আসোয়াদ লোদি:
বাংলাদেশের এক কবি সেলফোনকে আদর করে ডেকেছিলেন মুঠোফোন বলে । মোবাইল ফোন কিংবা মুঠোফোন যে নামে ডাকি না কেন, আমাদের হাবলুর খুব শখ একটি মোবাইল ফোন কেনার । কিন্তু মোবাইল সম্পর্কে তার জ্ঞান একেবারে শূন্যের কৌটায় । ফলে সে বেশ চিন্তাযুক্ত অবস্থায় দিন যাপন করতে লাগল ।
হাবলুর বাড়ি কক্সবাজার জেলার দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি । সেখানে বিদ্যুৎ নেই, বিদ্যাশিক্ষা অর্জনের জন্য কোন ইস্কুলও নেই । শহুরে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল তাদের জীবনযাত্রা । গ্রামের মানুষ সহজ সরল না হাবাগোবা ঐ বিতর্কে না গিয়ে আমাদের হাবলুকে হাবাগোবা বলাই সঙ্গত । পিতামাতার তিরোধানে সে তুর্কি সুলতানদের ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে আগমনের মত নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কক্সবাজার শহরে চলে আসে । হাবলুর কপাল ভাল । কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেই সমুদ্রের তীরে একটা রেস্টুরেন্টে টেবিল বয়ের কাজ পেয়ে গেল । ধীরে ধীরে কাস্টমারদের সাথে সু-সম্পর্ক তৈরি হল তার । কাস্টমাররা হাবলুকে বেশ পছন্দও করে ।
কাস্টমাররা যখন চা পান করতে করতে মোবাইল ফোনে আলাপ করে, হাবলু তন্ময় হয়ে তাদের কথাবার্তা শুনে । সে লক্ষ্য করে অনেকে চাপাস্বরে কথা বলে, আবার কেউ কেউ কথা বলার সময় চিল্লায় । আবার অনেক লোককে দেখেছে গালাগালি করতে । সে বুঝতে পারে মোবাইল দিয়ে গালাগালিও করা যায় । এইটা একটা বেশ সুবিধা । সে মোবাইল কিনে প্রথমে তাদের গ্রামের মইত্যাকে গালাগালি করবে । মইত্যা তাকে একবার দিগম্বর করেছিল । সেকথা হাবলু আজও ভুলতে পারে নাই ।
এদিকে রেস্টুরেন্টের মালিকের কাছে হাবলুর তিন মাসের বেতনের টাকা জমা পড়ে আছে । সে মালিককে গিয়ে বলল, স্যার আমার বেতনের টাকাটা লাগব ।
মালিক জানতে চায়, এত টাকা দিয়ে কি করবি হাবলু ?
সে সলজ্জ উত্তর দেয়, মোবাইল কিনুম স্যার ।
মোবাইল কিনবি ! মালিক কিঞ্চিত আশ্চর্য হলেন । তারপর হাবলুর সব পাওনা বুঝিয়ে দিলেন । ডিউটি শেষ করে হাবলু মোবাইল ফোন কিনে নিয়ে এল । সে এখন একটি মোবাইল ফোনের গর্বিত মালিক । খুশিতে তার বুক উঁচু হয়ে গেল । সে দ্রুত নিজের খুপরিতে ফিরে আসে। মোবাইল সেট হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে লাগল মইত্যাকে গালাগালি করে নিলে ভাল হয় । সে সবুজ বোতাম চাপ দিয়ে কানের কাছে ধরল। তৎক্ষনাৎ শুনতে পেল একটি মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠ । বলছে, আপনার একাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নেই । আপনার একাউন্ট রিচার্জ করুন ।
বারবার এই কথা শুনতে শুনতে হাবলু বিরক্ত হয়ে ধমক দিল । এই বেটি চুপ কর । আমি আগে একটু মইত্যারে গালি দিয়া লই ।
হাবলু অপেক্ষা করতে লাগল । বুঝল মেয়েলি কন্ঠ চুপ হয়ে গেছে । সে এবার মতিকে গালাগালি শুরু করল । এই মইত্যা হারামজাদা, খানকির পোলা তুঁই তো হাবলুরে চিনস নাই । আমি এখন মোবাইল কিনছি । তরে ডেইলি গালাগালি করব । এই কুত্তার পোলা কথা কস না কেন ?
হাবলু বুঝতে পারে মতি ঘাবড়াই গেছে এ কারণে চুপ করে থাকছে । সে মনে মনে স্বস্থি পায় । সে তার এক বন্ধুর কাছে ফোন করার জন্য মোবাইল সেট আবার কানের কাছে ধরল এবং পূর্বের নারীকন্ঠ আবার শুনতে পেল । সে খুব চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগল কেন মেয়েটি বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে । অগত্যা সে মালিকের শরণাপন্ন হলে মালিক জানায় মোবাইলে টাকা ভরতে হবে; না হয় কথা বলা যাবে না ।
মোবাইল কিনতেই হাবলুর সব টাকা শেষ হয়ে গেছে । তার পকেট একেবারে খালি । সে মালিকের কাছ থেকে বিশটাকা অগিম নিয়ে ফ্লেক্সিলোডের দোকানে চলে এল । দোকানিকে বলল, ভাই বিশ টেকা ভরেন ।
কত নম্বর ? দোকানি জিজ্ঞেস করে ।
হাবলু আমতা আমতা করে । সে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে নম্বরটি বলে ।
দোকানি বলে , ঠিক আছে আপনি চলে যান, আপনার কাজ হয়ে গেছে ।
হাবলু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দোকানির দিকে । কারণ সে দেখেছে দোকানি বিশটাকা ক্যাশ বাক্সে ভরেছে, মোবাইলে ভরে নাই । বুঝতে পারল সে ঠকবাজের পাল্লায় পড়েছে । সে রাগান্বিত হয়ে বলে, ভাই আপনি তো টেকা ক্যাশ বাক্সে ভরেছেন মোবাইলে ভরেন নাই ।
দোকানি অবাক হয়ে তাকাল হাবলুর দিকে । ভাবল নিশ্চয় ছেলেটির স্ক্রু ঢিলা । তিনি বললেন, এই টাকা ক্যাশ বাক্স থেকে আপনার মোবাইলে চলে যাবে । চিন্তার কারণ নেই ।
হাবলু ভাবে এখন তো দূর থেকে টেলিভিশন চালানো যায় । এটাও ঐরকম কোন কেরামতি হবে । সে দাঁড়িয়ে থাকলে দোকানি জিজ্ঞেস করে, আর কিছু বলবেন ?
