সবুজ সমারোহে ছাওয়া গ্রাম পাটাচোরা। নদী দিয়ে ঘেরা চতুর্দিক। অরন্য জুড়ে পাখিদের কোলাহল। এ গ্রামের দখিন কোণে অবস্থিত প্রকৃতির দৃশ্যে অপরূপ ভাবে সাজানো নান্দনিক, দর্শনীয় তীরধারা দ্বীপ। মায়াবী মধুর নিভৃত পল্লী এলাকা। এমন প্রেমপ্রীতি গড়া, সবুজে ভরা গ্রামে একটি রাখাল ছেলে পিতৃহারা মায়ের একমাত্র সোনার টুকরো, নামটি যে তাঁর কাশী। দু’নয়ন জুড়ে তাঁর স্বপ্ন খেলা করে। দু’ঠোঁটের হাসিতে গোলাপ ফোঁটে। সদা সত্যতা ও সভ্যতায় গড়া তার দেহ মন। রোজ বিকালে তীরধরা দ্বীপ সংলগ্ন নদীর তীরে, মায়াবী সুরে সে বাঁশি বাজায়। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া দল বেঁধে চরে, ধীরে ধীরে এ তীরে। নদীর তীরের সবুজ সবুজ লকলকে ঘাস মনের সুখে খায়। বাঁশির সুমধুর সুরে জলের ঢেউ কূলে আসে । ডিহি বেয়ে মাঝির দল ছুটে চলে । ভেসে যাওয়া পদ্ম ফুলেরা দোল খাই দুলে দুলে। সূর্যরশ্মির স্বর্ণালী আলো ঝলমল করে সারাক্ষন। তালে তালে নাচে টেংরা পুটি চিংড়ি কাতল নানান মাছের দল। কেউ লাফিয়ে কেউ লেজ নেড়ে অকৃত্রিম বন্ধু সুরে তাল মিলায়। তীরের দেওয়ায় পা বাঁধিয়ে ব্যাঙের দল নিশ্চুপে কর্ণ চেতিয়ে বাঁশির সুর ধ্বনী শোনে। ঝর্ণার সীমাহীন স্রোত অবলীলায় পাড়ি দেয় নদীর বুকে। আপন ঠিকানার আশ্রয় খুঁজে নিতে মহাসুখে। তীরের বৃক্ষের ডালে ডালে রঙবেরঙের হরেক পাখি বাঁশির সুরে সুর মিলিয়ে আনন্দে গান গায়। পাখা দুটি নেড়ে নেড়ে সাদর সম্ভাষণ জানাই রাখাল ছেলে কাশীর। দখিনা বাতাস জলের পরশ নিয়ে শীতল হাওয়ায় বৃক্ষের পাতা দোল খাওয়ায়। প্রকৃতির নয়নভিরাম মায়াবী অবাকী দৃশ্য একাকার হয়ে যায় আনন্দে। সতেজ নির্ভেজাল মনোরম মনোহর পরিবেশ হয় আতœভোলা। বাঁশির সুরে দখিনা বায়ু সবুজের গায়ে মনের সুখে
দোল দেয়। কচি পাতা হেলে দুলে সুরের খেয়ায় মাতাল হয়। মিষ্টি মধুর সুরেলা ঢেউ দুর দুরান্তে
ছুটে ছুটে চলে যায়। খেয়া পারের মাঝিরা আনন্দে নাউয়ের দাঁড় বেয়ে এপার ওপার পাড়ি দেয়। খেজুরের মিঠা রস গাঙ শালিক ঠোঁট ডুবিয়ে প্রাণ ভরে খাই। বৃক্ষ কুটিরে বসবাসরত পাখির ছানাগুলো উঁকি ঝুঁকি দেয় নয়ন ভরে রাখাল ছেলেকে দেখার জন্য, বাঁশির সুর সোনার জন্য উদগ্রীব হয়। রবির মিঠা আলোতে বালুময় চিকচিক স্বর্ণে জ্বলে ওঠে। মনোহর দিগন্তে রাখাল বাঁশির সুর,সুমধুর কণ্ঠে মায়াবি ছন্দে মনোরম পরিবেশ করে তোলে। সবুজের বুক চিরে ঝর্ণাধারার অবিরাম ছুটে চলা বালুময়ের পরশ বুলিয়ে। রাখাল বাঁশির মিষ্টিময় দৃষ্টিময় সুরে জেগে ওঠে মৃত পরিবেশ। মায়ার চাদরে জড়িয়ে আদরে আদরে পাগল করে তোলে প্রকৃতির আঙিনা। বাঁশির সুরে তালে তালে দল বেঁধে শিশুদের হাততালির তাল মিলানো, সত্যিই সে এক নিদারুন অনুভূতিময় দৃশ্য। প্রকৃতির সতেজ ছোঁয়া আবেগে