রঙের জীবন

মন ছুঁয়ে যাওয়া এক ট্র্যাজেডি

হাসান আহমেদ:

 

দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স

পরিচালক : যশ বুন

অভিনয়: শাইলিন উডলি, এন্সল এলগর্ট, লরা ডর্ন প্রমুখ

সাল: ২০১৪

দেশ: যুক্তরাষ্ট্র

রেটিং : ৪/৫

প্রাককথা
ক‘দিন আগে শুনলাম, বলিউডের জনপ্রিয় কাস্টিং ডিরেক্টর মুকেশ চাবড়া প্রথম ছবি বানাতে যাচ্ছেন, নাম ‘কিজি অর মান্নি‘ যা পরে ‘দিল বেচারা‘ নাম করণ করা হয় । এর মধ্যে নায়ক সুশান্ত সিং রাজপুত কর্তৃক নায়িকা সানজানা সাঙ্গীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগও অনেকের জানা থাকতে পারে। যাই হোক, ছবিটি এ বছর মুক্তি পাবার কথা। তবে আজকে আমার কথা ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স‘ ছবিটি নিয়ে কারণ, ‘দিল বেচারা‘ এই ছবিটিকেই রিমেক করা হচ্ছে।

জন গ্রিনের লেখা একই নামের উপন্যাসটি ২০১২ সালে প্রকাশিত হবার দু বছর পর যশ বুন এটিকে পর্দায় আনেন প্রথম সিয়াটল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মে ২০১৪ সালে। এর এক মাস পর যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্বে ছবিটি মুক্তি পায়। অনেকে বলে থাকেন, সাহিত্য থেকে ছবি কখনো ভাল হয় না, তবে আমি বলি নির্মাণ ভাল হলে সেটা সাহিত্যকে অনায়াসে ছাপিয়ে যেতে পারে। অনেক সময় বই পড়ে সেই নামে বানানো সিনেমা দেখা হয়েছে, এই ছবির ক্ষেত্রে আমার হয়েছে উল্টো। ১.২ কোটি ডলার ব্যায়ে নির্মিত ছবিটির আয় ৩০কোটি ৭০ লক্ষ, প্রশংসিত হয়েছে সমালোচক আর বোদ্ধাদের কাছ থেকেও। আমার দেখা সেরা পাঁচ রোমান্টিক ট্র্যাজেডিতে এই ছবি থাকবেই।

গল্প
ছবির গল্প গড়ে উঠেছে ইন্ডিয়ানায় বাসকরা এক কিশোরী হ্যাজেল গ্রেসের ভাষ্যে। সে নিজে থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত, ফুসফুস অব্দি ছড়িয়ে যাওয়ায় তাকে একটা শ্বাস নেবার যন্ত্রও ব্যবহার করতে হয়। হ্যাজেলের বাবা মা চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিয়মিত ডাক্তারের সাহচর্যে থেকে তাকে সুস্থতার দিকে নিতে। এমনি একসময় এক ক্যান্সার আক্রান্তদের সাথে কাউন্সিলিংয়ে গিয়ে হ্যাজলের পরিচয় হয় অগাস্টাসের সাথে। অগাস্টাসের বোন ক্যান্সারে পা হারালেও আপাতত সে সুস্থ আছে। স্বভাবজাত মজা আর দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে খুব অল্পেই হ্যাজেল আর অগাস্টাসের ভাব জমে যায়। তারা বই আদান প্রদান আর মোবাইলে মেসেজ দেয়া নেয়া করতে থাকে। হ্যাজেলের বাবা মা সব জানলেও তাকে বাধা দেয় না মেয়ের ভাললাগার কথা ভেবে। হ্যাজেলের প্রিয় বই ছিল An Imperial Affliction যার লেখক পিটার ভ্যান হ্যাটনকে খুব পছন্দ করে হ্যাজেল। বইয়ে তার মতই আরেকটা ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়ের কথা ছিল। আর হ্যাজেল খুব চাইতো তার প্রিয় লেখকের সাথে দেখা করে বইয়ের চরিত্র অ্যানার বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে। কিন্তু নেদারল্যান্ডসে গিয়ে লেখকের সাথে দেখা করা তার জন্য অসম্ভব। কেননা, ডাক্তার এই অবস্থায় তাকে কোনো মতেই যেতে দেবে না। কিন্তু তার এই ইচ্ছা পূরণ করতে এগিয়ে এলো অগাস্টাস। অগাস্টাস লেখকের সহকারীর সাথে মেইলে যোগাযোগ করে তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে আমস্টারডামে। আর্থিক ও চিকিৎসাগত সমস্যা থাকার পরেও হ্যাজেল তার মা কে রাজি করায় যেতে এবং অগাস্টাসসহ তারা তিনজন আমস্টারডাম আসে। কিন্তু সেই লেখকের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতা ভাল ছিল না হ্যাজলের, ফলে অগাস্টাস তাকে সেই সময়টা বাইরেই সঙ্গ দেয় এবং তার ভালবাসার কথা জানায়। তারা গভীর মিলনে আবদ্ধ হয়, তবে এরপর অগাস্টাস হ্যাজলকে জানায় তার এক লুকোনো সত্য। সেটা জানতে এই দারুণ মর্মস্পর্শি ছবিটি দেখতে হবে আপনাকে।

