নাবিলা দুই মিনিট পরপরই ফোন দিচ্ছে। রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করছে, আপনি কোথায় এখন? আসতে অসুবিধে হচ্ছে না তো! আমিও একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি, এই তো আমি এখানে গুলশানের এত নাম্বার রাস্তায়। এই তো গ্রামীণফোনের অফিস ক্রস করলাম। এই তো হ্যাঁ হ্যাঁ। না, কোনো সমস্যা নেই।
ফোন রেখে দিচ্ছি। দুই মিনিট যাচ্ছে না। আবার নাবিলার ফোন—আচ্ছা আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো! আমি খুব অস্থির হয়ে আছি। কিন্তু আমি ফোন করতেই থাকব। আমি ফোন করতেই থাকবো। আমি ফোন করতেই থাকব। আপনি যতক্ষণ না আমার কাছে আসছেন।
নাবিলা এ রকমই। কোনো বিষয়ে অতি একাগ্র হলে রীতিমতো ক্রেজি হয়ে ওঠে। তখন জেদ ধরার মতো করে এক কথা তিনবার বলবে। তিনবারই। তার বেশিও না কমও না। তিনবার বলা শেষ হলে অন্য কথা বলবে। পরে যদি ওই কথা বলার প্রয়োজন হয় তখন আবার তিনবার বলবে। এ রকম সে।
এ রকমই চলছে প্রায় চল্লিশ মিনিট হতে চললো। আমার ড্রাইভার বোধহয় বিরক্তই হয়ে যাচ্ছে। বোধহয় ভাবছে এতবার ফোন দেওয়ার কী দরকার। বড়লোকদের ঢঙ দেখে পিত্তি জ্বলে যায়। এদের সকাল বিকাল থাবড়ানো দরকার। ফালতু ফোন দিয়ে দিয়ে কত টাকা নষ্ট করছে। শালারা বদের বদ। কিন্তু সে কিছু বলছে না। গরিব লোকেরা সব সময় সব কথা বলতে পারে না।
গাড়ির স্পিড বাড়ানো দেখে আমার এ সন্দেহ প্রবল হলো। আমি ড্রাইভারকে কিছু বলতে যাব, তখনই আবার ফোন—এই শোনেন সত্যি করে বলেন তো আাপনি এখন কোথায়? জ্যামে আটকা পড়েছেন না কি? আমার খুব টেনশন হচ্ছে।
আমি বললাম, টেনশনের কিছু নেই। আমার গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে আসছে। যে পথের পথিক আমি সে-পথ চলে যায় দোতলায়। দোতলা কখনো ফিরে আসে না। এই আমার সাম্প্রতিক দুঃখ।—ফোন কেটে দেই আমি।
এক মিনিটের মাথায় আবার ফোন নাবিলার—আপনি কী বললেন! গাড়ি খুব দ্রুত চলছে মানে! ড্রাইভারকে বলে দেন এত দ্রুত না চালাতে। যদি অ্যাকসিডেন্ট করে বসে! আর কী বললেন আমরা দোতলায় থাকি! আপনাকে কতবার বললাম আমরা সাততলায় থাকি! আচ্ছা আপনি ভুলে গেলেও সমস্যা নেই। আমি ফোনেই থাকব।
সিকিউরিটি কোনো বাধা দিলো না। নাবিলা বলেছিল সে গাড়ির নম্বরও সিকিউরিটিকে বলে রাখবে। যেন ঝামেলা না করে। কোনো ঝামেল হলো না। পার্কিং শেষ হলে আমি নামতে যাব গাড়ি থেকে, তখন আবার নাবিলার ফোন। স্যরি, একটা খারাপ সংবাদ আছে। আমাদের লিফট্টা নষ্ট হয়ে গেলো এখনই। কী যে জিনিসপত্র লাগায় এরা। যত্তসব। আপনার একটু কষ্ট করতে হবে। একটু না অনেক কষ্ট। ইশ! আবারও স্যরি।
আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই। এটাও একটা অভিজ্ঞতা।
