আবহমান কাল ধরেই বাল্য বিবাহ আমাদের সমাজে একটি মারাত্বক সামজিকব্যধি হিসাবে লেপ্টে থেকে গ্রাম হতে শহর, দরিদ্র হতে মধ্যবিত্ত, হিন্দু হতে মুসলিম প্রায় প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০বছরে পার হলেও কাগজ কলমে সমাজে তার ক্রমহ্রাসমান হার পরিলক্ষিত হলেও বাস্তবে আজও আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামে এবং শহরের দরিদ্র পরিবারগুলোতে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
বাল্য বিবাহ বাংলাদেশে ১৯২৯ সাল থেকে অবৈধ হলেও বিশ্বের বাল্যবিয়ে প্রবণ শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম স্থানে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। দেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা ১৯৭০ সালের তুলনায় ৯০ শতাংশেরও বেশি কমলেও এখনো দেশে এই হার অনেক বেশি (৫১%) । এটি এই দেশকে ৩ কোটি ৮০ লাখ ‘শিশুকনের’ দেশে পরিণত করেছে, যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের ১৮তম জন্মদিনের আগেই। আবার এদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগেই। এ দেশে ৮০ শতাংশ গরিব পরিবারের মধ্যে বাল্যবিবাহ হয় এবং ধনীদের মধ্যে এই সংখ্যা ৫৩ শতাংশ। এছাড়া গ্রাম-শহরের মধ্যে বাল্যবিবাহের অনুপাত ৭০:৫৩। যদি পরিসংখ্যান এটা বলছে কিন্তু এখনো আমার গ্রামে ৮০% মেয়ের ১২-১৮বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়, যেখানে ৬০%মেয়ের বিয়ে হয় ১২-১৫ বছর বয়সে।
তার সরব উপস্থিতে বলি হয়ে হাজার হাজার কিশোরী অকালে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, পরিবার নামক একটি জেলখানায় বন্দি হয়ে যাচ্ছে, নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছে, অকালে মৃত্যু বরণ করছে। তার কারণেই সমাজে ডিভোসি মায়ের সংখ্যা, শিশু মৃত্যুহার, গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুহার, অপুষ্ট বাচ্চা জন্ম দেয়ার হার ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষের কোয়ালিটি লাইফ নষ্ট হচ্ছে, যা এসডিজি (SDG) অজনেরও একটি শক্তিশালী অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধের হারে অগ্রগতি গত দশকের তুলনায় কমপক্ষে ৮ গুণ এবং এসডিজির লক্ষ্য পূরণের জন্য ১৭ গুণ দ্রুততর করতে হবে। বিবাহিত প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রতি ৫জন ১৮ বছরের আগে ও প্রতি ৮জন ২০ বছরের আগে সন্তান জন্ম দেয়। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের অপরিণত সন্তান জন্মদান বা কম ওজনের সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা ৩৫-৫৫% এবং এ বয়সী মায়েদের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশু মৃত্যুর হার ৬০% পর্ন্ত হতে পারে। বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি বাল্যবিবাহ৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। ১৫-১৯ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীদের মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা ২০ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ। আর ১৫ বছরের কম বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা ৫-৭ গুন বেশি। জীবন থেকে নেয়া সংশ্লিষ্ট ছোট্ট দুটি ঘটনা তুলে ধরলাম-
