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচাইতে বড় শত্রু জামায়াত। বিশ্ব জোড়া ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যার এখন গভীর যোগাযোগ। এদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যেমন সতর্ক থাকা উচিত, তেমনি দেশের সকল গণতান্ত্রিক দলের উচিত এই সাপের খোলস বদল দেখে বিভ্রান্ত না হওয়া। তাদের দুর্বল ভেবে অনুকম্পা না দেখানো। কর্নেল অলির যুক্তফ্রন্টও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পরিণতি বরণ করবে তাতে সন্দেহ নেই। তবু তাকে অনুরোধ করি, জামায়াতকে অনুকম্পা দেখানো থেকে তিনি বিরত হোন।
আপনার মন্তব্য লিখুন