গাড়ি থেকে নামলে সিকিউরিটি এসে স্যালুট করলো। রেজিস্ট্রি খাতা মেলে ধরলো আমার সামনে। আমি নাম লিখতে গিয়ে থতমত খেলাম। কারণ এরকম নাম এন্ট্রি করতে অভ্যস্থ নই আমি। আর নাম লিখতে গিয়ে যদি আসল নামটি, মানে যে নামে আমি লিখি সে-নামটি লিখে ফেলি! তাহলে! সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি কখনোই চাই না—কেউ আমাকে চিনুক। আমি আমার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসেছি অনেক বছর হলো। পরিচিতির ওই গণ্ডির ভেতরে আর ফিরে যেতে চাই না। যা হোক নাম লিখলাম, হাসনাত চৌধুরী, ফোন নম্বর লিখতে গিয়ে শেষে ডিজিটটা লিখলাম অন্যটা। প্রকৃত ডিজিটের পরের ডিজিটটা।
সিকিউরিটি আবারও যথারীতি স্যালুট ঠেকালো।
আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম।
আবার নাবিলার ফোন এলো—স্যরি, আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। এমন সময় লিফট্ নষ্ট হলো। ইশ! আমি যদি নিচে গিয়ে আপনাকে তুলে আনতে পারতাম! আর অভিজ্ঞতা! না? লেখক হয়েছেন বলে সবকিছুতেই অভিজ্ঞতা খোঁজেন তাই না! আগে এখানে এসো অভিজ্ঞতা কী বুঝিয়ে দেব।
আমি আর কী বলব। খুব জোরে হাসলাম। নাবিলা ফোন কেটে দিলো।
দোতলায় ওঠার পর আবার ফোন এলো নাবিলার, জানেন আমি জিহ্বায় কামড় খেয়েছি। দেখবেন? উফ কী করে দেখবেন। কেন খেয়েছি জানেন?
আমি বললাম, জানি না তো।
ও মা আপনি বুঝতে পারেননি। একটু আগেই না আমি আপনাকে তুমি করে বললাম। বলেই জিহ্বায় কামড় খেয়েছি। খুব ভুল হয়ে গেছে। আপনি তো ফোনে। দেখবেন কী করে! জানেন, আমি সত্যি সত্যি নিচে নেমে আপনাকে নিয়ে আসতাম। কিন্তু পারছি না। কেন জানেন?
একটু নীরবতা। আমিও কিছু বলি না। নাবিলা এবার ফিসফিস করে বলে, আমার একটা ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। এলেই জানতে পারবেন। নাবিলা ফোন কেটে দিলো।
চতুর্থ তলায় ওঠার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ভদ্রলোক বললেন, জানেন এখানে নাকি বিখ্যাত লেখক শোয়েব চৌধুরী এসেছেন! কোনো এক ফ্ল্যাটে আছেন তিনি! জানেন কিছু? আপনি কততে থাকেন?
আমি একটু চমকে উঠলাম। বিষয়টি জানাজানি হলো কিভাবে! আমি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, জানি না তো!
পাঁচতলায় ওঠার রেস্টল্যান্ডে মানে সাড়ে চার তলায় উঠে দেখি পাঁচতলায় এক অপূর্ব সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে। আমি থেমে গেলাম। এক ঝলকে দেখলাম। নীল শাড়ি সাদা ব্লাউজ মাথায় সাদা কোনো এক প্রাকৃতিক ফুল। নীল টিপ। কালো চুল কাঁধে এসে থেমে গেছে। দীর্ঘাঙ্গী রমণী যে নাবিলা, তা অবলীলায় বলে দেওয়া যায়। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবেশটা এত নাটকীয় আর সুন্দর যে তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন। আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ভুলে গেছি। নাবিলাও কথা বলতে ভুলে গেছে যেন।
নৈশঃব্দ্যকে ভেঙে খান খান করে দিয়ে নাবিলা কথা বলে উঠলো, আরে আপনি ওপরে উঠছেন না কেন? আসেন তাড়াতাড়ি। আবার জানাজানি হয়ে যাবে!
