শেষপর্যন্ত ঠিকানাটা সাব্বির খুঁজে পেলো।
দরজায় দাঁড়িয়ে সে কলিংবেল চেপে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিকানা খুঁজে পেতে তার বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে। সেইসাথে দীর্ঘ ক্লান্তিতে শরীর নুইয়ে পড়ছে। গত কয়েকদিন ধরেই সে বাইরে বাইরে ঘুরছে।
তার ছুটির আজই শেষ দিন। এই এক সপ্তাহ সে নানান জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। সব জায়গায় কাজ সারার পর আজ এই ঠিকানাটাই তার শেষ গন্তব্যস্থল। আল্লাহ্র কৃপায় ভালোয় ভালোয় কাজটা শেষ হলেই হয়। এইসব ভাবতে ভাবতে সে আবার কলিংবেলে চাপ দিল।
আচমকা ঝড়ের বেগে দরজা খুলে গেলে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! দরজায় চোখ পড়তেই নিমিষেই চোখ নামিয়ে ফেলল সাব্বির। বুকটা ধক! করে উঠল তার। যেন দরজায় বিদ্যুতের বজ্রপাতের আলোকরশ্মি দেখতে পেল সে।
নিজেকে সংযত করে চোখ নামিয়ে রেখেই জিজ্ঞাসা করলো –
– এটা কি মিসেস রেহনুমার বাসা?
– হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?
– আমাকে আপনি চিনবেন না। উনাকে বলুন উনার বান্ধবী রোখসানার ছেলে এসেছে। চোখ নিচে রেখেই সাব্বির কথা বলছিল। যা মেয়েটিকে অসস্তিতে ফেলে দেয়। অগত্যা মেয়েটি বলে,
-ভিতরে আসুন। এই বলে মেয়েটি ভিতরের দিকে চলে যায়। যদিও একবার ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে- বসুন আমি আম্মাকে ডেকে আনছি। কিন্তু চোরা চোরা হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কোথাকার কোন খ্যাত!
কয়েক পা দেওয়ার পর মেয়েটির মাথায় বিদ্যুত ছুঁয়ে গেল! রোখসানা আন্টির ছেলে! ইচ্ছে হচ্ছিল তার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে একবার দেখবে। কিন্তু তার আগেই মায়ের গলা পাওয়া গেল।
– কে রে বিন্তি? এই বলে তিনি নিজেই বসার ঘরে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ঘরে একটি দাড়িঅলা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি মাথার কাপড় ঠিক করে নিলেন।
রেহনুমা খালাকে দেখেই সাব্বির সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
– কে তুমি বাবা?
– মা উনি রোখসানা আন্টির ছেলে। বিন্তি নিজেই পেছন থেকে জবাব দিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াল।
– কীহ! তুমি রোখসানার ছেলে! মহিলা যেন বিশ্বাসই করতে চাইছেন না এই ছেলে সেই ছোট্ট সাব্বির।
– জ্বী খালাম্মা। আমি আপনার বান্ধবীর ছেলে সাব্বির।
– তোমাকে সেই ছোট বেলায় দেখেছি। আজ কত বছর হয়ে গেল। বলতে বলতে মহিলার চোখ ভেজে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
– রোখসানা কেমন আছে? এই প্রশ্নে সাব্বিরের চেহারা মলিন হয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিল,
– আম্মা গত মাসে মারা গেছেন।
কী বললে তুমি? রোখসানা আর নেই! …… কখন কীভাবে? হঠাৎ শোকে মহিলা নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। বিন্তি মাকে জড়িয়ে ধরে। কিছু নিরবতার পর মহিলা বলতে লাগলো,
– তার সাথে শেষ দেখাটা আর হলো না। কত আশা ছিলো মৃত্যুর আগে হলেও তার সাথে একবার দেখা হবে। এই বলে রেহনুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