আবেগে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। নদীর বুকে বাঁশের জাল বিছিয়ে, সুরের মূর্ছনায় মন হারিয়ে জেলেদের অনবরত মাছ ধরা। ক্লান্তহীন দেহমন করে তোলা। নিরবে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে বিছানো জাল দু’হাতে টেনে ধীরে ধীরে ছিটানো মাছগুলো একত্রে গচ্ছিত করে, নিচে পাতা টুকরো জালে বিরামহীনভাবে আবদ্ধ করা। দুই পাড়ের সবুজ বনায়ন বি¯তৃর্ণ সবুজের পালক বিছিয়ে আড় চোখে চেয়ে থাকা। অপলক নয়নে সীমাহীন স্বপনে প্রীতিময় স্মৃতি ছবি করে রাখা। প্রতিদিনই রাখাল বাঁশির সুর শুনতে মুখিয়ে থাকা। বাঁশি হাতে দুষ্ট কাশী আর আসে না নদীর তীরের এই মায়াবী পরিবেশে। উত্তাল করে তোলে না আর প্রকৃতির সব কিছু সতেজ ছোঁয়ার পরিবেশ হঠাৎ-ই নিঃপ্রাণ। নিরব নিথর,নিস্তেজ। নিদারুন বৈচিত্র্যের ছোঁয়া আর খুঁজে পাওয়া যায় না এখানে। শ্মশানের গন্ধ মাখা ছায়া এখানে। যৌবনের দুরন্ত বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস আর নেই। হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে সবকিছু। কাশীর বাঁশির সুর ডেকে এই হয়তো আসবে ছন্দের সাগরে ভাসবে প্রত্যাশিত আকাঙ্খায় চেয়ে থাকা। প্রকৃতির এই মায়াবীনী স্মৃতির পলক বার বার কাশীর বাঁশির সুর ফিরে পেতে চাই। কী হল তার? খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি অন্ধকার। ঝাপসা আলোয় দুখিনী মা গালে দু’হাত দিয়ে ঘরের বারান্দায় একাকি বসে। চোখের জলের বাঁধভাঙ্গা ঢেউ ছুটে যাচ্ছে দু’গাল বেয়ে বেয়ে। পিছনের ঘরের দরজা ব›ধ। “কাশীর কথা জানতে চাইলে বল্ল বেডে শোয়া, চম্কিয়ে বুক ধড়ফড় করে উঠল হেডে ধোয়া”। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম ব্যান্ডেজে কাশীর মুখমন্ডল জড়ানো। দুচোখে তার ছলছল জল। কষ্ট ব্যথার পাহাড় বুকে চাপানো। নির্বাক নয়নে উচ্ছাসিত চাওয়া। কেমন করে এমন হলো কাশীর? জানতে চাইলে কাশীর মা কেঁদে কেঁদে বলল, জাতির ভেদাভেদে কেন এত সংঘাত? কেন এত ক্ষমতার লোভে দ্বন্ধ ? সেদিন সন্ধালগ্নে কাশী গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল হরতাল ডাকা মিছিল। পিকেটিং আর ইট পাটকেল ছোঁড়া ছুঁিড়তে একটি ইট এসে কাশীর মুখে লাগে। মুখের সামনের দাঁত গুলো ভেঙে যায়। নিমিষেই জ্ঞান হারায় কাশী । হাসপাতাল থেকে এই তো বাড়ি এনেছি। নিরব কাশী ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। অশ্রুতে ভেজে দু চোখ, ভেজে পাশে পড়ে থাকা কাশীর সোনালি স্বপ্ন সুরের বাশি । যে বাঁশি আর কোনদিন ও কাশীর মুখে বাজবেনা তুলবেনা আর জাদুকরি ছন্দসুর ।
গীতিকার : বাংলাদেশ বেতার
বসবাস: সাহিত্য সদন (৩য় তলা)
কোমরপুর, কার্পাসডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা -৭২২১।
বাংলাদেশ। মোবা: ০১৭২৪৯৪৮২৫৯।
আপনার মন্তব্য লিখুন