আমি উঠতে থাকলাম। নাবিলার পাশে দাঁড়ালাম। নাবিলা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বললো, বলেন তো, আমি পাঁচতলায় কেন এসেছি আপনাকে নিতে!
আমাকে কোনো উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই নাবিলা বলল, পাঁচ একটা ম্যাজিক নাম্বার। আাপনার উপন্যাসে পড়েছি। একটা ম্যাজিক্যাল রিলেশন হয়ে যাক আপনার সঙ্গে আমার । সেটা হোক প্রথম সাক্ষাতেই।
আমার বুক ঢিব ঢিব করতে লাগলো। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। সাত তলাকে অনেক দূর মনে হচ্ছে এখন। নাবিলা বললো, একটা সুখবর আছে।
আমি তার দিকে তাকালাম শুধু। নাবিলাও আমার দিকে তাকালো। বললো, এখন বলব না। ভেতরে ঢুকে বলব।
দরজা খোলা ছিলো। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। নাবিলা ফিসফিস করে বলল, সুখবরটি হলো, আম্মু বাইরে গেছে হঠাৎ কী এক জরুরি কাজে। ফিরতে দেরি হবে।
আমি বললাম, এটা সুখবর হলো কিভাবে?
নাবিলা বলল, আরে আপনি দেখি কিচ্ছু বুঝেন না। আম্মু নেই মানে এটা এখন লিটনের ফ্ল্যাট।
আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম আরও—লিটনের ফ্ল্যাট মানে কী?
নাবিলা প্রায় ধপাস করা সোফায় বসে পড়লে হতাশায়। মুখে কৃত্রিম বিষাদ এনে বলল, আপনি তো কিচ্ছু বোঝেন না। আপনি লিটনের ফ্ল্যাটও বোঝেন না।
হয়তোবা নাবিলার কথাই ঠিক। আমি কিচ্ছু বুঝি না। কারণ প্রজন্মগত ব্যবধান। এই বিশ-বাইশ বছরের তরুণীর যে প্রজন্ম আমার পঞ্চান্ন বছরের প্রজন্মের সঙ্গে তো বিশাল ব্যবধান। আমি বুঝব কী করে এই প্রজন্মের সব ভাষা। তবে অবাক করা বিষয় হলো যদি না-ই না বুঝি তাহলে গত বিশ বছর ধরে আমার বই এত জনপ্রিয় কেন। যদি তাদের মনের ভাষা আমি না-ইই ধরতে পারি!
সাত তলায় হেঁটে হেঁটে উঠে আমার হাঁসফাঁস অবস্থা। আমি নাবিলাকে যেরকম ভেবেছি সে তার চেয়েও সুন্দরী। আমি এসব বরাবরই এড়িয়ে চলি। কিন্তু নাবিলা যে কী অবস্থা শুরু করে দিয়েছিল! শেষে আমিই আমার প্রকাশককে অনুমতি দেই সেল নাম্বারটি দেওয়ার জন্য। তারপর কথা হয় নাবিলার সঙ্গে। কিন্তু সে ফোনে যতটা সংযত ছিল আজ ততটা নয়। ততটা নয় মানে একেবারেই সংযত নয় সে আজ। তার উচ্ছলতা আমি টের পেয়েছি গাড়িতে ওঠার পর থেকে। এখন এমন আচরণ করছে, যেন আমি তার বয়ফ্রেন্ড। একজন একুশ বাইশ বছরের তরুণীর ভেতরে এরকম উচ্ছলতা থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু…
কিন্তু এ রকম হওয়ার তো কথা ছিল না। কারণ আমার বয়স পঞ্চাশের ওপরে। নিজেকে আড়াল করতে করতে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছি আমি এই পৃথিবীর আটশত কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র দুই-তিনজন আমাকে চেনে। অন্যরা একটা নাম জানে শুধু। শোয়েব চৌধুরী। তারা জানে এই নামটি একজন জনপ্রিয় লেখকের। যে লেখকের বইয়ের ফ্ল্যাপে কোনো ছবি থাকে না। থাকে না কোনো তথ্য। থাকে না জীবন বৃত্তান্তের সংক্ষিপ্ত রূপ।
