ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনা: একটি তাত্ত্বিক মূল্যায়ন (২০১৯) বইটি মূলত বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিয়ে ভাবনার বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ। বইটি লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল। অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় এবং দক্ষতার সাথে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। এ বইটিতে মোট পাঁচটি অধ্যায় আছে। পাঁচটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়, বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় চেতনা, ইসলাম প্রচারে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা এবং বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনার পর্যালোচনা আলোচনা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও অন্য ধর্ম নিয়ে তাঁর যে ভাবনা ছিলো তা এ বইটিতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শরীয়তপুর জেলায় বেড়ে ওঠা এ লেখক বঙ্গবন্ধুর জীবন ও ধর্ম নিয়ে ভাবনার এই বইটি দায়বদ্ধতা থেকেই লিখেছেন। সমাজ যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে ধর্ম এবং বঙ্গবন্ধুকে ব্যাখ্যা করে তারই সঠিক তথ্য দিয়ে সাজিয়েছেন এবং সমাজকে, সমাজের মানুষকে অবহিত করতে চেয়েছেন।
পারিবারিক ভাবে বঙ্গবন্ধু ইসলামি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা এ ভূখণ্ডে আসেন মূলত ধর্ম প্রচার করার জন্যই। ইসলামি অনুসারী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পরিবার তখন যেমন ছিলো এখনো তেমনি আছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরিবার এবং বাবার মতো ইসলাম ধর্ম পালন এবং ইসলামি অনুসারীদের সহায়তা করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু ইসলাম ধর্ম পালন করলেও অন্য ধর্মের প্রতি ছিলেন সমান শ্রদ্ধাশীল। তিনি কোনোদিন অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এবং ভিন্ন ধর্মের প্রতি কোনোরূপ বিরুদ্ধতা করেননি বরং তাদের সহায়তা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী এ লেখক তাঁর বইতে দেখাতে ছেয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা ও বঙ্গবন্ধুর গভীর প্রত্যয়সমূহ। ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীন নয় এবং কোনো ধর্মের প্রতি আক্রোশ দেখানো নয় বরং নিজ নিজ ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা দেখানো এবং সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা, প্রার্থনা করা, এবং তারই আদেশ মতো চলা।
বঙ্গবন্ধু ইসলাম বিশ্বাস করতেন। আর ইসলাম মানব কল্যাণের চেতনায় উজ্জ্বল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রধান রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে তা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এটা বঙ্গবন্ধু নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ” ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খৃস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের ব্যবসা চলবে না, ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না।” উপরন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ভাষণে বলেছিলেন, ” বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না।”
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে ১৮ জানুয়ারি ডেভিড ফ্রাস্টকে দেয়া সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন- ” আমি মুসলমান, মুসলমান একবারই মরে, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। ” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে সাহায্য, অনুদান, বিনিয়োগ চাইলে রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশ বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করে কোনো শর্ত ছাড়াই, কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত দেশ সৌদিআরব, মিশর ও লিবিয়া শর্ত দিয়েছিলো। তারা বলেছিলো বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র করা হলেই তারা বাংলাদেশকে সাহায্য করবে তাছাড়া নয়। তখন বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন আমার দেশে শুধু মুসলমান নয় অন্য ধর্মের মানুষও বসবার করে।তাদের উপর অবিচার করা হবে। তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশে সব ধর্মের মান মর্যাদা সমান। এই চেতনায় দৃঢ় থাকার কারণে সেদিন ঐ দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা বঙ্গবন্ধুকে খালি হাতে ফেরত দিয়েছিলো কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিচলিত হননি। কারণ তিনি বাঙালিকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। ১৯৫৪ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার কারণেই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দিয়ে দেন। এতে দলে সকল ধর্মের মানুষ এসে যোগ দিয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধু একজন প্রকৃত মুসলমান হওয়ায় তিনিই প্রথমে বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনে কুরআন তিলাওয়াত, আসসালামু আলাইকুম, খোদা হাফেজসহ মুসলিম সংস্কৃতি প্রচলন করেন। তিনি বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করেন। তাবলীগ জামাতের মারকায বা কেন্দ্রের জায়গাটি রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তিনিই বরাদ্দ করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুই হজ্জ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ইসলামের সেবক বলে দাবি করা মানুষগুলোই হজ্জের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেয় যা বর্তমান বাংলাদেশের অনেক মানুষই জানে না। বঙ্গবন্ধু প্রথমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেন এবং ১৯৭৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্তি হওয়ায় মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। ইসলামের ধর্মীয় দিবসগুলোতে পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথমে বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী সা., শব-ই- বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। সরকারি অনুষ্ঠানে মিলাদ মাহফিল শুরু করেন। এখনো সরকারি সব অনুষ্ঠানে সকল ধর্মের ধর্ম গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। বড়দিন, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা তে সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছেন, সাম্য, মৈত্রী, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ইসলাম ও ইসলামি মূল্যবোধ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ইসলামি আদর্শের একজন মহান মানুষ ছিলেন।।
বঙ্গবন্ধু ইসলামি আদর্শের মানুষ হলেও সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করতেন। পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসে দিল্লিতে ভাষণে বলেন, ” আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোন বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এ পরিতৃপ্তি নিয়ে যে, অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে।”
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে তিনি বলেন, তোমরা বাংলায় যারা কথা বলো না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও। ভাইরা, তাদের (বিশ্বাসঘাতক) গায়ে হাত দিও না; তারাও আমাদের ভাই। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই বাঙালিরা কেবলামাত্র স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করতে পারে, তাই না, তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে।” তিনি সব সময় সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস করতেন। তার কাছেই সাহায্য চায়তেন।
তিনি বাংলাদেশকে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইসলাম ও বাংলাদেশের জয়ধ্বনি করেছিলেন। তিনি ইসলামি আন্দোলনের মহান নেতা হয়েও নিজেকে প্রেসিডেন্ট বা নেতা দাবি না করে বলেছেন, ” আমি বাঙালি, আমি মানুষ আমি মুসলমান। তিনি আরো বলেন মুসলমান কারো অকল্যাণ কামনা করতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধুর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক মাঝে মাঝে প্রিয় নবি মুহাম্মাদ (স) এর বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন এতে বইটি আরো বেশি গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে। এমনি বিভিন্ন তথ্য নিয়ে লেখক মোস্তফা কামাল তাঁর এ বইটি সাজিয়েছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই তুলে ধরেছেন অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে। বইটির বহুল প্রচার কাম্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনা: একটি তাত্ত্বিক মূল্যায়ন, ড. মোস্তফা কামাল, প্রকাশক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রচ্ছদ : মশিউর রহমান, মূল্য : ২৮০ টাকা, ২০১৯
আপনার মন্তব্য লিখুন