– আম্মারও খুব ইচ্ছে ছিলো আপনার সাথে দেখা করার। বাবার মৃত্যুর পর আম্মার উপর অনেক ধকল গেছে। সবকিছুই হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আপনাদের আগের ঠিকানাতেও আম্মা যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু আপনারা সেখানে ছিলেন না। যেকারণে যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
– সরকারি চাকুরির পরিবারদের এই এক অসুবিধা। আজ এখানে তো কাল ওখানে। মাঝে মোবাইলে যে যোগাযোগ ছিলো, সেটাও মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার কারণে আর হয়ে উঠেনি।
– আসলে খালাম্মা দোষটা আমারই। মা অনেকবার বলেছে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। আমি কিছুটা চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেই। বলতে গেলে নানান চাপে মায়ের ইচ্ছাটাকে গুরুত্ব দেইনি। যেকারণে মায়ের শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ করতে পারিনি। এই কথায় সাব্বিরের অনুশোচনা ফুটে উঠে।
– আসলে আমাদের জীবনটা এমনই। সবসময় সবকিছু পাওয়াও যায় না, গুরুত্বও বুঝা যায় না। এই বলে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যা সরাসরি সাব্বিরের বুকে লাগে। কেননা সে চাইলে এখন যেভাবে ঠিকানা বের করেছে। তখনও কিছু চেষ্টা করলে এই দুই বান্ধবীর একটা যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারতো।
কিন্তু তখন তার জ্ঞানের জন্ম হয়নি। যে জ্ঞানের ঠিকানা সে মাত্র কিছুদিন আগে পেয়েছে। তার মায়ের অসুস্থতার পর থেকেই ধরতে গেলে সাব্বিরের পরিবর্তনটা এসেছে। যে ছেলের দ্বীনের চাইতে দুনিয়া প্রিয় ছিলো, সে ছেলে মায়ের মর্যাদা কখনোই বুঝতে পারেনি।
যখন সত্যিই মায়ের চলে যাওয়ার সময় হলো, তখনই সে অনুধাবন করতে পারলো মা কী জিনিস। আর এই শূন্যতাই তাকে রবের কাছাকাছি নিয়ে আসল কোন এক দাঈর হাত ধরে।
আজ সে মায়ের ইচ্ছাপূরণ করতে এবং মায়ের কবরে শান্তি পৌঁছাতেই এখানে এসেছে। সে জেনেছে মা বাবার কবরের শান্তির জন্য, মৃত্যুর পর তাদের বন্ধু বান্ধবদের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে রাসুলের (সা.) সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন একজন সন্তানের সর্বোত্তম আমল হচ্ছে, পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের অবর্তমানে তার সকল প্রিয়জনদের খোঁজ খবর নেওয়া। এবং তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা।
আজ এখানেই তার শেষ যাত্রা। মায়ের দেওয়া কিছু উপহার নিয়ে এসেছে সে। যা তাদের বন্ধুত্বের প্রতীক। এই উপহার পেয়ে রেহনুমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে প্রিয় সখীর জন্য। বিন্তি মাকে শান্তনা দিতে জড়িয়ে ধরে। কেননা সেও হাজার গল্প শুনেছে তার রোখসানা খালার।
শুধু তাইনয় তার জন্মের পর যখনই রোখসানা খালা তাকে দেখে, তখনই নাকি একটি প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতির স্মৃতি নিয়েই হাজারো স্বপ্ন দেখেছিল বিন্তি! যা পৃথিবীর কেউ জানে না।
সাব্বির তার একটা কার্ড টেবিলে রেখে শান্ত মৃদু পায়ে চলে আসে। এখানে শোকের যে অশ্রুধারা বইছে, সেখানে তার থাকাটা বেমানান। রেহনুমা রোখসানার দেওয়া উপহারে বার বার ফিরে যাচ্ছে অতীতে। যেখানে এই বর্তমানটা অন্তঃসারশূন্য।
(সূত্র: সহিহ্ মুসলিম ৬৪০৭, ৬৪০৮, ৬৪০৯, তিরমিজি ১৯০৩,)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম
আপনার মন্তব্য লিখুন