আমি নাবিলাকে ধরতেও পারছি না। ছাড়তেও পারছি না। নাবিলার আম্মুর দিক থেকে চোখও সরাতে পারছি না। সেই মুখ। সেই চোখ। সেই নাক। সেই ভঙ্গি। শুধু বয়সের একটু ছাপ। চুলের স্টাইল একটু পরিবর্তিত। তার চোখে আগুন-বিস্ফোরিত—নাবিলা! একটা ধমকের সুরে চিৎকার ভেসে এলো তার কণ্ঠ থেকে। সেই কণ্ঠ। মিষ্টিবিধুর। সেই চোখ। সেই রাগ-বিস্ফোরিত চোখে এখন বাষ্প। বাষ্প-রুদ্ধ চোখ নিষ্পলক।
নাবিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টেরই পাইনি। একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।
নাবিলা বললো কী ভাবছেন? আমি কতক্ষণ আপনার সামনে শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! আপনি টেরই পাচ্ছেন না। কী ভাবছেন?
আমি উঠে দাঁড়ালাম না। কারণ দাঁড়ালেই নাবিলার শরীরের সঙ্গে শরীর লেগে যাবে। আমি শরবত নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। নাবিলা সরে গেলো। খলবল করে হাসতে শুরু করলো। আমার ভেতরটা কেমন করতে লাগলো। কেবলই মনে হতে লাগলো এ হাসি আমি আগে দেখেছি কোথাও। আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। নাবিলা এসে এবার আমার হাত ধরে হাতের ভেতরে শরবতের গ্লাস দিলো। বললো, স্যরি। আপনি এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আপনার তো এরকম ঘাবড়ানোর কথা নয়। আপনার উপন্যাসের নায়কেরা কী রোম্যান্টিক! আপনার ছায়াই তো তাদের ভেতরে প্রতিফলিত হয়। তাই না?
নাবিলা হঠাৎ ভারিক্কি চালের কথা শুরু করলো। যেন সাহিত্যের কঠিন সমালোচক। আমি কিছু বললাম না।
নাবিলা চলে গেলো ভেতরে। নাস্তার ট্রলিটা সামনে রেখে সোফায় বসলো।
আমি শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে তার হাঁটা দেখি। আর মনে হতে থাকে এই হাঁটা আমি কোথায় যেন দেখেছি। অবিকল! ছন্দময়! কিন্তু কিছু মনে করতে পারি না।
নাবিলা বললো, লেখকদের নিয়ে এই এক সমস্যা। খালি ভাবতে থাকে খালি ভাবতে থাকে। বলবে না কিছু। হয়তোবা লিখবে। কিন্তু লেখার এক ধরনের টেমপারমেন্ট আর সামনা সামনি বলা আরেক ধরনের। বলেন তো কী রকম সেটা? বলতে পারবেন?
আমি চোখ তুলে তাকে সম্পূর্ণভাবে দেখতে থাকি। নাবিলাও আমার চোখে চোখ রাখে। হয়তো আমার চোখের ভাষাটি পড়তে চেষ্টা করে। চেষ্টা করে এই দুচোখে কতটা ভালোবাসা, কতটা মায়া, কতটা কামনা কিংবা কতটা লেখকের পর্যবেক্ষণ।
নাবিলাকে একটু ধীর স্থির মনে হচ্ছে এখন। শান্ত কণ্ঠে বললো নাবিলা, বললেন না?
আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, জানি না।
নিঃশব্দ নদীর তীরে হঠাৎ হাজারো কাঁচের চুড়ি একসঙ্গে ভেঙে ফেলার মতো আওয়াজ তুলে নাবিলা হাসতে থাকে। বলে, আপনি বোকার মতো কথা বলছেন কেন। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সিরিয়াস লেখক এত বোকা কেন? এরপর কণ্ঠ নামিয়ে আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বলে, আপনি কি প্রেমে পড়েছেন। প্রেমে পড়লে মানুষ বোকা হয়ে যায়।
আমি তার দিকে কঠিন চোখে তাকালাম। যেন সীমানা অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মন বলছে। নাবিলার সীমানা অতিক্রম করে যাওয়াটাকে আমি তো এনজয় করছি। খামাখা অভিনয় কেন?
নাবিলা বলল, উত্তরটা আমার কাছ থেকেই জেনে নিন বিখ্যাত লেখক শোয়েব চৌধুরী। আপনি এখন বললে তা হবে নিতান্তই আমাদের। আর লিখলে প্রথমে হবে শুধুই আপনার। পরে পাঠকের। ওটা আর আমাদের থাকবে না।
আমি আমার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। নাবিলা আমার ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে। একজন আত্মগোপনকারী বিখ্যাত জনপ্রিয় লেখকের আত্মগোপনের কারণ সম্বন্ধে ভক্ত পাঠকের আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তো আমাকে প্রকাশ করতে দিতে চাই না। চাইলে বিশ-পঁচিশ বছর ধরে এই আত্মগোপন কেন। কেন জগৎ সংসার থেকে একাকী জীবন যাপন! যে জগতে আমি ছিলাম সেখানে থাকলে আজ আমি দেশের কোনো না কোনো কোম্পানির উচ্চতম স্থানে থাকতাম। হয়তো তাতে আমার লেখক হিসেবে এত জৌলুস হতো না। কিন্তু আমি তো একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারতাম।
না। ভাবনাগুলো খুবই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। আমি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছি। যে মায়া আমাকে কুহকের অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছিল সে মায়াকে আমি আলিঙ্গন করতে পারি না। মায়ার কুহক আমাকে সাধারণ জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আবার এও ভাবছি আমি কি আমার এই জীবন উপভোগ করছি না! করছি তো। মাঝখানে নাবিলা এসে সব ওলোট পালোট করে দিতে চায়। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি নাবিলা আমার প্রেমে পড়েছে। আমাকে পেতে চাইছে। নাবিলার অল্পবয়সী রঙিন চোখ তো জীবনের কঠিন রূঢ় বাস্তবতা দেখেনি। তাই সে এরকম ভাবতে পারছে। তাকে আর প্রশ্রয দেওয়া ঠিক হবে না।
কিন্তু প্রশ্রয় না দিয়েও কেন জানি পারছি না। যে মায়ার জন্য জীবনকে অন্যদিকে পরিচালিত করলাম আজ সে মায়ার কাছে হেরে যাচ্ছি। আমার যে হেরে যেতে ইচ্ছেও করছে। এত দ্বিবিধ টানাপড়েনে কখনো পড়িনি আমি। আমার উপন্যাসের চরিত্রতা মাঝে মাঝে এরকম দোটানায় ফেলে দিতো। আজ বাস্তবের চরিত্র এসে আমাকে দোটনায় ফেলে দিচ্ছে।
নাবিলা এসে আমার গা ঘেঁসে বসলো। কী অপূর্ব সুবাস। আমি যেন এই সুবাসের সঙ্গে পরিচিত। যেন জন্ম জন্মান্তর ধরে আমি এই সুবাসের কাছে নতজানু হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিলাম।
নাবিলা আমার ঘাড়ে মাথা রাখলো। নাবিলা স্থির হয়ে গেছে। নাবিলা বোধহয় বুঝতে পারছে আমার ভেতরের টানাপড়েন। আসলে আমার উপন্যাস পড়তে পড়তে ও আমাকে এত বুঝে ফেলেছে যে তাতে কোনো ভুলের অংশ নেই।
নাবিলা বললো, এ দুনিয়ায় আপনার কেউ নেই। এটা আমি জানি।
আমি বললাম, কিভাবে জানো? কে বলেছে তোমাকে কেউ নেই আমার!