হাবলু বলে, আমার নম্বরটা কাগজে লিখ্যা দিবেন ?
দোকানি কাগজ কলম নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম কী ?
হাবলু ।
দোকানি কাগজে হাবলু নামটি লিখে ও এর নিচে মোবাইল নম্বর লিখে হাবলুর হাতে দিল ।হাবলু খুশি মনে খুপরিতে ফিরে আসে । সে বালিশের তলা থেকে অনেক গুলো কার্ড বের করে আনে । এসব কার্ডে তার পরিচিত কাস্টমারদের নম্বর আছে । সে চিন্তা করল সবাইকে মোবাইল ক্রয়ের সংবাদটা জানানো উচিৎ । কিন্তু এতজনকে কল করতে গেলে তার সব টাকা শেষ হয়ে যাবে । সে আগেই জেনেছিল মিস কল দিলে টাকা কাঁটা যায় না । সে ভাবে মিস কলই দেবে ।
হাবলু প্রথমে বেছে বেছে সুমি আপুর নম্বরটি বের করল । সুমির নম্বরে রিং বাজছে । সুমি রিসিভ করে বলল, হ্যালো ।
হাবলু বলে, সুমি আপু আমি হাবলু । আমি মোবাইল কিনেছি । ভাবলাম আপনারে একটা মিস কল দিই । এইটা মিস কল দিলাম । পরে আপনার সাথে কথা বলব। এখন রাখি সুমি আপু ।
সুমি অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রেখে বলল, হে হাবলু খুব ভাল করেছিস মিস কল দিয়ে । তুঁই এভাবে মাঝে মাঝে মিস কল দিস । কেমন ।
আইচ্ছা সুমি আপু । তাহলে এখন রাখি ।
হাবলু লাইন কেটে দিল । সে সজলের নম্বরটি খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল । সজল কল রিসিভ করতেই হাবলু বলল, হ্যালো সজল ভাইয়া আমি হাবলু । শুনেন আমি একটা নতুন মোবাইল কিনেছি । ভাবলাম আপনাকে মিস কল দিয়ে খবরটা জানাই । এইটা আপনাকে মিস কল দিলাম ।
সজল হাসতে হাসতে বলল, তুঁই নাকি সুমিকেও মিস কল দিয়েছিস ?
সুমি আপু আপনাকে বলেছে ?
হে । সে তো একটু আগে আমাকে ফোন করে জানাল । আর কাকে মিস কল দিয়েছিস ?
এখনও আর কাউকে দিই নাই ।
ঠিক আছে তুঁই সবাইকে মিস কল দিতে থাক । আমি এখন রাখলাম ।
হাবলু এবার মতিন আংকেলের নম্বরে মিস কল দেয় । আরও কয়েকজনকে মিস কল দেয়ার পর সে ভাবল মিশু আপুকেও মিস কল দিয়ে খবরটা জানিয়ে দিলে ভাল হয় । কিন্তু মিশু আপুকে মিস কল দিতে গিয়ে হাবলু আবারও সে নারী কন্ঠস্বর শুনতে পেল । বলছে, আপনার একাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা নেই । অনুগ্রহপূর্বক আপনার একাউন্ট রিচার্জ করুন ।
হাবলু খুব অবাক হল । সে তো একটু আগে বিশ টেকা ভরেছে । তাহলে টেকাটা গেল কোথায় ? সে তো মিস কলই দিয়েছে । এখনও পর্যন্ত একটা ভাল কল করে নাই । হাবলু বুঝতে পারল এই বেটি ঠকবাজ । খালি টেকা ছাড়া আর কিছু চিনেনা । সে আবার চেষ্টা করল মিস কল দেয়ার জন্য । আবারও পূর্বের কন্ঠস্বর শুনতে পেল । হাবলু বলল, এই মাইয়া শুধু একবার কও হাবলু আমি তোমারে ভালোবাসি । তাহলে আমি আবারও বিশ টেকা ভরতে রাজী ।
পরদিন মিশু এলো রেস্টুরেন্টে । হাবলু কাপ প্লেট পরিষ্কার করে চা এনে দিল । মিশু বলল, হাবলু তুঁই তো আমাকে মিস কল দিলি না ।
হাবলু মুখভার করে জবাব দিল, আপু মিস কল দিতেও যে টেকা লাগে এইটা জানতাম না ।
আপনার মন্তব্য লিখুন