রঙের জীবন

ওরিওল পাওলো জীবনী

সবুজ খন্দকার:

১০ কোটি রুপির বলিউড ছবি ‘বদলা’র আয় ১৪০ কোটি রুপির কাছাকাছি। গাণিতিক হিসাবে সেটা ১৪ গুণ। শাহরুখ খানের প্রোডাকশন, অমিতাভ বচ্চনের স্বভাবসুলভ অভিনয়ে আধিপত্য আর সুজয় ঘোষের দারুণ পরিচালনায় কম বাজেটে নির্মিত হলেও ছবিটি শাহরুখের রেড চিলিসকে এনে দিয়েছে আশাতীত সাফল্য। বলিউড দর্শকরা যে ভাল নির্মাণের থ্রিলার রিমেক হলেও দেখে সেটা সবাইকে জানান দিল। তবে যেই ছবির জন্য এই গল্পটি প্রথমে লেখা অর্থাৎ‘দ্য ইনভিজিবল গেস্ট’ (স্পেন) বলতে এসেছি তার নির্মাতা ওরিওল পাওলো কে নিয়ে।

তাঁর জন্ম স্পেনের কাতালুনিয়া বার্সেলোনায়। সে হিসেবে তিনি কাতালান। ১৯৭৫ জন্মসাল ধরলে তিনি এখন ৪৪ বছরের মধ্যবয়েসী। পাওলো কে সবাই ‘দ্য ইনভিজিবল গেস্ট‘র জন্যই চিনে থাকবেন। থ্রিলার পছন্দ করেন আর এই ছবি দেখেননি বা দেখে রোমাঞ্চিত হননি এমন সিনেমাপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। সিনেমার গল্পের পরতে পরতে পাওলো জমিয়ে রাখেন সত্য জানার অপেক্ষা। তবে ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা শঙ্কুর মত এখানে কোন গোয়েন্দা নেই। দর্শকমাত্রই এখানে গল্পের আবিষ্কারক। পেয়াজের মত এখানে খোঁসা ছাড়াতে ছাড়াতে দর্শক যখন সাদা অংশ পেয়েছেন ভাবেন, তখনই তাকে ধাক্কা দেন পাওলো। এই ধাক্কাটাই থ্রিলার!

পাওলোর পড়াশুনা বার্সেলোনার পম্পেও ফ্যাবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিষয় ছিল অডিও ভিজুয়াল কমিউনিকেশন। শব্দ আর ছবির চলমানতা তাকে টেনে নেয় ফেলে দেয় ফিল্মের মহাসমুদ্রে আরো কিছু জানতে। তাই পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনা করেন লস এঞ্জেলস ফিল্ম স্কুলে। শুরুতে একজন চিত্রনাট্যকার হিসেবেই মূলতঃ কাজ করেন পাওলো। ১৯৯৮ সালে পাওলো প্রথম লেখার পাশাপাশি যুক্ত হন পরিচালনাতে। তবে তা ছিল একটি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র, নাম McGuffin. এরপর একে একে কয়েক বছরে বানিয়ে ফেলেন আরো তিনটি শর্টফিল্ম El foro (২০০১), Tapes (২০০২) আর Eve (২০০২). এরমধ্যে শুধু El foro তিনি পরিচালনা করেন, তবে লেখেননি। চিত্র্যনাট্যকার হিসেবে এরপর আরো কিছু ছোট পর্দার কাজ করেন পাওলো। এগুলো হল – Ecos (২০০৬), Codi 60 (২০১১). তবে তাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি দেয় সে সিরিজটি সেটি হল ২০০৪ সালে করা Absolute majority আর ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত প্রচারিতThe color of the cuitat.

এরমধ্যে সিনেমায় লেখার সুযোগ পেয়ে যান পাওলো। Guillem Morales এর পরিচালনায় ২০১০ সালে Julia‘s eyes ছবিতে প্রথমবার কাহিনি ও চিত্রনাট্যের কাজের মাধ্যমে বড়পর্দায় নাম লেখান পর্দার পেছনের এই যাদুকর। সেটি ছিল থ্রিলার ঘরানার ছবি। এরপর আর থেমে থাকেননি। একের পর এক বিরতি দিয়ে বানিয়ে চলেছেন মনে রাখার মতো থ্রিলার। সাথে সাথে স্পেনের বাইরেও বাড়ছে তার ভক্তের সংখ্যা। পূর্ণদৈর্ঘ সিনেমার পরিচালক হিসেবে নাম লেখানোর স্বপ্ন তার পূর্ণ হয় দু বছর পরই। The Body ছবি দিয়ে সৃষ্টি করেন আলোড়ন। ছবিটি শুধু স্পেনে নয় কয়েকটি ভাষায় ডাবিং এবং রিমেক করে পাওলো জানান দেন তার নিজস্ব থ্রিলার বলার ভঙ্গি, যা দর্শক এবং বোদ্ধা দুই শ্রেণীকেই টানতে থাকে মারাত্মকভাবে। সিটজেস ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটি প্রথম দেখানোর পর গোয়া ফেস্টিভালে পাওলো পান সেরা নতুন পরিচালকের মনোনয়ন আর ছবিটি একই বছর সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় প্যারিসের ফ্যান্টাস্টিক ফিল্ম ফেস্টিভালে।