নাবিলা আমার ঘাড় থেকে তার মাথা তুললো। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, আমাকে বললো আপনার নীরবতা। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের সবচেয়ে বড় সঙ্গী হলো নীরবতা। আপনার আশে পাশে কেউ থাকলে এভাবে নীরব হয়ে যেতে পারতেন না আপনি।
নাবিলা তার বয়সের চেয়েও ভারী কথা বলছে। বই পড়ে পড়ে এরকম ম্যাচিউরড আর লজিক্যাল হয়ে উঠেছে সে বোঝা যাচ্ছে। আমি এই পরিস্থিতিকে আর এগুতে দিতে চাই না। আমি চলে যেতে চাই। কিন্তু নাবিলাকে ঠেলে দূরে সরে দিয়ে যাওয়াটাও আমার কাছে অসম্ভব লাগছে। আমি একটা বড় করে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
তখনই ফোন বেজে উঠলো। নাবিলা আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে ফোন ধরলো।
—হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম। জ্বি বলছি। ও জুহাইরা আন্টি। না আম্মু তো বাসায় ফেরেনি এখনো। আচ্ছা ঠিক আছে। আসার সাথে সাথেই বলব আপনি ফোন করেছিলেন। ওকে আন্টি। আসসালামু আলাইকুম।
নাবিলা আবার পাশে এসে বসলো। শান্ত। স্নিগ্ধ। স্বাভাবিক। জুহাইরা আন্টি ফোন করেছিল। এ বি গ্রুপের ডিএমডি। আম্মুর কলিগ। আম্মুও ওই কোম্পানির একজন ডিএমডি।
আমার বুকের ভেতরে ধক করে উঠল। আমার কুড়ি বছর আগের জীবন ভেসে উঠতে লাগলো। এ কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে আমার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল। ওটাই ছিল আমার শেষ চাকরি। জুহাইরাকে আমি চিনি। যদি নাবিলার আম্মুকেও চিনে ফেলি! কিংবা আমাকে চেনে ফেলে! বড্ড কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
বোধহয় এই বিষয়টিই আমাকে শক্তি জুগিয়ে থাকবে। আমি সবকিছু উপেক্ষা করে দাঁড়ালাম। বললাম, আমার এক্ষুণি যেতে হবে। তোমার সাথে পরে কথা হবে।
আমি যেতে উদ্যত হলাম। নাবিলা এসে আমাকে দুই হাত দিয়ে বুকের ভেতরে জাপটে ধরলো। তখনই দরোজায় দেখা গেলো এক রমণীকে। নাবিলার আম্মু।
আমি নাবিলাকে ধরতেও পারছি না। ছাড়তেও পারছি না। নাবিলার আম্মুর দিক থেকে চোখও সরাতে পারছি না। সেই মুখ। সেই চোখ। সেই নাক। সেই ভঙ্গি। শুধু বয়সের একটু ছাপ। চুলের স্টাইল একটু পরিবর্তিত। তার চোখে আগুন-বিস্ফোরিত—নাবিলা! একটা ধমকের সুরে চিৎকার ভেসে এলো তার কণ্ঠ থেকে। সেই কণ্ঠ। মিষ্টিবিধুর। সেই চোখ। সেই রাগ-বিস্ফোরিত চোখে এখন বাষ্প। বাষ্প-রুদ্ধ চোখ নিষ্পলক।
নাবিলা ততক্ষণে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে ভেতরে। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে তাকে অতিক্রম করে এলাম।
মনে মনে বললাম, তিলোত্তমা, তোমার সাথে আমার এখানেও দেখা হয়ে গেলো! যে দেখাকে আমি সাঙ্গ করতে চেয়েছিলাম কুড়ি বছর আগে।
আপনার মন্তব্য লিখুন