ওয়েটিং রুমে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ডাক পড়লো, “সিরিয়াল ২৯”
সন্তানকে নিয়ে সাজ্জাদ সাহেব ডাঃ শহীদুল ইসলামের রুমে প্রবেশ করলেন
– “বয়স কতো ওর ?”
– “২০”
– “জন্মের পর থেকেই কী ও এমন ?”
– “জ্বী না, স্যার”
– “কখন থেকে ওর এই অবস্থা ?”
– “তিন বছর থেকে । একবার ওর অনেক জ্বর আসলো, মাসখানেক থাকলো সেই জ্বর । সেই জ্বর থেকেই ওর এই অবস্থা, জ্বর সারলো ঠিকই কিন্তু আমার ছেলেটা কেমন জানি হয়ে গেলো । ঠিকমত কথা বলতে পারতো না, ঠিকমত হাঁটতেও পারতো না ।”
– “তখন ডাক্তার দেখান নি ?”
– “ওর অস্বাভাবিক চালচলন দেখামাত্রই ডাক্তার দেখিয়েছিলাম । ডাক্তার তো তখন কিছু ওষুধপত্র দিয়ে বলেছিলো বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে , ঠিক তো হলোই না, দিন যতোই গেলো ওর অবস্থা ততোই খারাপ হতে লাগলো ।”
কথাগুলো শুনতে শুনতে ডাঃ শহীদুল ইসলাম টর্চের আলো দিয়ে ওর চোখ এবং নাক দেখলেন । জিহ্বা দেখার জন্য ওকে হাঁ করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন । সাজ্জাদ সাহেব খুব আদুরে অভিব্যক্তি নিয়ে ওকে হাঁ করালেন । চশমাটা নাকের ডগায় আরেকটু টেনে টর্চের আলোতে ডাঃ সাহেব ওর অপরিষ্কার জিহ্বাটা পর্যবেক্ষণ করলে।
টেবিলের উপর রাখা রিপোর্টগুলোর দিকে এবার চোখ রাখলেন ডাঃ শহীদুল ইসলাম ।
ওর নাম শিমুল , একজন সুপার বেবী (প্রতিবন্ধী) । সাজ্জাদ সাহেবের এক মেয়ে আর দুই ছেলের মধ্যে শিমুলই সবার ছোট । বেশ কয়েকটা গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রিরসহ গ্রামে গরুর ফার্ম আর কয়েক বিঘা দো-ফসলি জমি আছে সাজ্জাদ সাহেবের , বাবার সম্পত্তির উপর ভর করে কঠোর পরিশ্রম করে সৎ ভাবেই এতোকিছু গড়েছেন তিনি, তবুও তার দুঃখের শেষ নেই । প্রতিটা দিন আর প্রতিটা রাতই তার ভাবনায় কাটে, কী অপরাধ তিনি করেছিলেন যার জন্য খোদা তাকে এই শাস্তি দিয়েছেন । শিমুলকে এ পর্যন্ত বহু ডাক্তার দেখিয়েছেন, কবিরাজদের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ নিয়েছেন, হুজুরদের কাছ থেকে পানি পড়া নিয়েছেন, পরিচিত-অপরিচিত যে যা বলেছে তাই করেছেন … তবুও ওর কোনো পরিবর্তন হয় নি ।
সাজ্জাদ সাহেব তার মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন ভালো ছেলে দেখেই, পাত্রস্থ করে তিনি বেশ খুশীই হয়েছিলেন কিন্তু এখন তার মেয়ে, জামাই আর নাতি-নাতনি কেউই বছরে একবারো আসে না তার বাড়িতে শিমুলের জন্য । ওকে দেখে নাকি ওদের বাচ্চারা খুব ভয় পায় । ছেলেটাও বিয়ে করেছে নিজের পছন্দেই , ছেলের পছন্দে আপত্তি করেন নি বাবা । কিন্তু বিয়ের পর পরই ছেলের বউ স্বামীকে সাফ জানিয়ে দিলো, “তোমার ঐ পাগল ভাইয়ের সাথে এক বাড়িতে থাকা অসম্ভব” । স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে বড় ছেলে সাজ্জাদ সাহেবকে তার উজ্জ্বল ভবিষৎ এর কথা এবং শিমুলের প্রতি তার স্ত্রীর কিঞ্চিৎ আপত্তির কথা বললো । সবকিছু বুঝতে পেরে সাজ্জাদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাদের আলাদা হয়ে যাবার অনুমতি দিলেন । বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করে ছেলে দোয়া চাইলো … অন্যদিকে তাকিয়ে ছেলের মাথায় হাত রেখে প্রাণভরে দোয়া করে দিলেন সাজ্জাদ সাহেব ।