প্রথম ঘটনা (২০০৫-৬): আমি তখন ভাসিটিতে মাস্টাসে পড়ি। এ সময় কোন এক ছুটিতে বাড়িতে এসে শূনলাম গ্রামের ১২-১৩বছর বয়সী গ্রাম্য এক বোনের বিয়ে দিচ্ছে তার পরিবার। আমি বিয়েটা বন্ধ করার জন্য মেয়ের বাবা-মাকে বাল্যবিবাহের ভালো-মন্দ সবই বুঝালাম। পাশাপাশি আইনি ভয়ও দেখালাম। তারা সবই বুঝলো এবং আমাকে বল মেয়েকে এখন বিয়ে দিবে না। এরপর রাতে আমার মা আমাকে ডেকে বললো বাবা তুমি নাকি অমুকের মেয়েকে বিয়ে দিতে দিচ্ছো না। আমি মাকে সব ঘটনা খুলে বললাম তিনি আমার সাথে একমত হয়ে খুব শান্ত কন্ঠে বললো বাবা তুমি কি পারবে মেয়েটার বাবা-মাকে এতোটুকু নিশ্চয়তা দিতে যে এই ছেলেটা চলে গেলে মেয়েটির বয়স ১৮ বছর হওয়ার পর অপর একটি ভালো ছেলের সাথে তার বিয়ে হবে, এতো দিন মেয়েটি চারিত্রিকভাবে ভালো থাকবে আর ডাঙ্গা দরজা-জানালার ফাক গলিয়ে আসা শিয়ালের হুকাহুয়া ডাক শোনা, বিছানায় শুয়ে ছোসনা দেখা, টিনের চালে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শোনা অনিরাপদ -অভাবী দোচালা টিনের ঘরে মেয়েটিকে নিয়ে তার বাবা-মা নিশ্চিতে ঘুমাতে পারবে?? আমি কিন্তু সেই নিশ্চয়তাটা দিতে পারেনি বলেই বিয়েটা আটকাতে পারিনি।
দ্বিতীয় ঘটনা (২০১৭-১৮): বছর ৪-৫আগে গ্রামের ১৩-১৪বছর বয়সী আমার এক চাচাতো বোনের বিয়ে হয়। আমার বাবা একজন জন প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সরকারের আইনী প্রতিনিধি হওয়া সত্বেও বিয়েটা আটকাতে পারিনি বলে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আমার বাসায় চলে এসেছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন আফসোস আমি নিজে অনেক বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছি কিন্তু নিজের ভাতিজির বিয়েটা বন্ধ করতে পারলাম না কারণ আমার ভাই আমাকে বলে ভাই দেখ আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে (বয়স ১৩-১৪ বছর হবে), টিভি দেখে দেখে পরিপক্ক হয়ে গেছে, আর মোবাইলের কারণে পাড়ার উঠতি বয়সী ছেলেদের সাথে মেশার চেষ্টা করছে। না জানি কখন মেয়েটা পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে একটি অপরিপক্ক হাত ধরে চলে যায় আর আমাদের মান-ইজ্জত ধুলোর সাথে মিশে যায়। এ রকম ঘটনা গ্রামে অহরহ ঘটছে। তুমি হয়ত জোর করে অথবা আইনী ভয় দেখিয়ে আমার মেয়েটার বিয়ে ডাঙ্গতে পারবা কিন্তু আইন কি আমার মেয়ে কোনো ছেলের হাত ধরে চলে গেলে সেটা বন্ধ করতে পারবে?? আমার বাবা কিন্তু আমার চাচাকে এই নিশ্চয়তাটা দিতে পারেনি বলেই বিয়েটা আটকাতে পারিনি।
উপরের পরিসংখ্যানগুলো আমাদের বলে দিচ্ছে উন্নয়নের কোন জায়গায় আমরা আছি এবং বাস্তবভিত্তিক ঘটনা দুটি আমাদের বলে দিচ্ছে সামাজিক নিশ্চয়তাই আমাদের কতোটা গভীরে কাজ করতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ করেই বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যধিটি আমাদের সমাজ থেকে দুর করা যাবে না, এর জন্য প্রয়োজন এ বিষয়ে গবেষকদের বাতলানো নানাবিদ কর্মকান্ডের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তব্মুখি বাস্তবায়ন, সমাজের সকল স্তরে ব্যক্তি পযায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজ থেকে এই অলিখিত অনিশ্চয়তার জায়গায় নিশ্চয়তার বেষ্টনি সৃষ্টিতে কাজ করা।
মজনু সরকার
১০ই অক্টোবর, ২০২১
আপনার মন্তব্য লিখুন