রঙের জীবন

মুখোমুখি ঋতুপর্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

সবুজ খন্দকার:

 

চলচ্চিত্র: জীবন স্মৃতি

পরিচালক: ঋতুপর্ণ ঘোষ

কলাকুশলী: সমদর্শী দত্ত, সঞ্জয় নাগ, রাইমা সেন

দেশ: ভারত

সাল: ২০১৩

রেটিং: ৩.৫/৫

এক দারুণ ব্যাপার। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়িতে। ঠাকুর বাড়ির থামের পাশে উঁকি দিয়ে কী যেন দেখলেন? কাকে দেখছেন তিনি? রবীন্দ্রনাথকে? হ্যাঁ তাই তো। ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ। হাঁটছেন ঠাকুর বাড়ির বারান্দা দিয়ে। তাকিয়ে দেখছেন এদিক ওদিক। বাড়ির খিলান। ছাদের ঘুলঘুলি। কিশোর বয়সের ছবি ছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছবি পাওয়া দুষ্কর। তাই এই রবীন্দ্রনাথ ধরা দিলেন ঋতুপর্ণের একেবারেই কল্পনা থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৈনন্দিন কাজ নিয়ে লিখেছিলেন জীবনস্মৃতি। তাকে রূপালি পর্দায় পাঠের দায়িত্ব পড়ল ঋতুর ওপর। ঋতু শুধু পড়লেন না। নিজের কলমের কালি দিয়ে আঁকলেন রবীন্দ্রনাথকে।

 

আমরা যারা নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষকে চিনি, তারা জানি, আজীবন সম্পর্ক নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন তিনি। আমি বিশ্বাস করি, যারা সত্যিকারের চলচ্চিত্রকার, তাঁরা তাদের প্রত্যেকটি ছবিতে নিজের জীবনীই তৈরি করে। ঋতুপর্ণ ঘোষ আজীবন সম্পর্কের টানাপোড়েনে ছিলেন। তাই তাঁর ছবিগুলোও সম্পর্কের বাইরে যায় না। জীবনম্মৃতি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। ওর মধ্যেও ঋতু টেনে আনলেন সেই সম্পর্কই। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিবারের লোকের সম্পর্ক, বৌদির সঙ্গে সম্পর্ক, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক, প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্ক, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক সবশেষ তাঁর আজীবনের সঙ্গী সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক।

প্রামাণ্যচিত্র ভাবলেই মনে হয় যেন গুরুগম্ভীর কোনো কিছু। কিংবা বাস্তব জিনিসের ছবি। কিন্তু ঋতুপর্ণ ফিকশন ও ননফিকশনের আড়ালে রবীন্দ্রনাথকে আঁকলেন। তাই সিনেমাটি কাহিনিচিত্র নাকি প্রামাণ্যচিত্র তা অস্পষ্ট থেকে গেল। প্রামাণ্যচিত্রেও পরিচালকের ফ্রেমের মধ্যে ঢুকে যাওয়া খুব চোখে পড়ে না। আর এখানে ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথকেই যেন খুঁজছেন ঠাকুর বাড়ির অন্দরে, অলিতে গলিতে। আর ঠাকুর বাড়ির কোনায় কোনায় লেপ্টে থাকা রবীঠাকুরের স্মৃতি একদম তাজা হয়ে উঠছে। ঋতুপর্ণ যেন দেখতে পাচ্ছেন, ওই যে রবীন্দ্রনাথ মনযোগ দিয়ে লিখছেন। ঋতুর পাশে আছে ক্যামেরাওয়ালা। তাঁকে ইশারা করছেন, শব্দ যেন না হয়, লেখায় ব্যাঘাত ঘটবে। এমন নাটকীয়তায়ও পরিপূর্ণ এই ছবি। এই গল্পবলার ভঙ্গি দিয়েই ঋতু বুঝিয়ে দিয়েছেন। মশায়, এটা রবীন্দ্রনাথের ওপর কোনো বাঁধাধরা প্রামাণ্যচিত্র নয়, এটা ঋতুর চোখের রবীন্দ্রনাথ।

নান্দনীকতা, গল্প বলার ভঙ্গী, কারিগরী দিক নিয়ে আমি খুব একটা কথা বলতে চাই না। আমার কাছে মনে হয় ও অন্য জিনিস। ওগুলো নিয়ে আলাদা করে বলা যায় অন্য আসরে। কোনো ছবি দেখার পরে যে উচ্ছ্বাসটুকু মনে থাকে। এই লেখায় শুধু এইটুকুই থাক।