বার্ধ্যকে পৌঁছে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন সাজ্জাদ সাহেব ও তার স্ত্রী । তাদের মৃত্যুর পর কে দেখভাল করবে শিমুলের সেই চিন্তাতেই এখন সময় কাটে তাদের । তবে যে ওর দেখভাল করবে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও করে রেখেছেন তিনি । উত্তরাধিকার সূত্রে শিমুল যতোটুকু সম্পত্তি পেতো, তার চেয়ে বেশী সম্পত্তিই লিখে দেয়া হয়েছে ওর নামে । এখন শুধু একটা মেয়ে খুঁজছে তারা … হোক সে গরীর, কালো কিংবা খাটো , কোনো আপত্তি নেই তাদের ।
ডাঃ শহীদুল ইসলাম রিপোর্টগুলো দেখছেন । শিমুল উ-উ-আ শব্দ করে তার অস্বস্তির জানান দিচ্ছে । অপরিচিত স্থানে বেশীক্ষণ থাকতে চায় না ও । শিমুলের অস্থিরতা বেড়েই চলছে । দু-একবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলো, বাবার হাতের টানে বসে পড়েছে আবার । বেশী অস্থির হওয়ায় দু হাতের আঙুল বাকা করে টানাটানি করতে লাগলো । তারপর আঙুল মুখে দিয়ে আইসক্রিমের মতো চুষতে লাগলো, মুখ দিয়ে লালা পড়তে লাগলো ওর । সাজ্জাদ সাহেব টিস্যু দিয়ে মুখের লালা মুছে দিলেন । শিমুল কপাল কুঁচকে বা হাত দিয়ে মাথার পেছনের চুলগুলো টানতে লাগলো ।
.
ছোট একটা কাশি দিয়ে সাজ্জাদ সাহেব ডাঃ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,
– “স্যার, ছেলেটা বড় অস্থির হয়ে গেছে । এ অবস্থায় ওর মাকে দরকার, ওর মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দু-চারটা কথা বললেই ও শান্ত হয়ে যাবে ।”
– “ওর মা কোথায় ?”
– “চেম্বারের বাইরে বসে আছে স্যার”
– “সে কী ! উনাকে ভেতরে নিয়ে আসেন নি কেনো ?”
– “ওর মা ভেতরে আসতে চায় নি । ওর মা খুব সহজ সরল, যখন শুনছে দেশের সবচেয়ে বড় ডাক্তার যার সিরিয়ালই কখনো পাওয়া যায় না, দেশে বিদেশে যার হাতে অনেক রোগী ভালো হয়েছে … সে যখন আমাদের শিমুলকে দেখতেছে , তখন আমাদের শিমুল ভালো হবেই । চেম্বার থেকে বের তাকে যেনো এই সুসংবাদটা দিতে পারি সেজন্য সে বাইরে বসে আল্লার দরবারে দু হাত তুলে মোনাজাত করছে ।”
.
সাজ্জাদ সাহেবের কথাগুলো শুনে অনেক বছর পর শরীরের পশমগুলো শিউড়ে উঠলো ডাঃ সাহেবের । এখনো পর্যন্ত কতো জটিল রোগী দেখেছেন তিনি, কতো জটিল রোগের সমাধান দিয়েছেন কিন্তু আজ কেমন যেনো অসহায় ভাবছেন নিজেকে ।
অন্যান্য ডাক্তারের মতো আজও কি বিভিন্ন টেস্ট দিবেন তিনি ? নাকি শোনাবেন সেই মিথ্যে আশার বাণী, “একদম চিন্তা করবেন না, ও সুস্থ হয়ে যাবে” ।
চেয়ারে ঢেলান দিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন ডাঃ শহীদুল ইসলাম …
আপনার মন্তব্য লিখুন