হাসপাতাল মর্গ থেকে পোস্টমর্টেমের আগেই চুরি হয় লাশ। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে দেখতে পায় লাশটি যার তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কেমিক্যাল কোম্পানির মালিক। তার স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়া ও অন্য মেয়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা প্রমাণিত হয়ে যখন দর্শক মোটামুটি নিশ্চিত হবেন কে এই লাশ চুরির সাথে জড়িত আর কে ই বা জড়িত এই মৃত্যুর সাথে তখনই খাবেন অপ্রত্যাশিত ধাক্কা। The Body ছবির গল্পটি এমনই উত্তেজনায় ঠাসা।

Mar Targaronaর পরিচালনায় Secuestro (Boy Missing) ছবির জন্য পাওলো ২০১৬ সালে লেখেন আরেকটি থ্রিলার গল্প। এক বাচ্চা ছেলের হারিয়ে যাওয়া ও একে ঘিরে বিভিন্ন অপচেষ্টার রহস্যে সাজানো ছবিটি। এরপর তিনি লেখার সাথে পরিচালনা করেছেন আরো তিনটি ছবি। যার মধ্যে ২০১৭ তে মুক্তিপ্রাপ্ত The Invisible guest কে ধরা হচ্ছে সর্বকালের সেরা থ্রিলার ছবিগুলোর একটি। এ পর্যন্ত অনেক ভাষায় ছবিটি রিমেক করা হয়েছে। অর্জন করেছে পুরস্কার, সম্মাননা ও দর্শকপ্রিয়তা। প্রথমবার কোন স্পেনিশ সিনেমা চীনে মুক্তি পায়, বিশ্বজুড়ে আয় করে ২৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

একজন উঠতি ব্যবসায়ীকে পুলিশ খুনের পর হাতে নাতে গ্রেফতার করে একটি হোটেলকক্ষ থেকে, তার পরকীয়ার সঙ্গীকে হত্যার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয় তার বিরূদ্ধে। সেই ব্যবসায়ী তার আইনজীবি বন্ধুর রেফারেন্সে মামলার ভার তুলে দেয় শহরের সবচেয়ে চৌকস আইনজীবির কাছে যে কিনা গত চল্লিশ বছরে কোন কেস হারেননি আর জীবনের শেষ কেস হিসেবে এটিও হারতে চাইবেন না। ব্যবসায়ী সেই আইনজীবির কাছে নিজের মত করে ঘটনার বিবরণ দাঁড় করায়, কিন্তু চৌকস এই আইনজীবি বিভিন্ন আবেগ আর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে বের করে আনেন সত্যি ঘটনা । দর্শক এখানেও যদি সত্যিকার খুনী কে ধরতে পেরেছে বলে স্বস্তিলাভ করে বসে তবে ভুল হবে। কারণ ছবির ক্লাইম্যাক্স বলে অন্য কথা।

পাওলোর পরের ছবি Mirage প্রযোজনায় এগিয়ে আসে নেটফ্লিক্স। ছবিটি বিশ্বজুড়ে বহু দর্শক দেখেছে গত বছর। একজন মা আর তার ছেলের মধ্যকার টাইম ট্রাভেলে বিভিন্ন রহস্য জুড়ে দিয়ে ছবিটির গল্প বানানো। পাওলো পাশাপাশি টিভি সিরিজে পরিচালক হিসেবে ২০১৬ থেকে যুক্ত আছেন Night and Day তে এবং এটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চ্যানেল ফোরে প্রচারিত এই সিরিজে ফরেনসিক বিভাগের এক প্যাথলজিস্টের জীবন কিভাবে একটি নৃশংস খুনের সাথে জড়িয়ে যায় সেটি দেখানো হয়। ইতিমধ্যে এর দুটি সিজন শেষ হয়েছে। ২০১৯ সালের জন্য আবারো নেটফ্লিক্সের সাথে আরেকটি নতুন থ্রিলারের কাজ নিয়ে এগুচ্ছেন পাওলো। হারলেন কবডেন্সের উপন্যাস ‘দ্য ইনোসেন্ট‘ নিয়ে এবার তিনি ওয়েব সিরিজ বানাতে যাচ্ছেন। আর এভাবেই সমসাময়িক কালের থ্রিলার লেখক ও পরিচালকদের মধ্যে ওরিওল পাওলো ধীরে ধীরে নিজেকে ও স্পেনিশ মুভিকে বিশ্ব দরবারে দারুণভাবে চিনিয়ে যাচ্ছেন তার গল্প বলার জাদুতে।