অভিনয়
শাইলিন উডলির অভিনয় আমার ভাল লাগে ‘ডাইভারজেন্ট সিরিজ‘ থেকেই। সেই সিরিজে তার ভাই ছিল এন্সল এলগর্ট যে এই ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন। তবে এই ছবিতে শাওলিন থেকে আমার এন্সলের অভিনয়ই বেশি ভাল লেগেছে, কেননা এখানে একই সাথে অগাস্টাসের চরিত্রে তার কমেডি, রোমান্স আর ট্র্যাজিক অভিনয় আবেগ আর সহজাত ভঙ্গি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে এবং সে অনেকাংশেই সফল। শাইলিন এর আগেও টিভিতে প্রচুর কাজ করেছেন, তাই হ্যাজলের চরিত্রে সে বেশ মানিয়ে গেছে এবং দারুণ অভিনয়ে পুরোটা সময় মুগ্ধ করে রেখেছেন। এছাড়াও তার মায়ের চরিত্রে লরার অভিনয় কিংবা লেখকের চরিত্রে লিজেন্ড অভিনেতা ডিফোও ছিলেন অসাধারণ।

পরিচালনা
উপন্যাস থেকে সিনেমা বানাতে সবসময় একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিতেই হয় পরিচালককে। কারণ, বইয়ে পড়ে চরিত্রগুলোর সম্পর্কে একটা ছবি আঁকা হয় পাঠকদের মনে। সে হিসেবে যশ বুন তার কাস্টিং এবং ডিজাইনে উতড়ে গেছেন বেশ ভালভাবেই। কারণ, ছবিটি মুক্তির পর ভক্তমনেও দারুন সাড়া ফেলেছিল ছবিটি। প্রতিটি ফ্রেমে এক স্বাভাবিক ও সহজাত আবেগকে বারবার কাজে লাগিয়েছেন বুন। তিনি দেখিয়েছেন, ভালবাসা আর আবেগের কান্না সব মানুষকেই ছুঁয়ে যেতে পারে। দারুণ চিত্রনাট্য করেছেন ন্যুসট্যাডারও, যা বুন কে সাহায্য করেছে একটা অনিশ্চিত প্রেমের গল্পে হাসিকান্নায় মাতিয়ে রাখতে।

চিত্রগ্রহণ
ছবির ক্যামেরার কাজ যথাযথ বলব, কেননা এখানে ক্যামেরা লং থেকে ফ্রন্ট এবং জুম শট ছিল বেশি। সে হিসেবে ভালই ছিল, দৃষ্টিকটু লাগেনি। আমস্টারডামে দুজনের বাইরে সময় কাটানোর দৃশ্যগুলো আমার এখনো চোখে লেগে আছে।

সম্পাদনা
এক কথায় যতটুকু প্রয়োজন ছিল ততটাই।

সঙ্গীত
ছবির আবহ সঙ্গীত দারুণ ছিল। আবেগ, অনুভূতি আর মমতার জায়গাগুলোকে তুলে আনতে, জীবন্ত করতে বেশ ভালো করেছেন সংগীত পরিচালক। মাইক মগিস আর নাটা ছিলেন মিউজিকে, ভালই ছিল। ক্ল্যাসিকাল আর অর্কেস্ট্রার একটা মিশ্রণও পেয়েছি।

লোকেশন
বেশিরভাগ শ্যুটিং ছিল পেনিসালভানিয়ার পিটার্সবার্গে, এরপর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। এছাড়াও অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাড়িটিও দেখানো হয়েছে ছবিতে।

দুর্বলতা
ছবিটি অনেকের কাছে একটু ধীর লাগতে পারে কারণ রোমান্টিক ট্র্যাজেডিতে সম্পর্ক গড়তে একটু সময় লাগে।

শেষকথা
দুজন মানুষ যদি জানে তাদের সম্পর্কের পরিণতি নেই, তবে সেই সম্পর্কের গল্পটি একটু অন্যরকমই। আর স্বার্থক রোমান্সে মানুষের মনে দাগ কেটে যাবার মত সব কারণই রয়েছে এই ছবিতে। তাই আশা করি দুই ঘন্টা সময় মন্দ কাটবে না।